কয়েকদিন পর মেকু টের পেল কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে আম্মা খানিকটা অস্থির হয়ে আছেন। একটু পরে পরে টেলিফোন এসে, আম্মা সেই টেলিফোনে কথাবার্তা বলতে বলতে মাঝে মাঝে চেঁচামেচি করেন, তারপর টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে মাথার চুল টানাটানি করেন। ব্যাপারটা কী মেকু ঠিক বুঝতে পারে না, তবে তার নিজের জন্মের সাথে কিছু একটা সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়। একদিন আব্বা আর আম্মার মাঝে ব্যাপারটা নিয়ে লম্বা একটা আলোচনা হল তখন মেকু খানিকটা বুজতে পারল। আব্বা বললেন, “শানু, আমাদের মেকুর জন্ম হয়েছে এখনো এক মাস হয় নি এর মাঝে তুমি যদি তোমার অফিসের কাজ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে শুরু কর তা হলে তো হবে না।’
আম্মা মাথা নেড়ে বললেন, “আমি দুশ্চিন্তা শুরু করি নি। আমি এখন ছুটিতে আছি। কিন্তু আমাকে পনের মিনিট পরে পরে টেলিফোন করলে আমি কী করব?”
“তুমি টেলিফোন ধরবে না। তুমি বলবে তুমি ছুটিতে।”
আম্মা একটা নিশ্বাস ফেলেল বললেন, “এমন এক একটা সমস্যা নিয়ে ফোন করে যে না করতে পারি না।”
“তোমাকে না করতে শিখতে হবে।”
আম্মা অনেকটা নিজের মনে বললেন, “এত বড় একটা প্রজেক্ট সেটার উপরে এত মানুষের রুজি রোজগার নির্ভর করছে, সেটা তো এভাবে নষ্ট করা ঠিক না।”
আব্বা বললেন, “নষ্ট কেন হবে? অন্যেরা প্রজেক্ট শেষ করবে।”
আম্মা মাথা নেড়ে বললেন, “পারছে না তো! বুঝেছ হাসান, এটা মানুষকে নিয়ে প্রজেক্ট, মানুষকে দিয়ে কাজ করার প্রজেক্ট এটা সবাই পারে না। মানুষ তো যন্ত্রপাতি না যে সুইচ টিপলেই কাজ করে। এমন একটা সময়ে মেকুর জন্ম হল আর আমি বাসায় আটকা পড়ে গেলাম।”
শুনে মেকুর একটু মন খারাপ হয়ে যায়, সত্যিই তো আরো কয়দিন পরে জন্ম নিলে কী ক্ষতি হত? সেটা কী কোনোভাবে ব্যবস্থা করা যেত না?
পরের দিন আব্বাকে ডেকে আম্মা বললেন, “আমি একটা জিনিস ঠিক করেছি।”
“কী জিনিস?”
“কয়েক ঘণ্টার জন্যে অফিসে যাব।”
আব্বা চোখ কপালে তুলে বললেন, “অফিসে যাবে? আর মেকু?”
“আমার পরিচিত একজন মহিলা আছে তাকে বলব বাসায় এসে থাকতে। মেকুকে দেখতে।”
আব্বা ভয়ে ভয়ে বললেন, “সেই মহিলা কী পারবে? মনে আছে মেকু জোড়া পায়ে কেমন লাথি দিয়েছিল তোমার চাচিকে?”
আম্মা ইতস্তত করে বললেন, “পারবে কী না এখনো জানি না। কিন্তু চেষ্টা করে দেখি। যদি রাখতে পারে তা হলে আমি মাঝে মাঝে অফিসে যাব।”
আব্বা মাথা নেড়ে বললেন, “এর চাইতে আমি বাসায় থাকি। অপরিচিত একজন থেকে আমি ভালো পারব।”
আম্মা হেসে বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই অনেক ভালো পারবে কিন্তু সেটা তো সমাধান হল না। তোমার ইউনিভার্সিটি ক্লাস সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে বাসায় বসে থাকবে?”
