চলো তাহলে।
এই হাসপাতালে আসার পর তারা তাদের রুম থেকে খুব বেশি বের হয় নাই। মাঝে মাঝে কী সব পরীক্ষা করার জন্যে এক-দুইবার তাদের বের হতে হয়েছে, পরীক্ষা শেষ হবার পর আবার তাদের কেবিনে নিয়ে এসেছে।
রুম থেকে বের হয়ে দুজন করিডোর ধরে হেঁটে যায়। করিডোরের শেষ মাথায় একটা জায়গায় নার্সদের বসার জায়গা। সেখানে একজন মানুষের গলায় একটা ক্যামেরা ঝোলানো, নার্সদের সাথে কথা বলছে। তাদেরকে দেখে মোটাসোটা একজন নার্স হাসি হাসি মুখে বলল, হাঁটতে বের হয়েছ?
বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, জি।
হাঁটো। একটা কেবিনের ভেতর চব্বিশ ঘণ্টা বসে থাকা যায় নাকি?
ক্যামেরা ঝোলানো মানুষটাও মাথা ঘুরিয়ে বিজলী আর খোকনকে দেখল, তারপর নার্সকে জিজ্ঞেস করল, এই দুইজনই কি যারিনা সাইক্লোন থেকে রক্ষা পাওয়া বাচ্চা?
নার্স মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।
মানুষটা ঝট করে ক্যামেরা তুলে ছবি তোলার জন্যে চোখে লাগাল। মোটাসোটা নার্সটা হঠাৎ প্রায় ধমক দিয়ে বলল, কী করছেন? কী করছেন আপনি?
আমি সাংবাদিক, ওদের উপর একটা রিপোর্ট করার জন্যে এসেছি।
নার্সটা গলা উঁচিয়ে বলল, না। খবরদার ছবি তুলবেন না। আমার উপর অর্ডার আছে কেউ এই বাচ্চাদের নিয়ে নিউজ করতে পারবে না। কথা বলতে বলতে মোটাসোটা নার্স উঠে বিজলী আর খোকনের সামনে এসে দাঁড়াল।
সাংবাদিকটা কেমন জানি রেগে উঠল, বলল, কেন? কেন ওদের উপর রিপোর্ট করতে পারব না?
কারণ ওরা ছোট। ওদের উপর রিপোর্ট করতে হলে ওদের গার্জিয়ানদের পারমিশান নিতে হবে।
কে ওদের গার্জিয়ান?
এখন আমরা ওদের গার্জিয়ান। টিএনও ম্যাডাম আমাকে বলেছেন ওদেরকে যেন সাংবাদিকদের থেকে দূরে রাখি।
সাংবাদিক মানুষটা অবাক হবার ভঙ্গি করে বলল, কেউ এরকম কথা শুনেছে? আমরা একটা নিউজ কাভার করতে পারব না?
পারবেন না কেন? একশবার পারবেন। কিন্তু এই বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে পারবেন না।
সাংবাদিকটা রাগী রাগী মুখে বলল, আমি আপনাদের উপর রিপোর্ট করব।
নার্সটা হাসি হাসি মুখে বলল, যত ইচ্ছা করেন, কোনো সমস্যা নাই! আপনি হচ্ছেন সাত নম্বর সাংবাদিক। আপনার আগে আরো ছয়জন সাংবাদিক এসেছে! আমি কাউকে ওদের কাছে যেতে দেই নাই। আপনাকেও দিব না।
সাংবাদিকটা খুবই রেগে গটগট করে হেঁটে চলে গেল।
নার্সটা তখন বিজলী আর খোকনের দিকে তাকিয়ে বলল, নাও তোমরা হাঁটো। বুঝেছ, এই সাংবাদিকদের ভেতরে কোনো মায়া দয়া নেই। তোমরা কত কষ্টের ভিতর থেকে এসেছ, এখন সেইটা নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তোমাদের সাথে কথা বলবে! কোনো মানে আছে?
