হ্যাপি চাইল্ড নামের প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে কত জায়গা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে মিলি অবাক হয়ে গেল। দুই পাশে দুটো বিল্ডিং, একটা বড় করিডোর দিয়ে দুটো এক সাথে লাগানো। মাঝখানে অফিস, পাশে পার্কিং লট। সামনে একটা খোলা জায়গা, মিলি ভেবেছিল দেখবে সেখানে ছোট বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে কিন্তু সেখানে কেউ নেই।
মিলি আর রায়হান দোতলায় ডিরেক্টর নাজনীনের বড় অফিসটা খুঁজে বের করল। অফিসের দরজাটা খোলা, রায়হান মাথা ঢুকিয়ে বলল, আসতে পারি?
নাজনীন তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আসুন, আসুন। আপনারাই নিশ্চয়ই আমাদের একটা বাচ্চাকে এডপ্ট করার ব্যাপারে এসেছেন। কী চমৎকার!
মিলি আর রায়হান অফিসে ঢুকল। নাজনীনের সামনে রাখা সুন্দর চেয়ারগুলোতে বসল, রায়হান হাতের ফাইলটা টেবিলের উপর রেখে বলল, আসলেই করতে পারব কি না এখনো জানি না। দেখি সম্ভব হয় কি না। আমরা আসলে এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। আপনি সাহায্য করেছেন বলে এতদূর আসতে পেরেছি। নাজনীন হাসি হাসি মুখে বলল, কেন সাহায্য করব না? একটা বাচ্চা যদি একটা পরিবার পায় তাহলে তার জীবনটাই তো অন্যরকম হয়ে যায়। কত দুঃখী বাচ্চা এখানে আপনারা চিন্তাও করতে পারবেন না। আমরা একেবারে বুক আগলে রাখি, তারপরও আমরা চাই সবাই একটা পরিবারের সাথে থাকুক। বাবা-মায়ের ভালোবাসায় বড় হোক।
মিলি কিছু বলল না, একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল। রায়হান বলল, আমরা একটা হাসিখুশি ছোট বাচ্চা চাই। যত ছোট তত ভালো। শুধু একটা ব্যাপার, বাচ্চাটার বাবা-মা ভাই-বোন আত্মীয়স্বজন কিংবা কোনো ধরনের অভিভাবক থাকতে পারবে না। বাচ্চাটা আমাদের নিজেদের বাচ্চার মতো বড় হবে, তারপর হঠাৎ একদিন তার আসল বাবা-মা এসে তাকে নিয়ে যেতে চায় তখন কী হবে?
নাজনীন গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল। বলল, না। এটা কখনোই হবে না। আমাদের এখানে দুই একজন বাচ্চার বাবা-মা, ভাই-বোন কিংবা আত্মীয়স্বজন থাকতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ বাচ্চা পুরোপুরি অনাথ। আপনাদের আমি শুধু সেরকম পুরোপুরি অনাথ বাচ্চাদের দেখাব। যাদের কেউ নেই।
রায়হান বলল, ঠিক আছে।
নাজনীন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনারা এক মিনিট এখানে বসেন। আমি দেখে আসি বাচ্চাগুলো রেডি আছে কি না।
নাজনীন তার অফিস থেকে বের হয়ে দ্রুত পায়ে পাশের বিল্ডিংটাতে হাজির হলো। একটা বড় ঘরে টেবিল ঘিরে ছোট ছোট চেয়ার, সেখানে নানা বয়সী বাচ্চা বসে আছে। টেবিলে বই পত্র খাতা কলম, যারা একটু ছোট তাদের সামনে কাগজ আর রং পেন্সিল। যারা আরো ছোট তাদের সামনে খেলনা। নাজনীন অফিসে ঢুকতেই বাচ্চাগুলো ভয়ে কেমন যেন শিটিয়ে গেল। এখানে যারা আছে তারা সবাই এই ভয়ংকর মহিলাটাকে ভয় পায়।
ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়সী আয়াটি এগিয়ে এসে বলল, কিছু বলবেন ম্যাডাম?
