বিজলীকে দেখে একজন বলল, হায় খোদা! এরা তো দেখি একটা দুধের বাচ্চারে ধরে নিয়ে আসছে!
আরেকজন হি হি করে হেসে বলল, আজকালকার মাইয়া জন্ম হওয়ার সাথে সাথে পাকনা মরিচ!
আরেকজন জিজ্ঞেস করল, কী করছিলা? চুরি চামারি নাকি অন্য কিছু?
বিজলী কী বলবে বুঝতে পারল না, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে সে হাঁটুতে মাথা রাখল। শুনল একজন বলছে, পিটাইছে মনে হয়।
হ। শক্ত পিটান দিছে–
নিষ্ঠুর চেহারার একজন মহিলা তার শাড়ির গোজ থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে সেখান থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগিয়ে সেটাতে একটা টান দিয়ে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে বলল, এই মেয়ে তোর নাম কী?
বিজলী হাঁটু থেকে মাথা তুলে নিচু গলায় বলল, বিজলী।
কই ছিলি? কী করছস?
বিজলী সিগারেট মুখে মেয়েটির দিকে তাকালো, তার সাথে তুই তুই করে কথা বলছে, মনে হয় মেয়েটা অন্যভাবে কথা বলতেই জানে না। কথা বলার ভঙ্গি যত খারাপই হোক গলায় স্বরে একটু সমবেদনা আছে। বিজলী বলল, মাথার ঠিক ছিল না, তাই একজনরে মারতে গেছিলাম।
কারে?
ডিরেক্টর না হলে চেয়ারম্যান হবে।
কী জন্যে?
আমার ছোট ভাইটারে কোথায় জানি দিয়ে দিছে। আমারে জানায় নাই। কথা শেষ করে বিজলী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকা মেয়েগুলো কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইল। তারপর একজন উঠে এসে তার পিঠে হাত রেখে বলল, কান্দিস না। দুনিয়াটাই এই রকম।
সিগারেট মুখে মেয়েটি এক মুখ ধোয়া ছেড়ে বলল, ঐ ডিরেক্টররে মাইর দিতে পারছিলি? ব্যাড়া মানুষরে মাইর দেওয়া খুব সোজা। দুই ঠ্যাংয়ের মাঝখানে খালি শক্ত একটা লাথি দিবি
বিজলী বলল, ডিরেক্টর, পুরুষ না। মহিলা।
এবারে সবাই একটু সোজা হয়ে বলল। একজন বলল, মাইয়া মানুষ? মাইয়া মানুষরে মাইর দিছস?।
সবাই তখন খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল সে ঠিক কীভাবে তাকে মেরেছে। বিজলী অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, সে খুব বিস্ত রিতভাবে পুরো ঘটনাটার বর্ণনা দিল এবং সেটা শুনে সবাই আনন্দে হি হি করে হাসল।
নাজনীনকে ধাওয়া করে নেওয়ার সময় সে যখন আছাড় খেয়ে পড়েছে সেই অংশটি তাকে দুইবার বলতে হলো। এবং দুইবারই সবাই হেসে গড়াগড়ি খেল।
শুধু একটা মেয়ে না হেসে একবার একজনের মুখের দিকে আরেকবার আরেকজনের মুখের দিকে একটু অবাক হয়ে তাকাতে লাগল, মনে হলো সে বিজলীর কিংবা অন্য কারো কোনো কথা বুঝতে পারছে না।
বিজলী কিছুক্ষণের মাঝেই বুঝে গেল মেয়েগুলো অন্যরকম। তাদেরকে নানা জায়গা থেকে ধরে আনা হয়েছে। যারা আছে তারা সবাই কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো ঝামেলা করে এসেছে। কয়েকজন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। একজন মহিলা পকেটমার। কয়েকজন দাবি করল তারা খারাপ মেয়েলোক, তার অর্থ কী বিজলী পরিষ্কার বুঝতে পারল না। যে মেয়েটি অন্যদের সাথে হাসিতে যোগ দেয়নি সে ইন্ডিয়ান মেয়ে, কীভাবে কীভাবে এই দেশে এসে আটকা পড়েছে। বাংলা বোঝে না কিন্তু ইংরেজি জানে। একটি মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে এবং মুখ শক্ত করে বলেছে সে আর বাড়ি ফিরে যাবে না। জায়গাটা একটা জেলখানার মতো, কিন্তু এখানে কারো কোনো বিচার হয় না, এখান থেকে কেউ কখনো জেলেও যায় না। সবাই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এখানে আটকা পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে কেউ চেষ্টা তদবির করে কাউকে ছুটিয়ে নেয়। মাঝে মাঝে কোনো মহিলা সংগঠন এসে কাউকে কাউকে ট্রেনিং দেয়, তারপর তাকে কোথাও নিয়ে কাজে লাগিয়ে দেয়। অন্যেরা দিনের পর দিন এখানে আটকা থাকে।
.
কয়েক দিন কেটে যাবার পর বিজলীর সুলতানার সাথে পরিচয় হলো। সুলতানা কথা বলে খুব কম এবং সবার থেকে সব সময় একটু আলাদা থাকে। বয়স বিজলীর সমান কিংবা এক-দুই বছর বেশি। একদিন বিজলীকে জিজ্ঞেস করল, তুই লেখাপড়া জানিস?
বিজলী বলল, ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছি।
সুলতানা তখন তার কামিজের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বিজলীর হাতে দিয়ে বলল, এইখানে কী লেখা পড়ে শুনাবি।
বিজলী কাগজটা হাতে নিয়ে দেখল, সেটা একটা চিঠি। রুলটানা কাগজে ভুল বানানে কাঁচা হাতে লেখা লম্বা একটা চিঠি। সুলতানার মা চিঠিটা লিখেছে। বাড়িতে নানা ধরনের সমস্যার কথা দেওয়া আছে। সুলতানার ছোট বোনের লেখাপড়ার কথা আছে। ছোট ভাইয়ের দুষ্টুমির কথা আছে। চিঠির শেষে সুলতানার বাবার কথা লেখা আছে, তাকে বাজারে মাঝে মাঝে দেখা যায়, বাড়িতে আসে না।
চিঠি পড়া শেষ হলে সুলতানা চিঠিটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাড়ি যাইতে হবে।
কেমন করে যাবে?
সুলতানা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, পালাব।
বিজলী চমকে উঠল, পালাবে?
হ্যাঁ।
কেমন করে? তোমারে তো চব্বিশ ঘণ্টা এইখানে তালা দিয়া রাখে।
উপায় বার করা লাগবে। তারপর হঠাৎ বিজলীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুই যাবি আমার সাথে?
আমি? বিজলী চমকে উঠল, আমি যাব তোমার সাথে?
হ্যাঁ।
বাইরে থাকব কই? খাব কী?
থাকবি রাস্তায়। সবাই যে রকম থাকে। খাওয়ার জন্যে কাম কাজ করবি, ভিক্ষা করবি, চুরি করবি-সমস্যা কী? লাখ লাখ বাচ্চা রাস্তায় থাকে। মেয়ে হওয়ার জন্যে একটা সমস্যা, কিন্তু সেইটারও রাস্তা আছে।