আম্মা মাথা চুলকে বললেন, “ ইউনিভার্সিটির যে অবস্থা যে কোনো সময় সেটা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। সেখানে খালি স্লোগান আর মিছিল।”
“কিন্তু এখনো তো আর বন্ধ হয় নি। আগে বন্ধ হোক, তারপর দেখা যাবে।”
কাজেই পরদিন মেকু আবিষ্কার করল পাহাড়ের মতো বিশাল এক মহিলা তাকে দেখে শুনে রাখতে এসেছে। আম্মা সবকিছু দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “আমার মেকু খুব বুদ্ধিমান ছেলে, দেখবেন কোনো সমস্যা হবে না।”
পাহাড়ের মতো মহিলা বললেন, “আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ছোট বাচ্চা আমি খুব ভালো দেখতে পারি।”
আম্মা বললেন, ভেরি গুড। আমি তিন ঘণ্টার মাঝে চলে আসব। মেকুকে ভালো করে খাইয়ে দিয়েছি। খিদে লাগার কথা না। তারপরেও যদি লাগে ফ্রিজে দুধ তৈরি করে রাখা আছে। একটু গরম করে –”
মহিলা বাধা দিয়ে বললেন, আমাকে বলতে হবে না। আমি সব জানি। কত বাচ্চা মানুষ করেছি।”
আম্মা বললেন, “তবু বলে রাখছি। বেশি গরম করবেন না। হাতের চামড়ায় লাগিয়ে দেখবেন বেশি গরম হল কি না। মেকু সাধারণত কাপড়ে বাথরুম করে না। যদি তবুও করে ফেলে তা হলে এই কাবার্ডে শুকনো ন্যাপি আছে –”
মহিলা আবার বাধা দিয়ে বললেন, “আমাকে বলতে হবে না। আমি সব জানি। আমি কত বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করেছি।”
“তবু সব কিছু শুনে রাখেন। এই যে আমার অফিসের টেলিফোন নাম্বার। কোন ইমারজেন্সি হলে ফোন করবেন।”
মহিলা হাত নেড়ে বলল, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি এসব জানি।”
আম্মা বললেন, “আপনার যদি খিদে লাগে, কিছু খাওয়ার ইচ্ছা করে ফ্রিজে খাবার আছে -।”
পাহাড়ের মতো মহিলার চোখ দুটি হঠাৎ করে এক শ ওয়াট লাইট বাল্বের মতো জ্বলে উঠল। সুড়ুৎ করে মুখে লোল টেনে বললেন, “কোথায় ফ্রিজটা? কত বড় ফ্রিজ? কত সি.এফ.টি.?”
আম্মা কিছু বলার আগেই পাহাড়ের মতো মহিলা কুকুর যেভাবে গন্ধ শুঁকে শুঁকে হাড় বের করে ফেলে অনেকটা সেভাবে পাশের ঘরে গিয়ে ফ্রিজটা বের করে ফেললেন। তারপর একটান দিয়ে ফ্রিজের দরজাটা খুলে বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে আম্মার দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসলেন। ফ্রিজের ভেতর রাখা খাবার গুলি দেখে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বললেন, মোরগের মাংস, চকলেট কেক, মুড়িঘণ্টা, পাউরুটি, পুডিং, ডাল, সব্জি, কোল্ড ড্রিংস, দই – আ হা হা হা!”
