বিজলী কী করবে বুঝতে পারছিল না, মা চিৎকার করে খোদাকে ডাকছেন, বাবা হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। খোকন হাউমাউ করে কাঁদছে।
বাঁচতে হবে। বিজলী দেখল সে বিড় বিড় করে নিজেকে বলছে, যেভাবে তোক বাঁচতে হবে।
বাঁচার একটি মাত্র উপায়, কোনো একটা উঁচু জায়গায় যেতে হবে। এই চরে কোনো উঁচু জায়গা নেই, কোনো দালান নেই, বিল্ডিং নেই। উঁচু জায়গা বলতে আছে গাছ। তাদেরকে একটা শক্ত বড় গাছে উঠতে হবে। বাড়ির পেছনে যে বড় কাঁঠালগাছটা আছে সেটি হচ্ছে একমাত্র বাঁচার জায়গা।
বাতাস আর বৃষ্টির শব্দের সাথে সমুদ্রের প্রচণ্ড গর্জন, তার মাঝে বিজলী চিৎকার করে বলল, গাছে উঠতে হবে। গাছে। তাড়াতাড়ি। তাড়াতাড়ি আসো।
বিজলী খোকনের হাত ধরে উঠানে নেমে আসে, সেখানে এখন কোমর পানি। প্রচণ্ড বাতাসের মাঝে পানি ঠেলে হেঁটে যেতে যেতে সে পেছনে ফিরে তাকালো, বিজলীর কথা শুনে তার বাবা মাও পানিতে নেমে এসেছেন। বিজলী খোকনকে নিয়ে ছুটে যেতে যেতে আবার পানির ভয়ংকর গর্জন শুনতে পেল। পানির একটা ভয়াবহ দেয়াল ছুটে আসছে। বিজলী চিৎকার করে খোকনকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। গাছটার কাছে পৌঁছানোর আগে পানির ঝাঁপটা তাদেরকে আঘাত করল। দুজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়, পানির ধাক্কায় দুজনে ভেসে যেতে শুরু করেছে, বিজলী তার মাঝে খোকনকে ছাড়ল না, শক্ত করে ধরে রাখল।
পানি সরে যাবার পর বিজলী উঠে দাঁড়াল।
একটু আগে কোমর পানি ছিল, এখন সেটা বুক পানি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজলী খোকনকে দাঁড় করিয়ে এদিক-সেদিক তাকালো, আবছা আলোতে সে তার বাবা মাকে খুঁজল কিন্তু তাদের খুঁজে পেল না। চিৎকার করে ডাকল, বাবা! মা!
ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দে তার গলা চাপা পড়ে গেল, কেউ তার ডাকের উত্তর দিল না। বিজলী কী করবে বুঝতে পারছিল না, সে ভালো করে চিন্তাও করতে পারছিল না। বহু দূর থেকে সে আবার পানির গর্জন শুনতে পায়। খোকনকে ধরে সে আবার ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে, বুকসমান পানি ভেঙে ছোটা সহজ নয়, পায়ের নিচে কাঠ কুটো জঞ্জাল তার মাঝে খোকনকে টেনে কাঁঠালগাছটার নিচে পৌঁছে যায়, তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ওঠ। খোকন, গাছের উপর ওঠ।
খোকন গাছের ডালের নাগাল পায় না, বিজলী তখন তাকে ধরে উঁচু করল, খোকন ডালটা ধরে গাছে উঠে গেল। বাতাস খোনকে প্রায় উড়িয়ে নিতে চাচ্ছিল, তার মাঝে খোকন শক্ত করে গাছের ডালটা ধরে রাখল। খোকনকে উঠিয়ে দিয়ে বিজলী নিজে গাছে ওঠার চেষ্টা করল, সেও ডালটা নাগাল পায় না। যখন ভিজে গাছটা বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে ঠিক তখন আবার পানির বড় একটা ঝাঁপটা গর্জন করতে করতে ছুটে এল। পানির প্রবল স্রোতে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে, বিজলী তার সমস্ত শক্তি দিয়ে গাছটাকে আঁকড়ে ধরে রাখল। বিজলী শুনতে পেল গাছের উপর থেকে খোকন চিৎকার করছে। পানির গর্জন আর বাতাসের শব্দে সে কিছু বুঝতে পারে না। পানিটা নেমে যাবার পর বিজলী তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলে কোনোভাবে গাছের উপর উঠে পড়ল। বড় ডালটা ধরে সে মুখ হাঁ করে বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে খোকনকে বলল, আরো উপরে উঠে যা খোকন, আরো উপরে।
