বিজলী খোকনের পাশে বসে রইল, তার সমস্ত শরীরটা মনে হয় কেউ ধারালো চাকু দিয়ে ফালা ফালা করে কেটে রেখেছে। বিজলী নিজের হাত-পায়ের দিকে তাকালো, তার নিজের শরীরটাও খোকনের মতো–হাত-পা ক্ষতবিক্ষত, সমস্ত শরীর মনে হয় কেউ খুবলে খুবলে নিয়েছে। এতক্ষণ বুঝতে পারেনি, এখন হঠাৎ করে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সারা শরীর দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। ক্লান্তিতে তার সমস্ত শরীর ভেঙে যাচ্ছে। বিজলী নিজেও তখন খোকনের পাশে শুয়ে পড়ল। মুহূর্তে তার সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়।
.
বিজলী কতক্ষণ অচেতন হয়ে ছিল কিংবা ঘুমিয়েছিল সে জানে না। যখন সে চোখ খুলে তাকালো তখন সূর্য ডুবে যাচ্ছে। চারপাশে কেমন জানি এক ধরনের থমথমে পরিবেশ। বিজলীর বেশ অনেকক্ষণ লাগল বুঝতে সে কোথায় আছে। হঠাৎ করে তার সবকিছু মনে পড়ল তখন সে ধড়মড় করে উঠে বসে। তার পাশে খোকন এখনো ঘুমিয়ে আছে, নিঃশ্বাসের সাথে সাথে তার ছোট বুকটা উপরে উঠছে আর নিচে নামছে।
প্রচণ্ড পিপাসায় বিজলীর বুকটা ফেটে যাচ্ছিল, কিন্তু আশেপাশে কোথাও খাওয়ার মতো একটু পানি নেই। বিজলী কিছুক্ষণ নিজের হাঁটুতে মাথা রেখে বসে রইল। এতক্ষণ সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারেনি, এই প্রথমবার সে সবকিছু চিন্তা করতে পারল।
বোঝাই যাচ্ছে, খোকন আর সে নিজে ছাড়া এই চরে আর কেউ বেঁচে নেই। তার বাবা-মা, চরের অন্য মানুষজন, গরু-বাছুর কেউ বেঁচে নেই। এই সমস্ত চরে বেঁচে আছে শুধু তারা দুজন। তাদের সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত, একটুখানি নড়লেই প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সে শিউরে শিউরে উঠছে। যদি কোনো মানুষ এসে তাদেরকে না বাঁচায় তাদের কী হবে সে জানে না।
ঠিক তখন সে একটা চাপা গুম গুম শব্দ শুনতে পেল, মনে হয় একটা হেলিকপ্টার উড়ে যাচ্ছে। বিজলী অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে হেলিকপ্টারটা দেখার চেষ্টা করল। হেলিকপ্টারটা উত্তর দিক থেকে তাদের চরের দিকে উড়ে আসছে। বিজলী হাত নেড়ে হেলিকপ্টারটির নজরে পড়ার চেষ্টা করল। হেলিকপ্টারে যারা আছে তারা তাকে দেখতে পাচ্ছে কি না সে জানে না। বিজলী অবশ্যি থামল না, যতক্ষণ হেলিকপ্টারটি দেখতে পাচ্ছিল ততক্ষণ সে হাত নাড়াতে থাকল। হেলিকপ্টারটি চরের উপর দিয়ে একটা পাক খেয়ে আবার যেদিক দিয়ে এসেছিল সেই দিকে চলে গেল।
বিজলী হতাশভাবে মাথা নাড়ে, তাকে নিশ্চয়ই দেখতে পায়নি। দেখতে পেলে নিশ্চয়ই নামত। কিংবা কে জানে হয়তো দেখেছে কিন্তু তবু নামেনি। কেন নামবে? তারা কে? তাদেরকে বাঁচাতে হবে কে বলেছে।
বিজলী আবার গুটিসুটি মেরে খোকনের পাশে শুয়ে পড়ে। প্রচণ্ড সাইক্লোন আর জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পেয়ে এখন হয়তো খিদে আর পানির পিপাসায় তারা মারা যাবে। কোনো একটা বিচিত্র কারণে মরে যাওয়ার ব্যাপারটি এখন আর ভয়ংকর কিছু মনে হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে মরে যাওয়াটিই বুঝি ভালো। মরে যাওয়াটাই বুঝি শান্তি।
বিজলী খোকনকে জড়িয়ে ধরে মরে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে করতে আবার গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেল।
মানুষের গলার স্বর শুনে বিজলী হঠাৎ জেগে ওঠে। খোকনকে জড়িয়ে ধরে সে বালুর ওপর শুয়ে আছে। মাথার ওপর বিশাল একটা চাঁদ। বেশ খানিকটা দূরে কয়েকজন মানুষ টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে আসছে। বিজলী মাথা তুলে শোনার চেষ্টা করল, শুনতে পেল একজন চিৎকার করে বলছে, কেউ কি আছে এখানে? আছে কেউ?