আম্মা কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন মহিলা বাধা দিয়ে বললেন, “আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমার কোনো অসুবিধা হবে না। তিন ঘণ্টা কেন, দরকার হলে আপনি ছয় ঘণ্টা পরে আসেন।”
মাকু লক্ষ্য করল আম্মা চলে যাবার পর পরই মহিলা একটা থালায় চার টুকরা চকলেট কেক, এক খাবলা দই এবং দুইটা মুরগির রান নিয়ে সোফায় বসে টেলিভিশনটা চালিয়ে দিলেন। মেকু জানে তাদের বাসায় একটা টেলিভিশন আছে কিন্তু সেটাকে কখনোই খুব বেশি চালাতে দেখে নি। টেলিভিশনে মোটা মোটা মহিলারা শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে নাচতে লাগল আর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর মোটা মোটা গোঁফ ওয়ালা মানুষেরা প্রচণ্ড মারপিট করতে লাগল, সেটা দেখতে দেখতে পাহাড়ের মতো মহিলা খেতে লাগলেন। খাওয়া শেষ হলে মহিলা আবার গিয়ে ছয় টুকরো পাউরুটি, আধাবাটি মুড়িঘণ্ট আর বড় এক গ্লাস কোল্ড ড্রিংস নিয়ে বসলেন। সেটা শেষ হবার পর দুইটা বড় বড় কলা আর ছয়টা টোস্ট বিস্কুট খেলেন। তারপর টেলিভিশন দেখতে দেখতে সোফায় মাথা রেখে বাঁশির মতো নাক ডাকতে ডাকতে ঘুমিয়ে গেলেন।
মেকু মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। তার আম্মা যদি এই পাহাড়ের মতো মহিলার হাতে তাকে প্রত্যেক দিন রেখে যান তা হলে বড় বিপদ হবে। মেকুকে প্রত্যেক দিন তাকিয়ে তাকিয়ে মহিলার এই রাক্ষুসে খাওয়া দেখতে হবে। মহিলাকে রাখা হয়েছে মেকুকে দেখে শুনে রাখার জন্য কিন্তু তিনি একবারও তার খাওয়া ছেড়ে এসে মেকুকে দেখেন নি। মেকুর যদি এখানে কোনো বিপদ হত, কিংবা কোনো ছেলেধরা এসে জানালার গ্রিল কেটে তাকে চুরি করে নিয়ে যেত তা হলেও এই মহিলা টের পেতেন না। মহিলা টেলিভিশন চালু করে রেখেছেন মেকুকে সবকিছু শুনতে হচ্ছে আর দেখতে হচ্ছে। কোন সাবার মাখলে গায়ের চামড়া নরম হয়, কোন টুথপেস্ট নিয়ে দাঁত মাজলে দাঁত চকচক করে, কোন পাওডার গায়ে দিলে শরীরে ঘামাচি হয় না মেকুর মুখস্ত হয়ে গেছে। মুখস্ত হয়ে যাওয়া জিনিস বারবার শুনলে মাথার ভিতরে সবকিছু জট পাকিয়ে যায়। কাজেই মেকু সিদ্ধান্ত নিল পাহাড়ের মতো এই মহিলাকে ঘর ছাড়া করতে হবে।
মেকু আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তার কাজ শুরু করে দিল। বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে সে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দিল। সেই চিৎকার এতই ভয়ংকর যে পাহাড়ের মতো মহিলা চমকে উঠে লাফ দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে টেবিলসহ হুড়মুড় করে নিচে আছাড় খেয়ে পড়লেন। টেবিলের উপর রাখা থালা, বাসন, গ্লাস সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। পাহাড়ের মতো মহিলা কোনো মতে উঠে দাঁড়িয়ে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে মেকুর কাছে এসে হাজির হলেন। মেকু আরো একবার বাঁকা হয়ে গলা ফাটিয়ে দ্বিতীয়বার চিৎকার দিল। মহিলা কী করবে বুঝতে না পেরে হাত বাড়িয়ে মেকুকে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। মেকু হাত পা ছুঁড়তে থাকে এবং মহিলা তার মাঝে সাবধানে কোনো মতে হাচড় পাচড় করে তাকে কোলে তুলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। মহিলা নেংচাতে নেংচাতে ফ্রিজের কাছে ছুটে গেলেন, দরজা খুলে মেকুর দুধের শিশি বের করে সেটা তার মুখে ঠেসে ধরার চেষ্টা করেন। মেকু শান্ত হয়ে যাবার ভান করে দুধ টেনে মুখ ভর্তি করে পুরোটা মহিলার মুখে কুলি করে দিল। তারপর আবার বাঁকা হয়ে ভয়ংকর চিৎকার শুরু করে দিল। দুধে মহিলার চোখ মুখ ভেসে গেল এক হাতে চোখ মুছে মহিলা কোনোভাবে মেকুকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। ছোট শিশুকে হয়তো কোনোভাবে শান্ত করা সম্ভব কিন্তু যে পণ করেছে শান্ত হবে না তাকে শান্ত করবে সেই সাধ্যি কার আছে?
মহিলা কী করবে বুঝতে না পেরে দুধের শিশিটা দ্বিতীয়বার তার মুখে লাগালেন, মেকুও শান্ত হয়ে মুখ ভরে দুধ টেনে নিয়ে আবার মহিলার মুখে কুলি করে দিল। মহিলা চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না, চোখ বন্ধ করে হাঁটতে গিয়ে নিচে পড়ে থাকা টেবিলে পা বেঁধে হঠাৎ হুড়মুড় করে পড়ে গেলেন। দুই হাতে মেকুকে ধরে রেখেছিলেন – তাকে বাঁচাবেন না নিজেকে রক্ষা করবেন চিন্তা করতে করতে দেরি হয়ে গেল, মেকুকে নিয়ে তিনি ধড়াস করে আছাড় খেয়ে পড়লেন, হাত থেকে মেকু পিছলে বের হয়ে পাশে গড়িয়ে পড়ল। তার বিশাল দেহ নিচে পড়ে যে শব্দ করল তাতে মনে হল পুরো বিল্ডিং বুঝি কেঁপে উঠেছে।
ঠিক এরকম সময় আম্মা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন, প্রথমেই তিনি আবিষ্কার করলেন মেকুকে, সে মেঝেতে উপুর হয়ে শুয়ে চোখ বড় বড় করে তার পাশেই পড়ে থাকা পাহাড়ের মতো মহিলাটিকে দেখছে। আম্মা ছুটে গিয়ে মেকুকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন – তার কাছে মনে হল ঘরটির মাঝে রিক্টর স্কেলে আট মাত্রার একটা ভূমিকম্প ঘটে গেছে। সোফার টেবিলটা ঠিক মাঝখানে ভেঙে দুই টুকরা হয়ে গেছে। চারপাশে ভাঙা কাচের গ্লাস, থালা বাসন এবং বাটি। বাচ্চার দুধের শিশি ভেঙে দুধ ছড়িয়ে আছে। পাহাড়ের মতো বিশাল মহিলা উপুড় হয়ে পড়ে আছে, বেকায়দায় পড়ে গিয়ে কপালের কাছে ফুলে একটা চোখ প্রায় বুজে গিয়েছে। আম্মা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে এখানে?”
মহিলাটি হামাগুড়ি দিয়ে উঠার চেষ্টা করে আবার ধপাস করে পড়ে গেলন। আম্মা তখন ঘুরে মেকুর দিকে তাকালেন, তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “মেকু, তুই করেছিস?”
মেকু কোনো কথা না বলে তার মায়ের চোখের দিকে অপরাধীর মতো তাকিয়ে রইল। আম্মা হতাশভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “মেকু। কাজটা কিন্তু একটুও ভালো করিস নি!”
মেকু তার মাড়ি বের করে হাসল – তার ধারণা অন্যরকম।
সন্ধেবেলা খেতে বসে আবিষ্কার করা হল ফ্রিজে কোনও খাবার নেই সেটা ধু ধু ময়দান। পাহাড়ের মতো মহিলা সেটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেছেন। আম্মা একটু ভাত ফুটিয়ে দুটি ডিম ভেজে নিয়ে আব্বাকে নিয়ে খেতে বসলেন। খেতে খেতে তাদের ভেতর যা কথাবার্তা হল মেকু সেটা কান পেতে শুনল। আব্বা বললেন, “তোমার পরিকল্পনাটা তা হলে মাঠে মারা গেল?”
“শুধু মাঠে না, মাঠে-ঘাটে খালে বিলে মারা গেল।”
“বাসার ভিতরে মনে হয়েছে টর্নেডো হয়েছে। ব্যাপারটা কী?”
আম্মা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “তুমি যখন দেখেছ তখন তো আমি পরিষ্কার করে এনেছি। আমি যখন দেখেছি তখন যা অবস্থা ছিল!” আম্মা দৃশ্যটা কল্পনা করে একবার শিউরে উঠলেন।
“কেউ যে ব্যাথা পায় নি সেটাই তো বেশি।”
“কে বলেছে কেউ ব্যাথা পায় নি? সে মহিলা তো ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে বাসায় ফিরে গেল। দুজনে মিলে টেনে রিক্সায় তুলতে হয়েছে।”
আব্বা চিন্তিত মুখে বললেন, “ব্যাপারটা কী হয়েছিল আমাকে বুঝিয়ে বলবে?”