বাতাসে পুরো গাছটি উন্মত্তের মতো হুটোপুটি করছে। গাছের ডাল আর পাতা চাবুকের মতো তাদের শরীরে আঘাত করছে। ভিজে পুরো গাছটা পিচ্ছিল হয়ে আছে, তার মাঝে দুজন গাছের আরো উপরে উঠে গিয়ে একটা বড় ডালকে শক্ত করে ধরে রাখল। প্রচণ্ড বাতাস মনে হয় তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে, তার মাঝে দাঁতে দাঁত কামড়ে দুজনে গাছটাকে ধরে রাখে।
খোকন চিৎকার করে কিছু একটা বলছিল, কী বলছে বিজলী শুনতে পাচ্ছিল না; বাতাসের শব্দ একটু থামতেই শুনতে পেল, খোকন চিৎকার করে বলছে, বাবা কই? মা কই?
বিজলী কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না, সমুদ্রের পানি কি তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে? তারা কি কোনো কিছু ধরে কোথাও ভেসে আছে? কে উত্তর দেবে? খোকন কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থের মতো হয়ে গেল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকল, বাবা, মা–
কেউ তার কথার উত্তর দিল না। বাতাসের বেগ বাড়তেই থাকে, গাছের ডাল ভেঙে পড়ে, বিজলীর একসময় মনে হয় পুরো গাছটাই মনে হয় ভেঙে পড়বে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তাদের শরীরে এসে সুইয়ের মতো বিধতে থাকে, মনে হয় পুরো শরীর বুঝি ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে।
একটার পর একটা পানির ঝাঁপটা আসতে থাকে আর প্রত্যেকবার পানির উচ্চতা আগের থেকে আরেকটু বেড়ে যেতে থাকে। পানির স্রোত গাছে এসে আঘাত করে, পানির ঝাঁপটায় সবকিছু ভেসে যেতে থাকে।
বিজলী আকাশের দিকে তাকালো, বিচিত্র একধরনের আলোর আভায় সারা আকাশ উজ্জ্বল হয়ে আছে। তার অশরীরী আলোতে চারদিকে কেমন যেন ভৌতিক আর অলৌকিক মনে হয়। উপরে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি, নিচে পানির স্রোত। বিজলীর মনে হয় এটাই কি সত্যিকারের নরক? নাকি এটি নরক থেকেও ভয়ংকর।
পানিতে নানা কিছু ভেসে যাচ্ছে। ভাঙা ঘর বাড়ি, দরজা, কাঠ কুটো, বাক্স, হাঁড়ি পাতিল। হঠাৎ হঠাৎ কোনো গরু কিংবা বাছুর। কোনো কোনোটি এখনো বেঁচে আছে, বেশির ভাগ মৃত।
পানি আরো বাড়তে থাকে। শুধু যে পানি বাড়ছে তা নয় মনে হয় যতই সময় যাচ্ছে পানিটা বুঝি আরো ক্রুদ্ধ হয়ে ফুঁসে উঠছে। বিজলী আর খোকন গাছটার আরো উপরে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু খুব বেশি দূর উপরে উঠতে পারে না। নিচের ডালগুলো মোটা, দুজন মানুষ বসে থাকতে পারে। উপরের ডালগুলো সরু, বাতাসে সেগুলো ভয়ংকরভাবে দুলতে থাকে। যেকেনো মুহূর্তে তাদের নিয়ে ভেঙে পড়তে পারে।