খোকন ছটফট করে প্রায় হাহাকার করে উঠল, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলল, কিন্তু আমি বিজলীবুর সাথে থাকতে চাই।
তুমি তোমার বিজলীবুর সাথে থাকতে পারবে না। মনে করো তোমার বিজলীবু মরে গেছে। সাইক্লোনের রাতে বন্যার পানিতে তোমার বাবা-মা মরে ভেসে গেছে, সেটা তোমার মনে আছে?
খোকন অবাক হয়ে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল। নাজনীন বলল, মনে করো তোমার বিজলীবুও মরে ভেসে গেছে। তোমার কেউ নেই। বুঝেছ?
কী বুঝতে হবে খোকন সেটাই বুঝতে পারল না। নাজনীন হাসি হাসি মুখে বলল, তোমার বিজলীবুকেও আমরা কোনো ফ্যামিলির সাথে দিয়ে দেব। তার বিয়ে হবে সংসার হবে, বুঝেছ। তুমি যে রকম হ্যাপি হবে তোমার বিজলীবুও হ্যাপি হবে। তবে–
নাজনীন কথা বন্ধ করে হঠাৎ তার মুখ কঠোর করল। খোকন বিস্ফারিত চোখে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল। নাজনীন বলল, তবে তুমি যদি তোমার নতুন ফ্যামিলিকে তোমার বিজলীবুর কথা বলে দাও তাহলে কিন্তু সব শেষ।
শেষ?
হ্যাঁ। তাহলে তোমার বিজলীবুকে খুন করে ফেলব!
খোকন ভয়ে আতঙ্কে পাথর হয়ে গেল। নাজনীন খুবই ঠান্ডা গলায় বলল, কাজেই তোমার বিজলীবু বেঁচে থাকবে নাকি মরে যাবে সেটা নির্ভর করছে তোমার উপর। বুঝেছ?
খোকন মাথা নাড়ল। নাজনীন বলল, তাহলে বুঝেছ তোমাকে কী করতে হবে? মরে গেলেও তুমি তোমার নতুন ফ্যামিলিকে বলবে না যে তোমার একজন বোন আছে। যাকে তুমি বিজলীবু ডাকো। মনে থাকবে?
খোকন শুকনো মুখে মাথা নাড়ল। নাজনীন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ভেরি গুড। এই তো, তুমি হচ্ছ আমার গুড বয়। তুমি যদি গুড বয় হয়ে থাকো তাহলে তোমার বিজলীবুও গুড গার্ল হয়ে থাকবে। যদি গুড বয় না থাকো তাহলে তোমার বিজলীবুও গুড গার্ল হয়ে থাকবে না। হয়ে যাবে ডেড গার্ল। বুঝেছ?
খোকন ভালো করে কিছু শুনছিল না, শুনলেও ভালো করে বুঝতে পারছিল না। তার সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে।
নাজনীন খোকনকে নিয়ে যখন মিলি আর রায়হানের বাসায় পৌঁছেছে তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। কলিংবেল টেপার আগেই মিলি দরজা খুলে দিল। নাজনীন খোকনের হাত ধরে ঘরে ঢুকে মিলির দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে আপনার ছেলে।
মিলির বুকের ভেতর জানি কেমন করে উঠল। তার মনে হলো খোকনকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে কিন্তু ছোট বাচ্চাটি একেবারে প্রথম দেখাতেই এরকম আদরে হয়তো বিব্রত হয়ে যাবে, তাই সে খোকনের মাথায় হাত বুলিয়েই সন্তুষ্ট থাকল। তার সামনে নিচু হয়ে বসে বলল, খোকন, তুমি তোমার ঘরটা দেখতে চাও?
খোকন কিছু না বুঝে মাথা নাড়ল। মিলি তখন তার হাত ধরে ভেতরে ছোট ঘরটাতে নিয়ে গেল। গত চব্বিশ ঘণ্টা মিলি আর রায়হান মিলে তার ঘরটা সাজিয়েছে। বিছানার উপর রঙিন বেড কভার, কমিক বইয়ের চরিত্র আঁকা কম্বল। মাথার কাছে পড়ার টেবিল, সুন্দর একটা টেবিল ল্যাম্প। ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা জুড়ে একটা শেলফ, সেই শেলফে নানা রকম বই। দেয়ালে একটা টেবিল ক্লক, সেখানে একটা বানরের ছবি।
খোকন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ঘরটির দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরে পরে তার বইগুলোর দিকে চোখ পড়ছিল। কত সুন্দর সুন্দর বই, সব তার জন্য? কী আশ্চর্য! খোকনের হঠাৎ করে বিজলীবুর কথা মনে পড়ল।
সে আর কোনোদিন বিজলীবুকে দেখতে পাবে না? কোনোদিন না?
খোকন হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। মিলি তখন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, কেন কাঁদছ সোনা? আমরা আছি না? দেখবে তোমার আর কোনো কষ্ট থাকবে না। কোনো কষ্ট থাকবে না।
*
নাজনীন কাওসারের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এখন গুছিয়ে একটা রিপোর্ট লিখো। চমৎকার একটা কেস স্টাডি হবে।
কাওসার একটু ইতস্তত করে বলল, কী লিখব এই রিপোর্টে?
কেন? লিখবে যারিনা সাইক্লোন থেকে যে ছেলেটি বেঁচে এসেছিল আমরা তাকে শুধু যে আশ্রয় দিয়েছি তা নয়, রেকর্ড সময়ের মাঝে তাকে আমরা এডপশানে দিয়েছি। এখন সে একটা লাভিং ফ্যামিলির সাথে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আর তার বোন সম্পর্কে কী লিখব?
সেটা নিয়ে কিছু লিখতে হবে না। যখন সময় হবে তখন লিখবে।
ঠিক তখন বাইরে একটা হইচই-চেঁচামেচির শব্দ শোনা গেল। একটা মেয়ে চিৎকার করছে এবং বেশ কয়েকজন তাকে থামাতে চেষ্টা করছে। নাজনীন ভুরু কুঁচকে বলল, কে চেঁচামেচি করছে?
কাওসার ভালো করে শোনার চেষ্টা করে বলল, মনে হয় বিজলী নামের মেয়েটা।
সে চেঁচামেচি করছে কেন? হোস্টেল থেকে বের হলো কেমন করে? নাজনীন বিরক্ত হয়ে তার কলবেলটা চেপে ধরল, তার আগেই দরজা খুলে ঝড়ের বেগে বিজলী তার ঘরে এসে ঢুকল এবং তার পিছু পিছু কয়েকজন তাকে ধরার জন্যে হাজির হলো।
বিজলীর চুল এলোমেলো, গায়ের কাপড় ছিঁড়ে গেছে, যারা তাকে ধরে থামানোর চেষ্টা করেছে তাদের সাথে ধস্তাধস্তি করে সে ছুটে এসেছে। ঘরে ঢুকেই সে চিৎকার করে বলল, খোকন কই? আমার ভাই খোকন কই?
নাজনীন মুখ শক্ত করে বলল, তুমি এখানে কীভাবে এসেছ? এখন তোমার হোস্টেল থেকে বের হওয়ার কথা না–
যারা তাকে ধরে নিতে এসেছে তাদের একজন বলল, আমরা বলেছি ম্যাডাম। আমাদের কথা শুনে নাই।
বিজলী সামনে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল, খোকন কই? রাতের বেলা খেতে আসে নাই, সকালেও আসে নাই।
নাজনীন কঠিন মুখে বলল, তার যেখানে থাকার কথা সেখানে আছে। তুমি এভাবে চিৎকার করছ কেন?