হ্যাপি চাইল্ডের ডিরেক্টর নাজনীন হঠাৎ চিৎকার করে বলল, মর্জিনা–
জি ম্যাডাম!
তোমাকে কী বলেছি? নিয়ে যাও এদের।
মর্জিনা দুজনকে ধরে প্রায় শূন্যের উপর দিয়ে ঝুলিয়ে টেনে নিয়ে গেল।
.
কাওসার কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইল। তারপর মাথা তুলে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে বলল, নাজনীন ম্যাডাম, আমরা কি একটু বেশি করে ফেললাম না?
নাজনীন তার ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলল, কোন জিনিসটা বেশি করেছি?
এই তো–সবকিছু।
আমার অর্গানাইজেশনে থাকলে আমার নিয়ম মানতে হবে।
কাওসার ইতস্তত করে বলল, কিন্তু—
কিন্তু কী?
তারা তো আমাদের অর্গানাইজেশনে আসতে চায় নাই। আমরা অনেক আগ্রহ দেখিয়ে তাদের এনেছি। আমাকে তো কথা দিতে হয়েছে তাদেরকে একসাথে রাখব।
কীভাবে একসাথে রাখবে?
সেটা আমি ঠিক জানি না। কিন্তু চাইলে নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা। করা যেত।
কেন তাদের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে?
কাওসার একটা উত্তর খুঁজে বের করার জন্যে ছটফট করে উঠল, শেষ পর্যন্ত বলল, ম্যাডাম, আপনি আমাকে বলেছেন যেভাবে হোক এই দুজনকে আনতে হবে। এদের কথা সবাই জেনে গেছে, তাই এদেরকে এখানে রাখতে পারলে আমাদের হ্যাপি চাইল্ডের অনেক বড় ব্রান্ডিং হবে। ডোনারদের এদের উদাহরণ দেখিয়ে বড় ফান্ডিং আনা যাবে।
হ্যাঁ, আমি বলেছি। এর মাঝে কোন কথাটা মিথ্যা? কোন কথাটা ভুল?।
কাওসার বলল, মিথ্যা কিংবা ভুল বলছি না, কিন্তু এই বাচ্চা দুটি যদি এত স্পেশাল হয় তাহলে তাদের জন্যে একটু স্পেশাল ব্যবস্থা করলে দোষ কী?
নাজনীন বলল, কাওসার, তুমি অনেক কথা বলেছ, এখন আমি বলি। এটা সত্যি, এই দুজনকে আমরা আনতে পেরেছি, এটা বিশাল একটা ঘটনা। আমরা এদেরকে বিক্রি করে বিশাল মাইলেজ পাব। খোঁজ নিয়ে দেখো অন্য সব এনজিও এখন মাথা চাপড়াচ্ছে!
তাহলে–
নাজনীন কাওসারকে থামিয়ে বলল, এরা স্পেশাল আমাদের কাছে, কিন্তু সে জন্যে তাদের স্পেশালভাবে দেখতে হবে কে বলেছে? এরা কোথায় থাকত বলো?
কাওসার ইতস্তত করে বলল, একটা চরে।
সেখানে কীভাবে থাকত? খুব হাই ফাঁই নাকি না খেয়েদেয়ে?
খুবই সাধারণভাবে থাকত।
যে ছেলে আর মেয়ে একটা ভাঙা বাড়িতে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাত এখন তারা এখানে দুই বেলা পেট ভরে খাবে। সকালে ব্রেকফাস্ট, এছাড়াও দুইবার স্ন্যাক। প্রতিবছর তাদের নতুন জামা কাপড়। পরিষ্কার বিছানা। ছয় মাস পর পর মেডিক্যাল চেকআপ। যাদের সম্ভব তারা দেশে বিদেশে এডপশানে চলে যাবে। অন্যেরা স্কুলে পড়বে না হয় ভোকেশনাল ট্রেনিং। এখন তুমি বলো সাইক্লোনের কারণে এদের জীবনটা কি এখন ভালো হলো নাকি খারাপ হলো?
