কাওসার কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়াল, বলল, আমি যাই।
নাজনীন বলল, যাও। চেষ্টা করো ইমোশনাল মেলোড্রামা থেকে বের হয়ে আসতে। নাটকে অভ্যস্ত হয়ে গেলে আসল জীবনে টিকে থাকা কঠিন।
.
রাত্রিবেলা ডাইনিং রুমে বিজলী খোকনকে খুঁজে বের করল। সে আতঙ্কিত মুখে তার বয়সী কয়েকজন ছেলের সাথে বসে ছিল। বিজলীকে দেখে সে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে, ভাঙা গলায় বলতে থাকে, আমি থাকব না, আমি এইখানে থাকব না। থাকব না–
বিজলী তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, কাঁদিস না, খোকন সোনা। কাদিস না। দেখিস সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
খোকন কাঁদতে কাঁদতে বলল, কেমনে ঠিক হয়ে যাবে? কেমনে?
বিজলী ফিসফিস করে বলল, সেলিনা আপা যখন জানতে পারবে তখন আমাদের এইখান থেকে নিয়ে যাবে। দেখিস তুই আমাদের অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে।
সেলিনা আপা কেমন করে জানবে?
জানবে! নিশ্চয়ই জানবে। যখন আমাদের খোঁজ নিবে তখনই জেনে যাবে।
খোকন বিজলীর কথা শুনেও কোনো সান্ত্বনা পেল না। সে বিজলীকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতেই থাকল। ঠিক তখন দুজন আয়া এসে খোকন আর বিজুলীকে টেনে আলাদা করে দুজনকে দুই দিকে নিয়ে গেল। কমবয়সী একজন আয়া ফিসফিস করে খোকনকে বলল, কান্না থামাও। তা না হলে তোমারে অন্ধকার ঘরে খাম্বার সাথে বেন্ধে রাখব। খেতে পাবা না। রাত্রি বেলা জোঁক, বিছা, ইন্দুর আর মাকড়সার সাথে থাকতে হবে। বুঝেছ?
খোকন আতঙ্কিত হয়ে আয়াটির মুখের দিকে তাকিয়ে কান্না বন্ধ করল। একটু পরে পরে এখন শুধু সে হেঁচকি তুলতে থাকে।
.
বিশাল হলঘরে পাশাপাশি রাখা বিছানাগুলোর একটিতে খোকন ঘুমিয়ে ছিল। গভীর রাতে খোকন তার বিছানার ছটফট করতে থাকে, রক্ত শীতল করা আর্তনাদ করে সে বিছানায় উঠে বসে। আশেপাশের বিছানা থেকে ঘুমিয়ে থাকা ছেলেগুলো ভয় পেয়ে জেগে ওঠে। তারা তাকিয়ে দেখে নতুন ছেলেটা বিছানার মাঝে আতঙ্কে দাপাদাপি করছে। তারা কী করবে বুঝতে পারে না।
পাশের বিল্ডিংয়ে ঠিক তখন বিজলী জানালায় শিক ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে ঘুম নেই। খোকনকে ছাড়া সে একা কখন ঘুমিয়েছে। মনে করতে পারে না। জানালার শিক ধরে সে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। ফিসফিস করে বলে, খোদা! এইটা তুমি কী করলে খোদা! কী করলে?
*
গাড়িটা রাস্তায় ওঠার পর মিলি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি বুঝতে পারছি না কাজটা ঠিক হচ্ছে কি না।
রায়হান রাস্তায় ফুল বিক্রি করতে থাকা কয়েকটা বাচ্চা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে বলল, কেন, কাজটা ঠিক হবে না কেন?
নিজের বাচ্চা হলে এক কথা। কিন্তু অন্যের একটা বাচ্চাকে নিজের বাচ্চার মতো মানুষ করতে গিয়ে যদি ভুল করে ফেলি?
ভুল? ভুল মানে কী?
