শেষ পর্যন্ত খোকন শান্ত হলো, বিজলীর দিকে তাকালো, প্রথমবার বিজলীকে চিনতে পারল, তারপর তাকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
বিজলী নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হইছে? সোনা আমার। কী হইছে তোর?
আমি দেখছিলাম তুমি ভেসে চলে যাচ্ছ—
না, আমি ভেসে যাই নাই, আমি আছি।
আমি দেখছি, অনেক মরা মানুষ তোমারে টেনে নিয়া যাচ্ছে—
না, আমারে কেউ টেনে নেয় নাই।
খোকন কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি দেখছি আমার পায়ের বুড়া আঙুলে কে জানি কামড় দিয়া ধরছে।
বিজলী খোকনকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল, কেউ তোর পায়ে কামড় দেয় নাই। কেউ কামড় দিব না।
খোকন কান্না থামাল, তারপর বিজলীর দিকে তাকিয়ে বলল, বিজলীবু–
বল সোনা ভাই।
তুমি বলো তুমি কোনোদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবা না।
আমি তোরে ছেড়ে কেন চলে যাব? কোনোদিন যাব না।
খোদার কসম?
বিজলী খোকনকে জড়িয়ে ধরে বলল, খোদার কসম।
খোকন তখন একটু শান্ত হলো। বিজলী খোকনকে বিছানায় শুইয়ে তার মাথায় শরীরে হাত বুলিয়ে বলল, তুই এখন ঘুমায়া যা। আমি তোর পাশে বসে আছি।
খোকন তখন গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। বিজলী খোকনের পাশে বসে তার শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কিছুক্ষণের ভেতরে খোকন ঘুমিয়ে পড়ে। বিজলী তার ভাইটির পাশে নিঃশব্দে বসে থাকে। তার বুকের ভেতর কেমন জানি খাঁ খাঁ করতে থাকে।
*
নার্স ব্যান্ডেজটা খুলে নতুন ব্যান্ডেজ লাগাতে যাচ্ছিল, ডাক্তার বলল, আর ব্যান্ডেজের দরকার নেই! ঘা শুকিয়ে গেছে।
বিজলী আর খোকন তাকিয়ে দেখল আসলেই তাদের শরীরের ফালা ফালা হয়ে কেটে যাওয়া জায়গাগুলো শুকিয়ে এসেছে।
ডাক্তার খোকনের পিঠে থাবা দিয়ে বলল, ইয়ং ম্যান–দেখছ, তোমরা কত তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে গেছ? আমাদের মতো বুড়ো মানুষ হলে ভালো হতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ লেগে যেত। বুঝেছ?
খোকন মাথা নাড়ল, কেন বড় মানুষদের ভালো হতে বেশি সময় লাগে সে ঠিক বুঝে নাই। কিন্তু এখন সেটা নিয়ে কথা বলল না। ডাক্তারদের তার ভয় লাগে।
ডাক্তার তারপর বিজলীর দিকে তাকালো, নার্স যখন তার ব্যান্ডেজগুলো খুলছে, তখন ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, ইয়ং লেডি। তুমি কেমন আছো?
ভালো।
গুড। তোমরা দুই ভাই-বোন খুব লাকি। আমি রিপোর্ট দেখেছি, ওই চরে একজনও বেঁচে ছিল না–
বিজলীর হঠাৎ করে তার বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ল। তার চোখে পানি চলে আসছিল, ডাক্তার সেটা লক্ষ করে তাড়াতাড়ি কথা পাল্টে ফেলে বলল, হাসপাতালের খাবার খেতে পারো?
বিজলী চোখ মুছে বলল, পারি।
আমি জানি তুমি আমাদেরকে খুশি করার জন্য বলছ! আসলে কেউ হাসপাতালের খাবার খেতে পারে না! হাসপাতালে কেন এরকম মসলা ছাড়া বিস্বাদ খাবার দেয় জানো?
বিজলী মাথা নাড়ল, বলল সে জানে না।
ডাক্তার গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো করে বলল, এ রকম বিস্বাদ খাবার দেয় যেন রোগীরা বাড়িতে গিয়ে ভালো করে রান্না করা খাবার খাওয়ার জন্যে তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যায়। কথা শেষ করে ডাক্তার হা হা করে হাসতে লাগল। বিজলী ঠিক বুঝতে পারল না এটা এমন কী হাসির কথা যে এত জোরে জোরে হাসতে হবে। কিন্তু তারপরও সে ভদ্রতা করে একটু হাসার চেষ্টা করল।
ডাক্তার হাসি থামিয়ে পকেট থেকে দুইটা চকলেটের বার বের করে একটা খোনকে, আরেকটা বিজলীকে দিয়ে বলল, নাও। আমার ওয়াইফ তোমাদের দুইজনকে দিয়েছে। আমাকে বলেছে সে তোমাদেরকে একদিন দেখতে আসবে।
বিজলী কী বলবে বুঝতে পারল না, তাই মুখটা হাসি হাসি করে রাখল। এই হাসপাতালের সবাই তাদের কথা জানে, সবাই তাদের দুজনকে আলাদা করে আদর করে। একটু পরে পরে এসে সবাই খোঁজ নিয়ে যায়।
ডাক্তার যখন কেবিন থেকে বের হয়ে যাচ্ছে তখন বিজলি তার সাথে সাথে বের হয়ে এল। ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে?
বিজলী মাথা নাড়ল। বলল, জি।
বলো।
রাত্রিবেলা খোকন জানি কী রকম করছিল।
ডাক্তার ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কী রকম করছিল?
ঘুমের ভিতর ছটফট করে, পাগলের মতো হয়ে যায়। আমি যখন জাগিয়ে তুলি তখনো আমাকে চিনে না। ভয় পায়, চিৎকার করে।
ডাক্তার গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, অবাক হওয়ার কিছু নেই। তোমরা যত বড় ট্রমার ভিতর দিয়ে গিয়েছ, অন্য যে কেউ হলে ব্রেক ডাউন করত।
বিজলী বলে, খালি আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি তাকে ছেড়ে চলে যাব না তো।
এটা খুবই ইম্পরট্যান্ট। তুমি এখন তার একমাত্র অবলম্বন। তোমাকে তার সাথে থাকতে হবে। সব সময় ওর সাথে থাকতে হবে।
রাত্রিবেলা যখন ওই রকম করছিল তখন আমার অনেক ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল আর ঠিক হবে না।
না। ভয় পেয়ো না। আমি সাইকিয়াট্রিক ডিভিশনে কথা বলব। তারা দেখে যাবে। তুমি হাসিখুশি থেকো। যেটা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে যত কম কথা বলা যায় তত ভালো। সাংবাদিকেরা যেন চলে না আসে। কেউ যেন জানতে না চায় কী হয়েছিল। ঠিক আছে?
বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।
.
ডাক্তার আর নার্স চলে যাবার পর বিজলী আর খোকন তাদের বিছানায় বসে একটু একটু করে তাদের চকলেটগুলো খেলো। খুবই মজার চকলেট–বিজলী তাই পুরোটা খেলো না, একটুখানি খেয়ে বাকিটা খোকনের জন্যে রেখে দিল।
বিজলী বলল, খোকন আয়, আমরা একটু বাইরে গিয়ে দেখি হাসপাতালটা কী রকম।
কেউ বকা দিবে না তো?
ধুর! বকা দিবে কেন? আমরা কি পালিয়ে যাচ্ছি নাকি?