কাওসার কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না। একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু আমরা তো সেটা তাদের দয়া করে দিচ্ছি না। আমাদের ডোনাররা তাদেরকে এভাবে রাখার জন্যে আমাদের ফান্ড দিচ্ছে–
এই ফান্ডটা আগে কত ছিল, এখন কত হয়েছে?
কাওসার মাথা নেড়ে বলল, এখন বেড়েছে। আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ফান্ডিং অনেক বেড়েছে।
তাহলে তুমি বলো, আমি কি অর্গানাইজেশনটা ভালো চালাচ্ছি না খারাপ চালাচ্ছি?
কাওসার অনেক সাহস করে বলে ফেলল, যদি ফান্ডিংয়ের দিক থেকে দেখি তাহলে ভালো চালাচ্ছেন। কিন্তু যদি ছেলেমেয়েদের দিক থেকে দেখি তাহলে তাহলে
নাজনীন মুখ কালো করে বলল, তাহলে কী?
তাহলে ভালো চলছে না।
তুমি কী বলতে চাইছ?
কাওসার মরিয়া হয়ে বলল, যেমন একটু আগের ঘটনাটা দেখেন। এই ছেলে আর মেয়েটির কথা চিন্তা করেন। তারা কী আনন্দে আছে? নাই। তাদের কী মনে হচ্ছে না যে আমরা তাদেরকে একটা জেলখানায় আটকে ফেলেছি?
নাজনীন কোনো কথা না বলে শীতল চোখে কাওসারের দিকে তাকিয়ে রইল।
কাওসার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা তুলে বলল, এই ছেলে আর মেয়েটির জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ছেলে আর মেয়ে দুটি নিশ্চয়ই এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করছে। আমি তাদেরকে এভাবে না আনলে তারা নিশ্চয়ই তাদের মতো থাকতে পারত।
নাজনীন তার গলার স্বরটা একটু নরম করে বলল, তোমার মন খারাপ করার কিছু নেই কাওসার। বাচ্চাগুলোর উপর যদি কোনো নিষ্ঠুরতা করা হয়ে থাকে তাহলে সেটি করেছি আমি। তুমি কিছু করোনি। তাছাড়া তোমার একটা বিষয় বুঝতে হবে।
কী বিষয়?
তোমার মনে হতে পারে আমি এই ছেলেমেয়েগুলোর সাথে নিষ্ঠুরতা করছি, কিন্তু সেটি সত্যি না। এই বাচ্চাগুলো এসেছে সমাজের সবচেয়ে নিচু অংশ থেকে। পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে তাদেরকে অনেক শক্ত হতে হয়। বড়লোকের লুতুপুতু ছেলেমেয়ে হলে তারা একদিনও টিকে থাকতে পারত না। কাজেই ধরে নাও তোমার কাছে যেটা নিষ্ঠুরতা মনে হচ্ছে সেটা তাদের একটা ট্রেনিং। কঠিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ট্রেনিং।
কাওসার কোনো কথা না বলে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল। নাজনীন অনেকটা যন্ত্রের মতো বলল, এই যে ভাইবোনের ব্যাপারটা–এগুলো এই বাচ্চাগুলোর জন্যে একটা বিলাসিতা। সবাই তার নিজের জন্য বেঁচে থাকে। এদেরও নিজেদের মতো নিজেদের টিকে থাকতে হবে। কিসের ভাই? কিসের বোন?
কাওসার এবারেও কোনো কথা বলল না। নাজনীন বলল, বাচ্চাগুলো দেখতে দেখতে ভুলে যাবে কে কার ভাই, কে কার বোন! দুই সপ্তাহ যেতে দাও দেখবে এই ভাইবোনের ভালোবাসা কোথায় ভেসে গেছে!