হ্যাঁ। দুজন বাবা-মা বাচ্চা দেখতে এসেছেন। তাদের সামনে ভালো হয়ে থাকবি।
জি ম্যাডাম, সব সময়েই তো ভালো হয়ে থাকি। বলে আয়াটি দাঁত বের করে হাসল।
খবরদার গেস্টদের সামনে বাচ্চাদের বকাবকি করবি না, মারধোর করবি না।
জি না, ম্যাডাম। করব না।
নাজনীন তখন বাচ্চাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, তোমরা কেমন আছো?
বাচ্চগুলো যন্ত্রের মতো বলল, ভালো। ঘরের মাঝামাঝি খোকন বসে ছিল, সে মুখ ফুটে কিছু বলল না। সে ভালো নেই।
নাজনীন এবার ধমক দিয়ে বলল, জোরে বলো।
সবাই এবারে প্রায় চিৎকার করে বলল, ভালো।
গুড। নাজনীন এবারে মাথা ঘুরিয়ে সবগুলো বাচ্চাকে এক নজর দেখে বলল, দুজন বাবা-মা এসেছেন তোমাদের দেখতে। তোমাদের ভিতর যে সবচেয়ে ভালো থাকবে, সবচেয়ে সুইট থাকবে তাকে তারা নিয়ে যাবে। নিজের বাচ্চার মতো আদর করবে, স্কুলে লেখাপড়া করাবে। বুঝেছ?
বাচ্চাগুলো ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল। আতঙ্ক তাদের বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করতে থাকে।
নাজনীন হঠাৎ তার মুখটা কঠিন করে বলল, সবাইকে আমি একটা জিনিস সাবধান করে দিই। যদি তারা তোমাদের জিজ্ঞেস করে তোমাদের বাবা-মা কিংবা ভাই-বোন কেউ আছে কি না, তাহলে তোমরা বলবে কেউ নাই। বুঝেছ?
বাচ্চাগুলো খুব ভালো করে বুঝল না, তারপরেও ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।
যদি তোমাদের ভেতর কেউ বলে যে তার বাবা-মা কিংবা ভাই বোন আছে আমি তাহলে তাকে খুন করে ফেলব। নাজনীন হুংকার দিয়ে বলল, মনে থাকবে সবার?
বাচ্চাগুলো মাথা নাড়ল। একধরনের ভয়াবহ আতঙ্কে থোকনের বুকের ভেতরটা শুকিয়ে গেল। যে মানুষগুলো তাদের দেখতে আসবে তারা যদি তাকে জিজ্ঞেস করে তাহলে তাকে মিথ্যা বলতে হবে। বলতে হবে বিজলীবু বলে কেউ নাই। তখন যদি তাকে নিয়ে যায় তাহলে সে আর কোনোদিন বিজলীবুকে দেখতে পাবে না। ভয়ে আতঙ্কে খোকন কিছু চিন্তা করতে পারে না।
এই ছেলে, এই– খোকন চমকে উঠল। নাজনীন তার দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে। ভয়ে সে শুকনো মুখে উঠে দাঁড়াল।
মুখটা এরকম পাচার মতো করে রেখেছ কেন? মুখ হাসি হাসি করো।
খোকন মুখ হাসি হাসি করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে।
নাজনীন ঘর থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে সে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। তার অনেক কান্না পাচ্ছে। কিন্তু সে এখন কাঁদতে পারবে না। কিছুতেই কাঁদতে পারবে না। তাকে মুখ হাসি হাসি করে থাকতে হবে। যদি তাকে জিজ্ঞেস করে তাহলে তাকে বলতে হবে তার কেউ নাই। বাবা নাই। মা নাই। বোন নাই। বিজলীবুও নাই!