বিজলী চিৎকার করে বলল, তার কোথায় থাকার কথা?
আমরা বাচ্চাদের এখানে শেল্টার দিই, তারপর কোনো একটা ফ্যামিলির সাথে থাকার ব্যবস্থা করে দিই।
কোন ফ্যামিলি?
কেন? তুমি সেটা জেনে কী করবে?
খোকন আমার ভাই! বলতে গিয়ে বিজলী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, আমি খোকনরে দেখতে চাই, তারে দেখতে চাই, দেখতে চাই
নাজনীন মাথা নেড়ে বলল, না! তুমি আর তাকে দেখবে না। জেনে রাখো সে খুব ভালো আছে।
নাই! ভালো নাই! বিজলী চিৎকার করে বলল, সে কই আছে। আমারে বলতে হবে। কই আছে খোকন?
নাজনীন একটু হাসির ভঙ্গি করে বলল, তোমাকে বলতে হবে?
হ্যাঁ বলতে হবে।
না বললে তুমি কী করবে?
আমি, আমি– বিজলী কথা শেষ করতে পারল না, হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগল।
নাজনীন বলল, সাইক্লোনের সময় তোমার বাবা-মা পানিতে ভেসে গিয়েছিল মনে আছে? ধরে নাও তোমার খোকনও ভেসে গেছে!
বিজলীর মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল। তার খোকন পানিতে ভেসে গেছে? মনে হলো হঠাৎ তার মাথার মাঝে রক্ত উঠে গেল। বিজলী কী করছে নিজেই জানে না, হঠাৎ সে পাগলের মতো নাজনীনের দিকে ছুটে এল, তার ধাক্কায় নাজনীনের চেয়ার উল্টে পড়ল। নাজনীন চিৎকার করে ওঠে এবং এর মাঝে বিজলী তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, মনে হলো সে বুঝি নাজনীনকে খুন করে ফেলবে।
কাওসার এবং তার পিছু পিছু দুজন গার্ড ছুটে এসে বিজলীকে ধরার চেষ্টা করল। ঝটকা মেরে বিজলী তাদের থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। তার মাথার চুল এলোমেলো, চেহারা হিংস্র বাঘিনীর মতো। গার্ড দুজন আবার তাকে ধরে টেনে সরানোর চেষ্টা করে, বিজলী গার্ডের হাতে কামড় দিয়ে নিজেকে ছুটিয়ে নেয়।
নাজনীন কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়েছে। তাঁর চোখে-মুখে একধরনের আতঙ্ক। এই ছোট মেয়েটি এরকম বাঘিনীর মতো তাকে আক্রমণ করবে সে জীবনেও কল্পনা করে নাই। নাজনীন তার টেবিলের কোনা ধরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, ধরো, এই মেয়েটাকে ধরো।
তাকে ধরার জন্যে গার্ডেরা এগিয়ে এল, কিন্তু কেউ তাকে ধরে রাখতে পারল না। বিজলী ঝটকা মেরে আঁচড়ে কামড়ে নিজেকে ছুটিয়ে নেয়, তারপর আবার নাজনীনের দিকে ছুটে গেল।
নাজনীন একটা চিৎকার করে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে খোলা দরজা দিয়ে বের হয়ে ছুটতে থাকে, পেছন পেছন বিজলী ছুটে আসে। নাজনীনের দৌড়াদৌড়ি করে অভ্যাস নেই, তারপরও সে করিডোর ধরে ছুটে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
হোস্টেলের অসংখ্য ছেলেমেয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল তাদের ভয়ংকর নাজনীন ম্যাডামকে নতুন আসা মেয়েটি ধাওয়া করে নিয়ে যাচ্ছে। তারা দেখল সিঁড়ির গোড়ায় নাজনীন ম্যাডাম হুমড়ি খেয়ে পড়ল এবং নতুন আসা বিজলী নামের ছোটখাটো মেয়েটি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