“আমি জানলে, তা হলে তো তোমাকে বলব! অনুমান করছি আমাদের মেকুর কাণ্ড। মেকু কোনো কারণে মহিলাকে অপছন্দ করেছে, ব্যাস!”
“এই টুকুন মানুষ এরকম পাহাড়ের মতন একজন মহিলাকে এভাবে নাস্তানাবুদ করে কীভাবে?”
আম্মা চিন্তিত মুখে বললেন, “সেটাই তো আমার চিন্তা! এই ছেলে বড় হলে কী হবে?”
আব্বা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তা হলে আমি ধরে নিচ্ছি এখন তোমার মাঝে মাঝে অফিসে যাওয়ার পরিকল্পনাটা বন্ধ?”
আম্মা মাথা নাড়লেন, “উঁহু।”
“মানে?”
“আজকে অফিসে গিয়ে আমার মাথা ঘুরে গেছে। পুরো প্রজেক্টের অবস্থা কেরোসিন। কিছু একটা করা না হলে সব শেষ হয়ে যাবে তখন স্যালাইন দিয়েও বাঁচানো যাবে না।”
আম্মা চিন্তিত মুখে বললেন, “তা হলে কী করবে বলে ঠিক করেছ?”
“কাল থেকে নিয়মিত অফিসে যাব।”
আব্বা আঁতকে উঠে বললেন, “আর মেকু?”
আম্মা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “মেকুকে তো আর বাসায় একা একা রেখে যেতে পারব না। তাকেও নিয়ে যাব অফিসে?”
আব্বা খানিকক্ষণ মুখ হাঁ করে আম্মার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, “তুমি এত বড় সফটওয়ার কোম্পানির একটা প্রজেক্ট ডিরেক্টর তুমি একটা গ্যাদা বাচ্চাকে বগলে ঝুলিয়ে অফিসে যাবে? বোর্ড অফ ডিরেক্টরের মিটিঙয়ের মাঝখানে মেকু শরীর বাঁকা করে চিৎকার করে উঠবে তখন তুমি তাকে দুধ খাওয়াবে?”
আম্মা গম্ভীর মুখে বললেন, “সেটাই যদি একমাত্র সমাধান হয়ে থাকে তা হলে তো সেটাই করতে হবে।” তারপর এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, “আর আমার মেকু কখনোই বোর্ড অফ ডিরেক্টরের মিটিঙয়ের মাঝখানে বাঁকা হয়ে চিৎকার করবে না।”
আব্বা আর কিছু বললেন না। চোখ বড় বড় করে আম্মার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেকু বিছানায় শুয়ে হাত শুন্যে ছুঁড়ে দিয়ে মনে মনে বলল, “ইয়েস!”
পরদিন সবাই দেখল আম্মা এক হাতে তার ব্যাগ এবং অন্য হাতে বগলের নিচে মেকুকে ধরে অফিসে গিয়ে ঢুকলেন। অফিসের এক কোণায় একটা চাদর বিছিয়ে সেখানে মেকুকে ছেড়ে দেওয়া হল, তার চারিদিকে বই এবং ফাইল রেখে একটা দেওয়ালের মতো করে দেওয়া হল যেন সে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে না পারে। এক মাসের বাচ্চারা সাধারণত নিজে থেকে বেশি নাড়াচাড়া করতে পারে না, কিন্তু মেকুকে কোনো বিশ্বাস নেই। মেকু তার জায়গায় শুয়ে শুয়ে দুই হাতে পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা টেনে এনে মুখে পুরে চুষতে চুষতে আম্মার কাজ কর্ম দেখতে লাগল। আম্মাও মেকুকে নিয়ে সব দুশ্চিন্তা ভুলে কাজ শুরু করে দিলেন।
আম্মা যে কয়দিন ছিলেন না তখন কাজকর্ম কোনদিকে গিয়ে সমস্যাটা তৈরি হয়েছে সেটা বোঝার জন্যে পুরোনো কাগজপত্র ঘাটতে লাগলেন। যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাদের ডেকে কথা বলতে লাগলেন। হই চই চেঁচামেচি দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল এবং কিছুক্ষণের মাঝে পুরো অফিসে একটা নতুন ধরনের জীবন ফিরে এল।