সেলিনা জাহান বলল, তোমাদের জীবনের উপর দিয়ে অনেক বড় একটা ধকল গিয়েছে। এখনো যাচ্ছে। প্রথম প্রথম তোমাদের অনেক কষ্ট হবে। আস্তে আস্তে দেখো অভ্যাস হয়ে যাবে। পৃথিবীতে অনেক মানুষের জীবনে অনেক কষ্ট হয়, খোদা আবার তাদের জীবনে শান্তি দেন। সুখ দেন। একদিন দেখবে তোমাদের জীবনে সুখ-শান্তি ফিরে আসবে। অবশ্যই আসবে।
বিজলী কোনো কথা বলল না। এই পৃথিবীতে এখন তাদের কেউ নেই। সেলিনা আপা ছাড়া আর কেউ নেই। সেলিনা আপার কথা শুনে তার চোখে পানি চলে আসতে চায়।
.
পরদিন বিকেল বেলা সেলিনা জাহান একজন মানুষকে নিয়ে এল। মানুষটার গলায় টকটকে লাল একটা টাই। বিজলী আর খোকনের দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে, ইনি ঢাকা থেকে তোমাদের নিতে এসেছেন। ইনি কাওসার সাহেব।
কাওসার সাহেব বিজলী আর খোকনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী খবর তোমাদের? আমরা তোমাদের সম্পর্কে খবরের কাগজে পড়েছি। পড়ে আমাদের মনে হয়েছে তোমাদের সাহায্য করা দরকার। তাই তোমাদের নিতে আমি নিজেই চলে এসেছি।
বিজলী মানুষটার কথা ভালো করে শুনল না, সে সেলিনা জাহানের দিকে তাকিয়ে বলল, আপা, আপনি ভালো করে বলে দিয়েছেন তো যে আমি আর খোকন একসাথে থাকব?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলে দিয়েছি।
কাওসার নামের লাল টাই পরা মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই এক জায়গায় থাকবে।
বিজলী বলল, এক জায়গায় না, এক সাথে।
মানুষটা জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, ঐ তো। একই কথা। এক জায়গা মানে এক সাথে।
বিজলী কেমন জানি ভয় পাওয়া চোখে সেলিনা জাহানের দিকে তাকালো। সেলিনা জাহান বিজলীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোমার কোনো ভয় নেই বিজলী, আমি আছি। আমি খোঁজ রাখব।
তারপর তার ব্যাগ খুলে একটা কার্ড বের করে বিজলীর হাতে দিয়ে বললেন, এই যে আমার কার্ড। এটা তোমার কাছে রাখো। যখনই দরকার হবে তুমি আমাকে ফোন করো।
বিজলী কার্ডটা নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখল।
হাসপাতাল থেকে বের হবার সময় মোটাসোটা নার্সটা বিজলী আর খোকনকে বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
*
হ্যাপি চাইল্ডের ডিরেক্টরের অফিসঘরটা খুব সুন্দর। বিশাল বড় একটা ডেস্ক, সেই ডেস্কের গদি আঁটা চেয়ারে ডিরেক্টর নাজনীন বসে তার ল্যাপটপে কাজ করছে। ঘরের দেয়ালে পেইন্টিং, বেশির ভাগই ছোট শিশুদের ছবি। ঘরের ভেতর কেমন জানি আরাম আরাম ঠান্ডা।
লাল টাই পরা কাওসার নামের মানুষটা বিজলী আর খোকনকে নিয়ে ডিরেক্টরের ঘরে ঢুকল। নাজনীন চোখ না তুলেই বলল, কী খবর কাওসার?