বিজলীর মনে হলো তার এখন উঠে বসে কিছু একটা বলা উচিত। কিন্তু কী হলো কে জানে সে কিছু বলল না। ছোট ভাইটিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল। কী হবে কথা বলে?
মানুষগুলো চারদিকে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে আসছে। মনে হয় কাউকে খুঁজছে। চিৎকার করে ডাকছে, আছে কেউ? কেউ আছে এখানে? সাড়া দাও।
বিজলী সাড়া দিল না। কী হলো কে জানে হঠাৎ করে তার দুই চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি বের হয়ে আসে। প্রচণ্ড অভিমানে তার বুকটা ভেঙে যায়? কার বিরুদ্ধে তার এত বড় অভিমান?
টর্চের আলোটা হঠাৎ তাদের উপর এসে পড়ল। আলোটা সাথে সাথে স্থির হয়ে যায়, তারপর হঠাৎ করে সে ধুপধাপ পায়ের শব্দ শুনতে পায়। মানুষগুলো তাদের দিকে ছুটে আসছে। টর্চের তীব্র আলোতে বিজলীর চোখ ধাঁধিয়ে যায়, সে হাত দিয়ে তার চোখ আড়াল করে রাখল। তারপরও সে টের পেল মানুষগুলো তাদের ঘিরে হাঁটু গেড়ে বসেছে। একজন মহিলার উত্তেজিত গলার স্বর শুনতে পেল, বেঁচে আছে! বেঁচে আছে!
একজন মহিলা তার মাথায় হাত রাখল, ফিস ফিস করে বলল, মা, এই যে মা, আমরা তোমাকে নিতে এসেছি। চোখ খুলে একটু তাকাবে? তাকাবে একটু?
বিজলী চোখ খুলে তাকালো না, ঝর ঝর করে কাঁদতে লাগল। টের পেল মহিলাটি তার মাথার নিচে হাত রেখে তাকে বসানোর চেষ্টা করতে করতে নরম গলায় বলল, ভয় নেই মা। তোমার আর কোনো ভয় নেই। আমরা তোমাদের নিতে এসেছি।
একজন মানুষ খোকনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিচু গলায় ইংরেজিতে কিছু একটা বলল। অন্য আরেকজন তার উত্তরে কী যেন বলল বিজলী বুঝতে পারল না।
বিজলী তার হাঁটুতে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। কাঁপা গলায় বলল, সবাই ভাইসা গেছে। সবাই।
মহিলাটি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তোমরা কেমন করে বেঁচে আছো আমি জানি না। যারা শেল্টারে যায় নাই তাদের কেউ বেঁচে নেই! খোদা তোমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। খোদা নিশ্চয়ই তোমাদের দিয়ে অনেক বড় কিছু করাবেন, তাই তোমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন।