বিজলী ভাঙা গলায় বলল, আমার মা, বাবা!
মহিলাটি বলল, আমরা আছি। আমরা আছি। তোমাদের কোনো ভয় নেই মা–
ভারী গলায় একজন পুরুষ বলল, মেডিকেল হেল্প দরকার। দেরি করা যাবে না।
পুরুষ মানুষটির কথার উত্তরে আরেকজন কিছু একটা বলল, তার উত্তরে আরেকজন। কেউ একজন ইংরেজিতে কিছু একটা বলল, তখন মহিলাটি কিছু একটা বলল। মানুষগুলো নিজেদের ভেতর নিজেরা কথা বলছে, তাদেরকে নিয়ে কী করবে সেটা ঠিক করছে।
বিজলী চোখ বন্ধ করল। এখন সে আর কিছু চিন্তা করতে চায় না। কিছু না। কী হবে সে জানতে চায় না। সে বেঁচে থাকলে কী হবে আর মরে গেলে কী হবে সেটি নিয়েও তার কোনো মাথাব্যথা নেই। সে বুঝতে পারে তার চোখের সামনে খুব ধীরে ধীরে একটা পর্দা নেমে আসছে। অন্ধকার কালো একটা পর্দা। সেই পর্দা তার সবকিছু ঢেকে ফেলল। সে আর কিছু জানে না।
*
চশমা পরা পাতলা ছিপছিপে একজন মহিলা বলল, আমার নাম সেলিনা। সেলিনা জাহান।
বিজলী গলার স্বরটা আগে শুনেছে। কোথায় শুনেছে ঠিক মনে করতে পারল না।
আমি তোমাদের দুজনকে চর থেকে তুলে এনেছিলাম।
বিজলীর তখন মনে পড়ে গেল, সে এবারে ভালো করে চশমা পরা ছিপছিপে মহিলাটির দিকে তাকালো। সাইক্লোনের পরের রাতে এই মহিলার কথাগুলো মনে হচ্ছিল অন্য কোনো জগৎ থেকে ভেসে ভেসে আসছে।
আমি যখন খবর পেয়েছি চরে দুজন ছেলেমেয়েকে দেখা গেছে–রেস্কিউ হেলিকপ্টারের রিপোর্ট, তখন আমি অন্যদের উপর ভরসা না করে নিজেই চলে গিয়েছিলাম।
বিজলীর মনে হলো এখন তার কিছু একটা বলা উচিত, তাই বলল, আপনি আমাদের জান বাঁচাইছেন।
সেলিনা জাহান মাথা নাড়ল, বলল, না। আমি বাঁচাই নাই। তোমরা নিজেরা তোমাদের জান বাঁচিয়েছ। ঐ চরের আর একজন মানুষও বেঁচে নাই। আমি শুধু তোমাদের চর থেকে তুলে এই হাসপাতালে এনেছি।
সেলিনা জাহান নামের মহিলাটি হাসপাতালের কেবিনটা ভালো করে দেখল। দুটো পাশাপাশি বিছানা। বিছানায় ধবধবে সাদা চাদর। একটা বিছানায় খোকন আধশোয়া হয়ে বসে আছে, অন্য বিছানায় বিজলী। দুজনের হাতে পায়ে শরীরে ব্যান্ডেজ। পরনে হাসপাতালের ঢলঢলে এক ধরনের গাউন।
খুব ব্যস্ত ছিলাম তাই নিজে এসে তোমাদের দেখে যেতে পারিনি। কিন্তু তোমাদের খোঁজ নিয়েছি। ডাক্তার বলেছে তোমরা সুস্থ হয়ে উঠছ। সপ্তাহে খানেকের মাঝে তোমাদের ছেড়ে দেবে।
বিজলী বলল, ছেড়ে দেবে?
হ্যাঁ।
তখন-–তখন–আমরা কই যাব?