বিজলী আর খোকন করিডোরে হাঁটতে লাগল। নার্সটা গজগজ করতে করতে আবার তার আগের জায়গায় বসে কাগজপত্র দেখতে লাগল।
.
দুই দিন পর সন্ধ্যেবেলা সেলিনা জাহান বিজলী আর খোকনের সাথে দেখা করতে এল। তার হাতে একটা সুন্দর ব্যাগ। ব্যাগটা বিছানার উপর রেখে বলল, আমি তোমাদের জন্য কিছু জামাকাপড় কিনে এনেছি। দেখো দেখি তোমাদের ফিট করে কি না।
বিজলী আর খোকন শেষবার কখন নতুন জামাকাপড় পেয়েছিল মনে করতে পারে না। যদি আগের সময় থাকত আর তখন কেউ যদি তাদের জন্যে নতুন কাপড় কিনে আনত তাহলে তাদের কী আনন্দই না হতো। এখন যা কিছুই হোক, তাদের আনন্দ বা দুঃখ কিছুই হয় না।
সেলিনা জাহান ব্যাগ থেকে তাদের কাপড় বের করে দিল। বাথরুমে গিয়ে প্রথমে খোকন তারপর বিজলী সেই কাপড় পরে এল। সেলিনা জাহান হাসি হাসি মুখে বলল, বাহ্! কী সুন্দর, ফিট করেছে।
সেলিনা জাহান ব্যাগের ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, এর ভেতরে তোমাদের তোয়ালে, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, চিরুনি, স্যান্ডেল সবকিছু আছে। নতুন জায়গায় শুরু করতে যা যা লাগে সব আছে।
নতুন জায়গা? বিজলীর বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল।
সেলিনা জাহান মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ। হাসপাতাল থেকে তোমাদের রিলিজ করার সময় চলে এসেছে। এখন তোমাদের কোনো একটা ভালো শেল্টারে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। যেখানে দুজন একসাথে থাকতে পারবে। তোমাদের আদর করে রাখবে, লেখাপড়া করাবে। খুব ভালো একটা শেল্টার–
খোকন জিজ্ঞেস করল, শেল্টার মানে কী?
সেলিনা জাহান বলল, শেল্টার হলো বাচ্চাদের থাকার জায়গা। সেখানে অনেক বাচ্চা থাকে, যারা হারিয়ে গেছে কিংবা বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে, কিংবা বাবা-মায়ের বাচ্চা মানুষ করার পয়সাকড়ি নেই এরকম।
বিজলী বলল, ও!
তোমাদের দুজনকে কোথায় রাখা যায় আমি সেটা নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। তোমাদের খবরটা মিডিয়াতে চলে এসেছে, কাজেই মোটামুটি অনেকেই জানে। অনেক কষ্ট করে সাংবাদিকদের ঠেকিয়ে রেখেছি। অনেক এনজিও তোমাদের নেয়ার জন্যে খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমি মোটামুটি একটা ঠিক করে রেখেছিলাম, তখন আরেকটা অনেক বড় অর্গানাইজেশন যোগাযোগ করেছে। ওদের নাম হচ্ছে হ্যাপি চাইল্ড।
হ্যাপি চাইল্ড?
হ্যাঁ। সেলিনা জাহান মাথা নাড়ল, বলল, তারা শুধু বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করে। ওদের অনেক বড় একটা সেফ হোেম আছে, সেখানে অনেক ছেলেমেয়ে থাকে। তারা তোমাদের নেওয়ার জন্যে এতই আগ্রহী যে আমার সাথে কথা বলার জন্যে একজন কাল চলে আসছে।
বিজলী ঠিক বুঝতে পারল না তাদেরকে নেওয়ার জন্যে সবার এত আগ্রহ কেন। সে অবশ্য কিছু জিজ্ঞেস করল না। খোকনকে নিয়ে থাকার জন্য একটা ভালো জায়গা পেলেই সে খুশি।