হঠাৎ করে মনে হলো বাতাসের বেগ প্রচণ্ড বেড়ে গেল। পুরো বাড়িটা মনে হয় একদিকে কাৎ হয়ে যায়–সবকিছু থরথর করে কাঁপতে থাকে। ঝনঝন শব্দ করে মনে হয় আকাশ দিয়ে কিছু উড়ে গেল। বৃষ্টির ঝাঁপটায় ঝমঝম শব্দ হতে থাকে। প্রথমবার মনে হলো মানুষ চিৎকার করছে, দূর থেকে তাদের চিৎকার শোনা যেতে থাকে। গোয়ালঘরের ভেতর থেকে কালো গাইটা গলা ছেড়ে ডাকছে, মাঝে মাঝে বাছুরটার চিৎকারও শোনা যেতে থাকে।
বাবা কিছু একটা বললেন, ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দে কী বললেন শোেনা গেল না। তখন গলা উচিয়ে আবার বললেন, গাই আর বাছুরটাকে ছেড়ে দিতে হবে।
মা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন করে ছাড়বে?
দড়ি কেটে দিতে হবে। একটা দা দাও।
মা পাকঘর থেকে একটা দা এনে দিলেন। বাবা দাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, বোঝা যাচ্ছে ঝড়ের ভেতর বাইরে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। বিজলী চিৎকার করে বলল, আমাকে দাও। আমি দড়ি কেটে দিয়ে আসি।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, পারবি?
বিজলী মাথা নেড়ে বলল, পারব।
বাবার হাত থেকে দাটা নিয়ে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজাটা খুলতেই ঘরের ভেতর বাতাসের একটা ঝাঁপটা ঢুকে মনে হয় সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকে, তার মাঝে বিজলী বের হয়ে গেল। প্রচণ্ড বাতাস মনে হয় তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে, বৃষ্টির ঝাঁপটায় সে ভিজে চুপসে গেল।
বারান্দা থেকে নিচে নামতেই বৃষ্টির ঝাঁপটাটি আরো তীব্রভাবে তার শরীরে লাগতে থাকে, পানির একেকটা ফোঁটা মনে হয় সুইয়ের মতো তার শরীরে গেঁথে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে সে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করে, প্রচণ্ড বাতাসের জন্যে এগোতে পারে না। তার মাঝে মাথা নিচু করে সে কোনোভাবে এগিয়ে গেল, গোয়ালঘরের দরজাটা উড়ে গেছে, ভেতরে কালো গাই আর বাছুরটা হুটোপুটি করছে। বিজলী আবছা অন্ধকারে ভেতরে ঢুকে গেল, গাইটা কী বুঝল কে জানে বিজলীকে দেখে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বিজলী দা দিয়ে ঘষে ঘষে গাইয়ের দড়িটা কেটে দেয়, তারপর তার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, যা, যা, বাইরে যা।
গাইটা বাইরে বের হলো না, বাছুরটার দিকে তাকিয়ে গলা ছেড়ে ডাকল। বিজলী তখন বাছুরটার দড়ি কেটে দিয়ে সেটাকে ধাক্কা দিল। গাইটা এবারে গোয়ালঘরের খোলা দরজা দিয়ে বের হয়ে ডাকতে ডাকতে সামনে ছুটে যায়। পেছনে পেছনে বাছুরটা ছুটতে থাকে।
ঠিক তখন বাতাসের প্রচণ্ড একটা ঝাঁপটা ছুটে এল এবং গোয়াল ঘরটা বিচিত্রভাবে নড়ে ওঠে। সবকিছু ছিঁড়ে ছুঁড়ে যাবার একটা শব্দ হলো এবং মনে হলো বিজলী বুঝি আকাশে উড়ে যাবে। সে গোয়ালঘরের বেড়াটা খামচে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে এবং হঠাৎ করে টের পেল গোয়ালঘরের ছাদটা খুলে গেল, তারপর বিকট শব্দ করে উড়ে গেল। উপরে তাকিয়ে সে খোলা আকাশ দেখতে পায়। মনে হলো এবারে গোয়ালঘরটা পড়ে যাবে আর সে তার ভেতরে বুঝি চাপা পড়ে যাবে।