সেলিনা জাহান মাথা নাড়ল, বলল, তোমাদের সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমি ব্যবস্থা করব।
বিজলীর জানতে ইচ্ছে হলো ব্যবস্থাটি কী কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না। একটু পর সেলিনা জাহান নিজেই বলল, আমি খোঁজ নিয়েছি। দেশে এখন অনেক অর্গানাইজেশন আছে যারা তোমাদের মতো ছেলেমেয়েদের শেল্টার দেয়।
খোকন হঠাৎ করে বলে বসল, এতিমখানা?
সেলিনা জাহান একটু থতমত খেয়ে গেল, তারপর একটুখানি হাসার চেষ্টা করে বলল, না। এতিমখানা না। এখন দেশে শিশুদের অনেক অর্গানাইজেশন আছে। তারা ছেলেমেয়েদের আশ্রয় দেয়, দেখেশুনে রাখে। দেশী বিদেশী অনেক এনজিও আছে।
বিজলী একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, আমি আর খোকন এক সাথে থাকতে পারব?
সেলিনা জাহান এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ পারবে। নিশ্চয়ই পারবে। আমরা মেক শিওর করব যেন তোমরা দুজন এক সাথে থাকতে পারো।
আলাদা আলাদা দুই জায়গায় দুইজনরে নিবে না তো?
না, নেবে না। বয়স অনুযায়ী অনেক জায়গায় ভাগ করে ফেলে–ছেলে আর মেয়ে হিসেবেও অনেক জায়গায় আলাদা করে ফেলে। আমরা দেখব সেটা যেন না হয়। তোমরা দুজন যেন একসাথে থাকতে পার।
বিজলী একটা নিঃশ্বাস ফেলল। হঠাৎ করে কত তাড়াতাড়ি সবকিছু কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। এখনো সে সবকিছু ভালো করে কিছু চিন্তা করতে পারে না। এখনো মনে হচ্ছে সে বুঝি একটা ঘোরের মাঝে আছে। মনে হয় সে বুঝি একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। মনে হয় হঠাৎ করে তার ঘুম ভেঙে যাবে আর সে অবাক হয়ে দেখবে সবকিছু আগের মতোই আছে। তার বাবা নির্জীবের মতো বাড়ির বারান্দায় হাঁটুমুড়ি দিয়ে বসে আছেন। মা চুলোর মাঝে শুকনো পাতা কাঠি লাকড়ি খুঁজে দিতে দিতে তাকে বকছেন।
.
গভীর রাতে বিজলীর ঘুম ভেঙে গেল। পাশের বিছানায় খোকন ছটফট করছে, যন্ত্রণার মতো শব্দ করতে করতে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। বিজলী লাফ দিয়ে তার বিছানা থেকে নেমে খোকনের কাছে গেল। খোকন ছটফট করতে করতে কিছু একটা বলছে, কথা বলতে বলতে সে হঠাৎ চিৎকার করতে শুরু করে। রক্ত শীতল করা চিৎকার। নিশ্চয়ই ভয়ংকর কোনো একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। বিজলী খোকনকে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ডাকতে থাকে, খোকন, খোকন–এই খোকন–
শেষ পর্যন্ত খোকন চোখ খুলে তাকালো, কিন্তু সে কিছু দেখছে। বলে মনে হলো না। শূন্য দৃষ্টিতে বিজলীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে থাকে।
বিজলী খোকনকে জড়িয়ে ধরে বলে, খোকন, দেখ কিছু হয় নাই খোকন, এই যে আমি–এই যে আমি–
খোকন আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকে, হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করে। উঠে বসে বিছানা থেকে নেমে যেতে চায়–অন্য কোনো একটা জায়গায় ছুটে যেতে চায়!
বিজলী কী করবে বুঝতে পারে না। কাঁদো কাঁদো গলায় খোকনকে ধরে রেখে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে, তার শরীরে হাত বুলায়, মাথায় হাত বুলায়, বুকে চেপে ধরে বলে, ভাই আমার, সোনা আমার, খোকন, খোকন সোনা, তুই তাকায়ে দেখ, আমি আছি, আমি আছি এইখানে, এই দেখ–