- বইয়ের নামঃ সাইক্লোন
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ তাম্রলিপি
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. ক্লাস শেষের ঘণ্টা
বেশ কয়েক মাস আগে একজন বাবা আমার সাথে যোগাযোগ করে বললেন, তাঁর মেয়েটি আমার সাথে খুব দেখা করতে চাইছে। তারপর যেটি বললেন সেটি শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। বাবা আমাকে বললেন, মেয়েটি হাসপাতালে এবং আগামী এক-দুদিনের ভেতর সে মারা যাবে। মেয়েটি নিজেও সেটি জানে।
আমি তখন সিলেট থেকে ঢাকা এসেছি, যখন হাসপাতালে তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি তখন মনে হলো, আমার জীবনে এর চাইতে কঠিন কোনো কাজ হয়তো আর কখনো করতে হবে না।
যখন তার সাথে দেখা হবে তখন তাকে কী বলব, আমি জানতাম না। কিন্তু সেই ছোট মেয়েটি অসাধারণ বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে ছিল, তাই তার সাথে কথা বলার কাজটি খুব সহজ হয়ে গেল। আমি ভাণ করলাম সবকিছু ঠিক আছে, জীবন খুব আনন্দময় এবং সেই মেয়েটিও আমার সাথে অভিনয় করে গেল। আমরা হাসি-তামাশা করলাম, গল্প করলাম। সে কোনো এক অলিম্পিয়াডে আমার সাথে তোলা তার ছবি দেখাল। আমি নিজের কিছু বই উপহার দিলাম, সে তার বইগুলোতে আমার অটোগ্রাফ নিয়ে নিল। গল্প করে করে আমরা সময়টি কাটিয়ে দিলাম।
চলে আসার সময় আমি তার একটি বইয়ের পেছনে লিখে এলাম, সে যেন ভালো হয়ে ওঠে, আমি তাকে একটি বই উৎসর্গ করব।
মেয়েটি ভালো হয়ে ওঠেনি, দুদিন পর খবর পেয়েছি সে মারা গেছে।
মেয়েটির নাম নভেরা। আমি তাকে আমার এই বইটি উৎসর্গ করতে চাই।
নভেরা, তোমার জন্যে অনেক অনেক ভালোবাসা।
***
শেষ পর্যন্ত ঢং করে ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ল। বিজলী আশা ছেড়েই দিয়েছিল, একটু আগে তার মনে হচ্ছিল আর কোনোদিন বুঝি ঘণ্টাটা পড়বে না, ক্লাসটাও শেষ হবে না। এই ক্লাসটা অঙ্ক ক্লাস, ক্লাস নেন আজীজ স্যার–যদিও কেউ তাকে আজীজ স্যার ডাকে না। কথা বলার সময় গলার কাছে একটা রগ ফুলে যায় বলে সবাই আড়ালে তাকে রগু স্যার বলে ডাকে। রপ্ত স্যার ক্লাসে এসে বোর্ডে একটার পর একটা অঙ্ক লিখতে থাকেন। তাদেরকে সেগুলো খাতায় তুলতে হয়। পরীক্ষার আগে সেই অঙ্কগুলো মুখস্থ করতে হয়। এই অঙ্কগুলো থেকে কয়েকটা অঙ্ক পরীক্ষায় আসে, পরীক্ষার খাতায় দাড়ি-কমাসহ সেগুলো মুখস্থ লিখে দিয়ে আসতে হয়। যারা রপ্ত স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে তাদেরকে রপ্ত স্যার আগে থেকে বলে দেন পরীক্ষায় কোন কোন অঙ্কটা দেবেন। তাদের বেশি অঙ্ক মুখস্থ করতে হয় না, যেগুলো পরীক্ষায় আসবে শুধু সেগুলো মুখস্থ করলেই হয়। পরীক্ষাতেও তারা বেশি নম্বর পায়। বিজলী কোনো স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে না। প্রাইভেট পড়তে যে টাকার দরকার তার সে টাকা নাই। টাকা থাকলেও কোনোদিন তাকে বাবা-মা সেই টাকা দেবেন না। সত্যি কথা বলতে কী অনেক চেষ্টাচরিত্র করে স্কুল থেকে তার টিউশন ফ্রি করা হয়েছে বলে সে স্কুলে আসতে পারছে। যদি কোনোদিন তার টিউশন ফি আবার দিতে হয় সাথে সাথে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে।
