পানি বাড়তে বাড়তে একসময় তাদের পা স্পর্শ করে। বাতাসের ঝাঁপটায় সেই পানি অনেক সময় ফুঁসে উঠে তাদের উপর দিয়ে বয়ে যায়। পানিটুকু মনে হয় জীবন্ত এবং ক্রুদ্ধ। একটু পর পর প্রচণ্ড আক্রোশে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
পানিতে মাঝে মাঝেই মানুষ ভেসে যেতে থাকে। বেশিরভাগ মানুষ মৃত। মাঝে মাঝে এক দুজন জীবন্ত মানুষ পাওয়া যায়, তারা গাছটি ধরে বাঁচতে চায়। কিন্তু দুর্বল হাতে গাছটি ধরে রাখতে পারে না, পানির ঝাঁপটায় তারা ছিটকে পড়ে। বিবস্ত্র একটি মেয়ে একবার একটি ডাল ধরে ফেলে চিৎকার করতে থাকল। বিজলী তাকে ধরে গাছে তোলার আগেই মেয়েটি পানির টানে ছুটে গেল, অন্ধকারে তাকে আর দেখতে পেল না। কিন্তু বিজলীর মনে হলো মেয়েটি আমিন মোল্লার সেই কমবয়সী বউটি। যে তুফানকে সে খুব ভয় পায় সেই তুফান তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
খোকন আর বিজলী গাছের ডাল ধরে ঝুলে রইল। বাতাসের তীব্র ঝাঁপটায় মাঝে মাঝে হাত ছুটে যেতে চায়, কিন্তু তারা হাত ছাড়ল না। গাছের ডাল তাদের চাবুকের মতো আঘাত করে, বৃষ্টির পানি ধারালো বর্শার মতো তাদেরকে বিদ্ধ করে তবু তারা হাত ছাড়ল না। মাঝে মাঝেই পানি ফুঁসে উঠে তাদের ডুবিয়ে ফেলে। পানির নিচে থেকে একসময় হাঁসফাঁস করে উপরে ভেসে ওঠে, তবু তারা গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে রইল।
ভোর রাতের দিকে ঝড়ের তীব্রতা কমে আসতে থাকে। মাঝে মাঝে আকাশ চিরে আলো ঝলসে ওঠে, বজ্রপাতের শব্দে কানে তালা লেগে যায়। পায়ের নিচে ছলাৎ ছলাৎ করে পানি বয়ে যেতে থাকে। একসময় ঝড় থেমে আসে, আকাশের খোলা আলোতে চারদিকে অস্পষ্ট একটা ছবির মতো দেখায়। ধীরে ধীরে আকাশের মেঘ কেটে পূর্ণিমার ভরা চাঁদটিকে দেখা যায়। পূর্ণিমার ভরা আলোতে পানিতে ডুবে থাকা পুরো চরটিকে একটি অপার্থিব জগৎ বলে মনে হয়। চারদিকে সুনসান একটি অবিশ্বাস্য নীরবতা।
খোকন জিজ্ঞেস করল, বিজলীবু, ঝড় থেমে গেছে?
বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, না।
কেন না?
ঝড়ের ঠিক মাঝখানে এই রকম হয়। একটু পর আবার ঝড় শুরু হইব।
আবার?
হ্যাঁ। আবার।
আগের মতো?