বাচ্চাটাকে যদি ঠিকমতো আদর না করি? নিজের বাচ্চা হলে যেভাবে আদর করতাম সেভাবে যদি না করি।
রায়হান শব্দ করে হাসল, বলল, তুমি কী যে বলো মিলি! রাস্তায় একটা বিড়াল দেখলে তুমি সেইটাকে আদর করো–আর একটা আস্ত মানুষের বাচ্চাকে আদর করবে না?
একটা বাচ্চাকে চিনি না জানি না যদি তাকে আপন মনে না হয়? যদি বাচ্চাটা আনন্দ না পায়, আমাদের সাথে হ্যাপি না হয়?
শোনো মিলি, জিনিসটা এইভাবে দেখো। আমরা শেল্টার থেকে যে বাচ্চাটাকে আনব তার জীবনে এখন এমন কোনো আনন্দ নেই। কোনোভাবে বেঁচে আছে। আমরা যখন তাকে নিজেদের বাচ্চা হিসেবে বড় করব তখন তার জীবনটা আগের জীবন থেকে ভালো হবেই।
মিলি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার আরো একটা ভয় হয়। কী ভয় হয় জানো?
কী?
মনে করো একটা বাচ্চাকে নিয়ে এলাম। আদর করে বড় করলাম, আস্তে আস্তে একেবারে নিজের বাচ্চা হয়ে গেল। তখন কোনো একদিন বাচ্চার আসল বাবা-মা এসে হাজির হলো। দাবি করল এটা তাদের বাচ্চা, তারা নিয়ে যেতে চায়–
রায়হান হাসল, বলল, সেটা হবে না। আমি শেল্টারের ডিরেক্টর নাজনীনকে বলেছি আমরা যাকে এডপ্ট করব তার কোনো আত্মীয়স্বজন থাকতে পারবে না। একেবারে সত্যিকারের অরফান যাকে বলে, সে রকম হতে হবে। নাজনীন বলেছে, সেটি কোনো সমস্যা না। তার বেশিরভাগ বাচ্চা এরকম। কাগজপত্র দেখিয়ে দেবে।
মিলি কোনো কথা না বলে একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
মিলি আর রায়হানের বিয়ে হয়েছে এগারো বছর। তাদের কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই, বছর দুয়েক আগে তারা জানতে পেরেছে তাদের বাচ্চা হওয়ার কোনো আশা নেই। কেন বাচ্চা হতে পারবে না ডাক্তার সেটা তাদের বুঝিয়েছে। খুঁটিনাটি মিলি বুঝতে পারেনি, বোঝার চেষ্টাও করেনি। সেই ছোট থাকতে মিলি কল্পনা করত তার নিজের একটা ছোট বাচ্চা হবে, তাকে বুকে জড়িয়ে বড় করবে। যখন জানতে পারল সেটি আসলে কখনো হবে না তখন তার বুকটা ভেঙে গিয়েছিল। অনেক দিন সে নিজের ভেতর নিজে গুটিয়ে ছিল। তখন রায়হান তাকে বুঝিয়েছে একটা ছোট বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা হিসেবে মানুষ করতে। মিলি প্রথমে রাজি হয়নি, ধীরে ধীরে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে।
রায়হান তখন খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে। এমনিতে একটা অনাথ শিশুকে পথ থেকে তুলে এনে নিজের বাসায় বড় করলে কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু একেবারে আইন মেনে সত্যি সত্যি অন্যের একটা বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা হিসেবে বড় করার অনেক রকম আইনি জটিলতা রয়েছে। সব প্রতিষ্ঠান সেগুলো ঠিকভাবে করতে পারে না। রায়হান খোঁজ নিয়ে জেনেছে, সবচেয়ে নিখুঁতভাবে এই কাজগুলো করতে পারে হ্যাপি চাইল্ড নামে একটা শেল্টার। রায়হান হ্যাপি চাইল্ডের ডিরেক্টর নাজনীনের সাথে কথা বলেছে। নাজনীন তাদেরকে একবার তাদের শেল্টারে গিয়ে বাচ্চাগুলোকে নিজের চোখে দেখে আসতে বলেছে, তাই তারা আজ দেখতে যাচ্ছে।