মানুষটা বলল, ম্যাডাম, সাইক্লোন যারিনা সার্ভাইবার ছেলে আর মেয়েটিকে নিয়ে এসেছি।
নাজনীন এবারে মুখ তুলে তাকালো, বলল, গুড। জব ওয়েল ডান। তারপর প্রথমবার বিজলী আর খোকনের দিকে তাকালো। বিজলী ভাবল এই মহিলাটি এখন তাদের দুজনকে এখানে বসতে বলবে। মহিলাটি কিন্তু তাদের বসতে বলল না। কিছুক্ষণ তাদের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই টায়ার্ড। যাও, একটু রেস্ট নাও।
বিজলী মাথা নাড়ল। নাজনীন তখন একটা কলবেল টিপল, সাথে সাথে ছোটখাটো পাহাড়ের মতো একজন মহিলা ঘরে এসে ঢুকল। হ্যাপি চাইল্ডের ডিরেক্টর নাজনীন মহিলাটার দিকে তাকিয়ে বলল, মর্জিনা। এই দুইজনকে নিয়ে যাও। ছেলেটাকে নর্থ বিল্ডিংয়ে আর মেয়েটাকে সাউথ বিল্ডিংয়ে।
বিজলী চমকে উঠল, দুজনকে দুই বিল্ডিংয়ে নিতে বলছে! খোকন ভয় পেয়ে খপ করে বিজলীর হাত শক্ত করে ধরে ফেলল। নাজনীন ভুরু কুচকে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হলো? কোনো সমস্যা?
বিজলী বলল, আমরা দুজন একসাথে থাকব।
নাজনীন শীতল গলায় বলল, তোমরা যখন আমাদের অর্গানাইজেশনে থাকতে এসেছ, আমাদের অর্গানাইজেশনের নিয়ম মানতে হবে। তোমাদের জন্য আলাদা নিয়ম করা যাবে না।
বিজলী বলল, কিন্তু সেলিনা আপা বলেছেন আমরা দুজন এক সাথে থাকব। বিজলী লাল টাই পরা মানুষটাকে বলল, বলেছেন না? আপনি তাই বলেছেন না?
কাওসার ইতস্তত করে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে বলল, ম্যাডাম ব্যাপারটা হচ্ছে–
নাজনীন বলল, সেলিনা আপা মানুষটা কে?
লোকাল টিএনও।
নাজনীন কেমন জানি রেগে উঠল। বলল, আমার অর্গানাইজেশন কীভাবে চালাব, সেটা আমার একজন টিএনওর কাছ থেকে শিখতে হবে?
বিজলী মরিয়া হয়ে বলল, কিন্তু সেটা তো বলেছেন। কাওসারের দিকে তাকিয়ে বলল, বলেছেন না?
কাওসার আমতা আমতা করে বলল, না, মানে হয়েছে কী–
নাজনীন একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, এই মেয়ে, কাওসার কী বলেছে সেটা আমার জানার দরকার নেই। আমি কাওসারের জন্যে কাজ করি না। বুঝেছ? তারপর পাহাড়ের মতো মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, মর্জিনা। নিয়ে যাও এদের।
বিজলী বলল, আমি সেলিনা আপার সাথে কথা বলব। সেলিনা আপা আমাকে বলেছে দরকার হলে তার সাথে কথা বলতে–
কীভাবে কথা বলবে?
আমাকে সেলিনা আপা কার্ড দিয়েছে। সেখানে টেলিফোন নম্বর আছে।
নাজনীন ভুরু কুঁচকে বিজলীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, দেখি কার্ডটা।
বিজলী ব্যাগ থেকে কার্ডটা বের করে নাজনীনের দিকে এগিয়ে দিল। নাজনীন কার্ডটি পড়ল, তারপর টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে তার টেবিলের নিচে ছেঁড়া কাগজের বিনটাতে ফেলে বিজলীর দিকে তাকালো, বলল, এখন?
বিজলী নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। তার গলা থেকে একটা আর্তনাদের মতো শব্দ বের হয়ে আসে। খোকন বিজলীর হাত শক্ত করে ধরে রেখে কাঁদতে শুরু করে দেয়।