ঘণ্টা পড়ার পর অঙ্ক স্যার চক ডাস্টার নিয়ে ক্লাস থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই ক্লাসের ছেলেমেয়েরা নিজেদের ভেতরে কথা বলতে শুরু করে। তাদের দেখে মনে হয় একটা ঘণ্টা কথা বলতে না পেরে তাদের বুকটা বুঝি ফেটে যাচ্ছিল। বিজলী চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। জানালার পাশে এই সিটটা তার খুব প্রিয়, আগে আসতে পারলে সে সব সময় এই সিটটা দখল করে নেয়। এখানে বসে বাইরে তাকালে দূরে সমুদ্রটা দেখা যায়। ছেলেমেয়েরা যদি কথা বন্ধ করে তাহলে সমুদ্রের গর্জনটাও আবছাভাবে শোনা যায়। সমুদ্রের এই চাপা গর্জনটা শুনে বিজলী সব সময়েই বুকের ভেতর ফাঁকা ফাঁকা অনুভব করে, তার কারণটা কী কে জানে? ভাটা শুরু হয়েছে, বিজলী এখানে বসেই দেখতে পায় সমুদ্রের পানি নিচে নামতে শুরু করেছে, গাংচিলগুলো আকাশে উড়ছে। পানি নেমে যাওয়ার পর শামুক কাঁকড়া বের হতে শুরু করেছে আর গাংচিল সেগুলো খাওয়ার জন্যে ভিড় করে এসেছে।
ক্লাসের ছেলেমেয়েদের কথা হঠাৎ করে থেমে গেল, বিজলী মাথা ঘুরিয়ে দেখল তাদের বিজ্ঞান স্যার ক্লাসে ঢুকছেন। এই স্যার নতুন এসেছেন, তাই এখনো তার কোনো নাম দেয়া হয়নি। সবাই স্যারের নাম অনুযায়ী শ্যামল স্যার বলে ডাকে। বিজলীর যতগুলো ক্লাস করতে হয় তার মাঝে এই ক্লাসটা সবচেয়ে প্রিয়। স্যার একটা কিছু পড়াতে শুরু করে সেখান থেকে অন্য কিছুতে চলে যান, সেখান থেকে আবার অন্য কিছুতে চলে যান, তারপর হঠাৎ করে থেমে গিয়ে মাথা চুলকে বলেন, তোমাদের কী যেন পড়াচ্ছিলাম? স্যার কী পড়াচ্ছিলেন সেটা বলে দিলে স্যার তখন আবার সেখান থেকে পড়াতে শুরু করেন। তবে বিজলীর অবশ্যি বইয়ের পড়া থেকে স্যারের উলটাপালটা গল্পগুলো শুনতেই বেশি ভালো লাগে।
শ্যামল স্যার চক ডাস্টার টেবিলের উপর রেখে হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকালেন। দূরে সমুদ্রটার দিকে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, সমুদ্রটা কী সুন্দর দেখেছ?
স্যারের কথা শুনে সবাই জানালাটা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকালো। ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে সমুদ্রের ধারেকাছে থাকে, তারা প্রত্যেক দিন সমুদ্রটাকে দেখে। যে জিনিস প্রত্যেক দিন দেখতে পায় সেটা আসলেই সুন্দর কি না সেটা মনে হয় কেউই ঠিক করে বুঝতে পারে না। শ্যামল স্যার বাইরে থেকে এসেছেন, তাই সমুদ্র দেখে এরকম মুগ্ধ হয়ে যান।