হ্যাঁ। আগের মতো। খালি বাতাসটা এইবার উল্টাদিক দিয়া আসব।
খোকন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু আকাশে তো মেঘ নাই।
মেঘ আসব। ঝড় আসব।
বিজলী ঠিক করে চিন্তা করতে পারছিল না, সে খোকনের সাথে কথা বলছিল কিন্তু নিজেই জানে না কী বলছে, কেন বলছে? মনে হচ্ছে সবকিছু যেন তার অজান্তে ঘটে যাচ্ছে।
বিজলীর কথা সত্য হলো। দেখতে দেখতে আকাশের চাঁদ আবার মেঘে ঢেকে গেল। আবার আকাশ চিরে আলো ঝলসে উঠল, বজ্রপাতের শব্দে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে বাতাসের বেগ বাড়তে থাকল, বৃষ্টির ধারালো ফোঁটা আবার তাদের ক্ষতবিক্ষত করতে থাকল। পায়ের নিচে ক্রুদ্ধ পানি আবার ফুঁসে ফুঁসে উঠতে থাকল।
তার মাঝে খোকন আর বিজলী গাছের ডাল আঁকড়ে ঝুলে রইল। ক্লান্তিতে তাদের সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে ওঠে, তবু তারা গাছের ডাল ছাড়ল না। প্রচণ্ড ঝড়ের আঘাতে তারা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়, একসময় তাদের বোধশক্তি লোপ পেয়ে যায়। তারা বুঝতে পারে না সত্যিই তারা কি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে।
একসময় মনে হতে থাকে বেঁচে থেকে কী হবে?
তবু তারা গাছের ডাল ধরে বেঁচে রইল। কেন তারা বেঁচে রইল তারা নিজেরাও জানে না।
২. গাছ থেকে নেমে
গাছ থেকে নেমেই খোকন ভেজা কাদা মাটির উপরই শুয়ে পড়তে চাইছিল, বিজলী তাকে থামিয়ে একটু সামনে টেনে নিয়ে যায়। পুরো চরটি মনে হয় একেবারে মাটির সাথে মিশে গেছে। যেখানে তাদের বাড়ি ছিল সেখানে কিছু নেই, ভিটেটা পর্যন্ত বোঝা যায় না। আমিন মোল্লার বাড়িটাও নেই, শুধু বাড়ির ভিটেতে দুই একটা পুঁতে রাখা বাঁশ বাঁকা হয়ে আছে। বাড়ির পাশে কিছু কাঁটা গাছ, সেখানে কীভাবে জানি কিছু কাপড় ঝুলে আছে।
একটু কাছে গিয়ে বিজলী দেখল, আসলে কাপড় নয়, একজন মানুষ উল্টো হয়ে ঝুলে আছে। চোখ দুটো খোলা, সেই ভোলা চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, মানুষটার শরীরে প্রাণ নেই। প্রথমে চিনতে পারেনি এবং বিজলী হঠাৎ করে চিনতে পারল, মানুষটি আমিন মোল্লা। তাবিজ দিয়ে সে চরের সব মানুষকে বাঁচাতে চেয়েছিল কিন্তু সে নিজেকেই বাঁচাতে পারেনি। বিজলী খোকনকে এই দৃশ্যটা দেখাতে চাইছিল না, তাকে আড়াল করে সামনে টেনে নিতে থাকল কিন্তু খোকন হঠাৎ দেখে ফেলল। সাথে সাথে একধরনের অমানুষিক আতঙ্কে চিৎকার করে সে বিজলীকে জাপটে ধরে ফেলল। বিজলীও তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সামনে টেনে নিয়ে যায়, সমুদ্রের তীরে খোলা জায়গাটায় গিয়ে দুজনে ধপাস করে বসে পড়ে। খোকন সাথে সাথে বালুর উপর শুয়ে পড়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। কী করবে বুঝতে না পেরে বিজলী তাকে শক্ত করে ধরে রাখে।
কিছুক্ষণের মাঝে খোকনের কাঁপুনি থেমে গেল, সে চোখ বন্ধ করে কাৎ হয়ে শুয়ে রইল। খোকন কি ঘুমিয়ে গেছে না অজ্ঞান হয়ে গেছে বিজলী বুঝতে পারল না। বিজলী চারপাশে তাকালো, পুরো চরে কোনো বাড়িঘর নেই। বড় বড় দুই চারটি গাছ ছাড়া আর কোনো গাছও নেই। ইতস্তত মানুষ কিংবা গরু বাছুর মরে পড়ে আছে। আকাশে কয়েকটা চিল উড়ছে। যে সমুদ্রটা গত রাতে ভয়ংকর আক্রোশে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে এখন সেটি শান্ত, একটু পরপর ঢেউ এসে কূলে আছড়ে পড়ছে।