প্রচণ্ড বাতাস আর বৃষ্টির মাঝে বিজলী বের হয়ে এল। বৃষ্টির পানিতে সবকিছু কাদা হয়ে আছে, তার মাঝে পা ফেলে সে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
প্রচণ্ড বাতাসের ঝাঁপটায় সে প্রায় উড়ে যাচ্ছিল, কোনোভাবে নিজেকে রক্ষা করে সে এগিয়ে গেল। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মনে হয় তার শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে।
হঠাৎ সে একটা ভয়াবহ গর্জন শুনতে পায়, কিসের গর্জন বোঝার জন্যে সে পেছন ফিরিয়ে তাকানোর আগেই পানির একটা দেয়াল গর্জন করতে করতে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পানির ঝাঁপটায় সে মাটিতে আছড়ে পড়ে, বিজলী বুঝতে পারে তার উপর দিয়ে পানির ঢল বয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নেবার জন্যে সে কোনোভাবে উঠে দাঁড়ায়, তখন পানির ঢলটা তার উপর দিয়ে যেভাবে এসেছিল সেভাবে নেমে গেল। পুরোটা নেমে গেল না–সে দেখল তার হাঁটু পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে। স্কুলে তার স্যার যে জলোচ্ছ্বাসের কথা বলেছিলেন এটি সেই জলোচ্ছ্বাস। এই জলোচ্ছাসে সবকিছু ভাসিয়ে নেবে।
বিজলী চিৎকার করতে থাকে, পানি! পানি! পানি আসছে। বান আসছে!
সে কোনোভাবে বাড়ির দরজায় হাজির হলো, পানির ঢলটা তাদের বাড়ির ভেতরে ঢুকে সবাইকে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। যে কুপি বাতিটা জ্বলছিল সেটি অনেক আগেই নিভে গেছে। আকাশ থেকে বিচিত্র এক ধরনের আলো ছড়িয়ে পড়েছে সেই আবছা আলোতে দেখতে পেল ঘরের দরজা ধরে তার বাবা-মা দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছেন। খোকনকে সে দেখতে পেল না, ভয় পেয়ে চিৎকার করে ডাকল, খোকন! খোকন!
বাড়ির ভেতর থেকে খোকন বের হয়ে আসে, কাঁপা গলায় বলে, এই যে আমি।
বিজলী ছুটে গিয়ে খোকনকে জাপটে ধরল, বলল, পানি আসছে! পানি।
খোকন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এখন কী হবে? কী হবে এখন?
এখন কী হবে বিজলী জানে না। বাতাসের ঝাঁপটা সহ্য করে কিছু একটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। কিন্তু পানির ঝাঁপটা সহ্য করে কিছু টিকে থাকতে পারে না।
বাতাসের তীব্র একটা ঝাঁপটায় সবকিছু থরথর করে উঠল আর ঠিক তখন আগের মতো ভয়াবহ গর্জনটি শুনতে পেল। আবার পানির একটা দেয়াল তার পথে সবকিছু ভেঙেচুরে গর্জন করতে করতে একটা হিংস্র পশুর মতো ছুটে আসছে। কিছু বোঝার আগে পানির সেই বিশাল দেয়ালের আঘাতে তাদের বাড়িটা টলমল করে উঠল। পানির ঝাঁপটায় বিজলী আর খোকন নিচে পড়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত কেউ কিছু বুঝতে পারে না–পানির দেয়ালটি যেভাবে ছুটে এসেছিল ঠিক সেভাবে আবার ফিরে গেল, আগের মতো পুরোটুকু ফিরে গেল না, কোমর পর্যন্ত পানি রয়ে গেল। দেখতে দেখতে চারদিক পানিতে ডুবে যাচ্ছে।