শ্যামল স্যার জানালা থেকে সরে হেঁটে হেঁটে টেবিলের কাছে। ফিরে এলেন, অন্যমনস্কভাবে টেবিল থেকে চকটা হাতে নিতে নিতে বললেন, এত সুন্দর শান্ত-শিষ্ট একটা সমুদ্র কিন্তু সাইক্লোনের সময় এটাই কী ভয়ংকর হয়ে যায়। সত্তর সালে এই সমুদ্র দশ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলেছিল।
বিজলী আবার জানালা দিয়ে সমুদ্রটার দিকে তাকালো। তাদের পাঠ্যবইয়ে সত্তর সালের ঘূর্ণিঝড়ের কথাটা লেখা আছে। এই ঘূর্ণিঝড়ে দশ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল, সেটাও বিজলী পড়েছে। কিন্তু স্যার বলার পর আজকে হঠাৎ করে বিজলী প্রথমবার বুঝতে পারল দশ লক্ষ আসলে অনেক বড় সংখ্যা! সেই ঘূর্ণিঝড়ে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল।
শ্যামল স্যার ক্লাসের ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখনো মাঝে মাঝে সাইক্লোন হয় কিন্তু এখন আর এত মানুষ মারা যায় না।
একজন জিজ্ঞেস করল, কেন স্যার?
সাইক্লোন শেল্টার তৈরি হয়েছে। যখন সাইক্লোন আসে তখন সবাই শেল্টারে চলে যায়। একটা বেলা কষ্ট করে শেল্টারে থাকে, কিন্তু সবাই জানে বেঁচে যায়।
সামনে থেকে একজন জিজ্ঞেস করল, সাইক্লোন কেন হয় স্যার?
স্যার এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। তারপর সাইক্লোন কেন হয় সেটা বোঝাতে শুরু করলেন। সমুদ্রের পানি যখন গরম থাকে তখন জলীয় বাষ্প উপরে উঠে গিয়ে কীভাবে পানির ফোঁটাতে পাল্টে গিয়ে তাপ ছেড়ে দেয়, সেই তাপ কীভাবে সাইক্লোনকে শক্তি দেয় এই রকম কথা। বিজলী ঠিক ভালো করে বুঝতে পারল না, কিন্তু ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে সাথে বুঝে ফেলার ভাণ করে মাথা নাড়ল।
স্যার বোঝানো শেষ করে আবার জানালা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার সব সময় কী মনে হয় জানো?
ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করল, কী মনে হয় স্যার?
আমার মনে হয় সমুদ্রটা বুঝি জীবন্ত। সে জন্যে এটা কখনো থেমে যায় না। একটার পর একটা ঢেউ পাঠাতেই থাকে। পাঠাতেই থাকে!
কয়েকজন ছেলেমেয়ে হি হি করে হাসল, তাদের কাছে মনে হয়েছে স্যারের কথাটা বুঝি হাসির একটা কথা। বিজলী অবশ্যি হাসল না, স্যার আসলে এটা মোটেই হাসির কথা হিসেবে বলেননি।
স্যার ছেলেমেয়েদের হাসিটুকু লক্ষ করলেন বলে মনে হলো না, অনেকটা আপন মনে বললেন, শুধু যে ঢেউয়ের পর ঢেউ পাঠাতে থাকে তা নয়, দিনে দুইবার জোয়ারের সময় পানি ফুলেফেঁপে উঠে আবার ভাটার সময় পানি নেমে যায়! কখনো ভুল হয় না!
একজন জিজ্ঞেস করল, জোয়ার-ভাটা কেন হয় স্যার?
চাঁদের আকর্ষণে। কত দূরে চাঁদ কিন্তু সেটা পৃথিবীর পানিকে আকর্ষণ করে ফুলিয়ে দেয়, আমরা বলি জোয়ার। আবার যখন চাঁদ সরে যায়, পানিটা সরে যায় আমরা বলি ভাটা।
বিজলী জোয়ার-ভাটার ব্যাপারটা একটু চিন্তা করল, তার হঠাৎ করে একটু খটকা লাগল। যদি চাঁদের আকর্ষণে জোয়ার হয় তাহলে তো দিনে একবার জোয়ার হওয়ার কথা। চাঁদ তো দিনে একবার পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরে আসে, দুইবার নয়। কিন্তু দিনে তো সব সময় দুইবার জোয়ার হয়, দুইবার ভাটা হয়। কেন দুইবার?
স্যারকে প্রশ্ন করে জোয়ার-ভাটার ব্যাপারটা কী একবার বুঝে নেবে? ক্লাসে সে কখনোই প্রশ্ন করে না, তার কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগে। কিন্তু আজকে সাত পাঁচ ভেবে বিজলী শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা করার জন্যে হাত তুলল।
স্যার বিজলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কোনো প্রশ্ন করবে?
জি স্যার।
কর।
চাঁদের আকর্ষণে যদি জোয়ার-ভাটা হয় তাহলে তো দিনে একবার জোয়ার আর একবার ভাটা হওয়ার কথা। কিন্তু স্যার
কিন্তু?
কিন্তু স্যার দিনে তো দুইবার জোয়ার আর দুইবার ভাটা হয়।
স্যার ভুরু কুঁচকে বিজলীর দিকে তাকালেন, মনে হলো প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারছেন না।
বিজলী প্রশ্নটা আরেকটু ভালো করে বোঝানোর চেষ্টা করল, বলল, মানে স্যার আমি বলছিলাম কী চাঁদ তো পৃথিবীকে দিনে একবার ঘুরে আসে কিন্তু দুইবার জোয়ার হয় কেন? মানে–
শ্যামল স্যার বিজলীকে থামালেন, বললেন, তোমাকে আর বলতে হবে না। আমি বুঝেছি।
বিজলী উত্তরটা শোনার জন্যে দাঁড়িয়ে রইল। স্যার ভুরু কুঁচকে কীভাবে জানি চিন্তা করতে লাগলেন কিন্তু কোনো কথা বললেন না। এভাবে খানিকটা সময় পার হয়ে গেল, স্যার তখন বিজলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কী আশ্চর্য! এই সহজ একটা জিনিস আমি কখনোই খেয়াল করিনি! তুমি ঠিকই বলেছ, দিনে একবার জোয়ার আর একবার ভাটা হওয়ার কথা।
বিজলী জিজ্ঞেস করল, তাহলে দুইবার কেন হয় স্যার?
আমি জানি না।
বিজলী স্যারের দিকে অবাক হয়ে তাকালো। স্যার এই প্রশ্নের উত্তরটা জানেন না? কী আশ্চর্য।
স্যার মুখটা হাসি হাসি করে বললেন, তোমার প্রশ্নটা খুবই ক্লেভার একটা প্রশ্ন। অসাধারণ প্রশ্ন!
বিজলী থতমত খেয়ে গেল। প্রশ্ন তো প্রশ্নই–সেটা আবার অসাধারণ হয় কেমন করে? বরং উল্টোটা সত্যি, স্যারদের যদি কখনো কোনো প্রশ্ন করা হয় যার উত্তর স্যারেরা জানেন না তখন স্যারেরা রেগেমেগে ধমক দিয়ে তাদের বসিয়ে দেন। শ্যামল স্যার মোটেও রাগলেন না, মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন, তুমি খুবই সুন্দর একটা প্রশ্ন করেছ। আমি কখনোই এটা চিন্তা করিনি। এখন চিন্তা করেও উত্তরটা বের করতে পারিনি।
বিজলী বসে যাচ্ছিল, তখন স্যার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?
বিজলী।
বিজলী? বাহ্ কী সুন্দর নাম!