.
মিলি ঘরটার ভেতরে ঢুকতেই তার ঘরের মাঝামাঝি ছয়-সাত বছরের একটা ছেলের সাথে চোখাচোখি হলো। ছেলেটা তার দিকে কেমন জানি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, মিলিও অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। মিলির মনে হলো এই ছেলেটাকে সে আগে দেখেছে, মনে হলো এই ছেলেটা তার অনেক পরিচিত। হঠাৎ করে মনে হলো এই ছেলেটাকেই সে নিজের পেটে ধরেছিল, মনে হলো সে ছুটে গিয়ে ছেলেটাকে বুকে চেপে ধরে বলে, বাবা আমার! তুই এতদিন কোথায় ছিলি?
কিন্তু সে কিছু করল না, রায়হানের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল। রায়হান হাসি হাসি মুখে বাচ্চাগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। একেবারে সামনে বসে থাকা বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কী নাম তোমার বাবা?
বাচ্চাটি কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে বলল, আফজাল! আমার নাম আফজাল। মোহাম্মদ আফজাল হোসেন।
রায়হান হাসি হাসি মুখে বলল, বাহ!
বাচ্চাটি আরো উত্তেজিত হয়ে বলল, আমার বাবা, মা, ভাই বোন কেউ নাই। কেউ নাই। কথাটি শেষ করে সে নাজনীনের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালো। তাকানোর ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় সে নাজনীনকে বলতে চাইছে যে, সে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছে তার বাবা মা নেই।
রায়হান জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, আহা রে!
পাশে বসে থাকা আরেকটা ছোট বাচ্চা হাত তুলে বলল, আমারও বাবা মা নাই। ভাই বোন কেউ নাই।
তারা কথা শুনে আরো কয়েকটা ছোট বাচ্চা বলল, আমারও বাবা নাই। মা নাই। বাবা নাই মা নাই।
নাজনীন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, হয়েছে হয়েছে। তোমাদের নিজেদের কিছু বলতে হবে না। তোমাদের যেটা জিজ্ঞেস করা হবে শুধু তার উত্তর দাও। ঠিক আছে?
বাচ্চাগুলো সাথে সাথে ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়ে সবাই চুপ করে গেল। রায়হান আরো কয়েকটা বাচ্চার কাছে গেল, তাদের সাথে কথা বলল, কারো মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, কারো পিঠ চাপড়ে দিল। মিলি রায়হানের পাশে পাশে হেঁটে যেতে থাকল কিন্তু নিজ থেকে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে শুধু চোখের কোনা দিয়ে একটু পর পর ঘরের মাঝখানে বসে থাকা ছেলেটিকে দেখতে লাগল। যতবার সে ছেলেটির দিকে তাকিয়েছে অবাক হয়ে দেখেছে ছেলেটিও তার দিকে তাকিয়ে আছে।
রায়হান বেশ কয়েকটা বাচ্চার সাথে কথা বলে মিলির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, কী খবর মিলি? তুমি কোনো বাচ্চার সাথে কথা বলবে না?
মিলিও ফিসফিস করে বলল, না।
কেন?
আমি ঠিক করে ফেলেছি।
রায়হান অবাক হয়ে বলল, কী ঠিক করে ফেলেছ?
কে আমার বাচ্চা।
রায়হান অবাক হয়ে বলল, কে তোমার বাচ্চা?
হ্যাঁ।
কোনজন?
দ্বিতীয় সারিতে মাঝখানে বসে থাকা ছেলেটাকে দেখেছ? ছয় সাত বছর বয়স? চেক শার্ট?
হ্যাঁ! দেখেছি।
এইটা আমার ছেলে।
তোমার ছেলে?
হ্যাঁ।
রায়হান অবাক হয়ে বলল, তুমি কিছু জানো না, শোনো না, কোনো খোঁজখবর নাওনি আর সে তোমার ছেলে?
আমার খোঁজখবর নিতে হবে না। আমি এই ছেলেটিকে চাই!
রায়হান কিছুক্ষণ মিলির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, চলো তাহলে যাই।
যাবার আগে বাচ্চাটার নাম জেনে যাই।
রায়হান বলল, ঠিক আছে। যাও, বাচ্চাটার নাম জিজ্ঞেস করে এসো।
রায়হান একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল, মিলি বাচ্চাগুলোর ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে দ্বিতীয় সারির মাঝখানে বসে থাকা বাচ্চাটার কাছে এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে বাচ্চাটার মাথায় হাত রেখে বলল, তোমার নাম কী সোনা?
বাচ্চাটি কাঁপা গলায় বলল, খোকন।
মিলি আরেকটু ঝুঁকে পড়ল। তারপর নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, খোকন তুমি আমার সাথে যাবে?
খোকন মিলির দিকে তাকাল। একটু আগেই তার ভেতরে একধরনের আতঙ্ক ছিল, হঠাৎ করে তার সেই আতঙ্কটি চলে গেছে। এই মহিলাটির চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে মানুষটি তার অনেক বড় একজন আপনজন। সে মাথা নাড়ল, বলল, যাব।
মিলি খোকনের মাথায় একটা চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ঠিক আছে!
.
মিলি আর রায়হান যাবার আগে নাজনীনকে তাদের পছন্দের বাচ্চাটির কথা বলে গেল। দ্বিতীয় সারির মাঝখানে চেক শার্ট পরে থাকা বাচ্চাটি–যার নাম খোকন।
নাজনীন বলল, অফিসিয়াল কাজকর্ম শেষ করে আগামীকাল তাকে আপনার বাসায় পৌঁছে দেব! আমি নিজেই নিয়ে যাব।
মিলি বলল, থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ!
মিলি অবশ্য নিজে গিয়ে পৌঁছে দেবার আসল কারণটা জানত না। যদি জানত তাহলে সে নিশ্চয়ই আতঙ্কে শিউরে উঠত।
পরদিন যখন নাজনীন গাড়িতে করে খোকনকে নিয়ে মিলিদের বাসায় যাচ্ছে তখন সে খোকনকে নিয়ে পেছনে বসল। গাড়ি ছেড়ে দেবার পর সে ফিসফিস করে বলল, খোকন, তুমি জানো আমরা কোথায় যাচ্ছি?
না। কালকে যে একজন মানুষ আর মহিলা এসেছিল মনে আছে?
খোকন মাথা নাড়ল, বলল, মনে আছে।
তাদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। তাই তারা একজনকে নিজের ছেলের মতো বড় করতে চায়। কাল এসে তারা তোমাকে পছন্দ করে গেছে।
খোকন বলল, আর বিজলীবু?
ওরা বিজলীর কথা জানে না। জানলে তোমাকে নিত না।
খোকনের পুরো জগৎটা অন্ধকার হয়ে গেল। কী বলবে বুঝতে পারল না, কোনোমতে বলল, কিন্তু, কিন্তু–
এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই। আমরা তোমার জন্যে একটা ফ্যামিলি রেডি করে দিয়েছি। তারা তোমাকে অনেক আদর করে বড় করবে। ঠিক সেরকম বিজলীর জন্যেও একটা ফ্যামিলি রেডি করে দেব। সেই ফ্যামিলিও বিজলীকে অনেক আদর করে বড় করবে।