অনেকগুলো গার্ড এসে এবারে বিজলীকে ধরে ফেলল। মোটাসোটা একজন বিজলীর মাথায় একটা ঘুষি মারল এবং তখন বিজলী কেমন যেন টলে উঠে মাটিতে পড়ে গেল, চিৎকার করে বলতে লাগল, খোকন, তুই কই গেলি? খোকন, খোকন–
৩. দেয়ালে পিঠ দিয়ে
দেয়ালে পিঠ দিয়ে বিজলী বসে ছিল। তার মাথার ভেতরে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছে। সে ভালো করে কোনো কিছু চিন্তা করতে পারছে না। খোকনকে কোনোদিন আর সে দেখতে পারবে না, চিন্তা করলেই তার মাথাটা ঘুরে উঠছে। সাইক্লোনের রাতে সে যখন খোকনকে ধরে গাছে বসেছিল, বন্যার পানি একটু পরপর যখন তাদের টেনে নিয়ে যেতে চাইছিল তখনো সে এরকম অসহায় বোধ করেনি।
গার্ডগুলো তাকে এই ঘরে ঢুকিয়ে পিটিয়েছে। বিজলী হাত দিয়ে যেটুকু সম্ভব নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে, পারেনি। সারা শরীরে ব্যথা। কপালের উপর আর ঠোঁটের কোনা কেটে গিয়েছে, মুখে নোনা রক্তের স্বাদ। বিজলী অবশ্যি সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। খোকন তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, এই চিন্তাটা মাথা থেকে সরাতে পারছে না, তাই শরীরের ব্যথাটাও ভালো করে টের পাচ্ছে না।
কতক্ষণ সে এই ঘরটার মাঝে বসেছিল নিজেই জানে না। একসময় খুঁট করে দরজাটা খুলে গেল। দরজার সামনে কয়েকজন মহিলা পুলিশ। একজন বলল, এই মেয়ে। তুমি বের হয়ে এসো।
একজন গার্ড বলল, হাতে হাতকড়া লাগিয়ে নেন। না হলে সমস্যা হতে পারে। এই মেয়ে খুব ডেঞ্জারাস।
মহিলা পুলিশ বলল, সেইটা আমরা দেখব। তারপর আবার বিজলীর দিকে তাকিয়ে বলল, এসো। বের হয়ে এসো।
বিজলী উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, সারা শরীরে ব্যথা, সে দেয়াল ধরে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল। মহিলা পুলিশটা এসে তাকে ধরে সাহায্য করে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে আসে। গার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা এর গায়ে হাত দিয়েছেন? মারপিট করেছেন?
গার্ড বলল, মেরে তক্তা করে ফেলা দরকার ছিল।
মহিলা পুলিশটা বলল, কাজটা ঠিক হয় নাই।
বিজলী খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমাকে কোথায় নিচ্ছেন। হাজতে?
তোমার বয়স কম। তোমাকে হাজতে নেয়া হবে না।
তাহলে?
তোমার বিরুদ্ধে অনেক বড় কমপ্লেন হয়েছে। তাই তোমাকে আমাদের হাতে দেওয়া হয়েছে।
এইখানে আমার ছোট ভাই ছিল, এরা তাকে কোথায় জানি সরিয়ে নিয়েছে।
মহিলা পুলিশ বলল, অনর্থক কথা বলো না। কোনো লাভ হবে না।
বিজলী চুপ করে গেল। হঠাৎ করে তার মনে হলো কিছুতেই আর কিছু আসে যাবে না।
.
নানা জায়গায় ঘুরিয়ে, নানা অফিসে বসিয়ে রেখে শেষ পর্যন্ত তাকে একটা বড় বিল্ডিংয়ে আনা হয়েছে। সেখানে একজন মহিলা একটা কলাপসিবল গেট খুলে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়। একটা সরু সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে হেঁটে সে একটা বড় হলঘরে এসে পৌঁছাল। সেখানে মেঝেতে সারি সারি বিছানা। অনেকগুলো নানা বয়সী মেয়ে সেই বিছানাগুলোতে শুয়ে-বসে আছে।