দুদিন পর মেকুকে দেখতে এলেন তার বড় মামা। সাথে এলেন মামি আর তার দুই ছেলে মেয়ে। বড় ছেলের নাম সুমন বয়স দশ। ছোট জনের নাম লিপি বয়স চার। ছোট বাচ্চাকে নিয়ে যেসব আহা উঁহু করতে হয় সবকিছু করে বাচ্চাকে তার বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই বসার ঘরে বসে চা খাচ্ছে তখন বড় মামার ছোট মেয়ে লিপি বলল, “ফুপু, আমি মেকুর সাথে খেলি?”
মামি বললেন, “কেমন করে খেলবি মা? মেকু তো অনেক ছোট।”
মামা বললেন, “এখন মেকু শুধু তিনটা কাজ করে। একটা হচ্ছে খাওয়া আরেকটা হচ্ছে ঘুম, আরেকটা হচ্ছে – ”
মামার বড় ছেলে সুমন ঠোঁট উলটে বলল, “বাথরুম!”
লিপি বলল, “তা হলে আমি কাছে বসে থাকি?”
মামি একটু সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললেন, “জ্বালাতন করবি না তো?”
লিপি মাথা নেড়ে বলল, “না মা । একটুও জ্বালাবো না। খালি দেখব।”
“কী দেখবি?”
লিপি হেসে বলল, ছোট বাবু দেখতে আমার ভালো লাগে আম্মু। একেবারে পুতুলের মতো। যাই, দেখি?”
“যা।”
লিপি তখন মেকুকে দেখতে গেল। মেকু বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার হাতটা ব্যাবহার করে শিখছিল, একটা আঙুল সোজা করে রেখে অন্য হাত দিয়ে সেটা ধরে ফেলার চেষ্টা করে। এমনিতে মনে হয় কী সোজা কিন্তু মেকুর জান বের হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই হাতের মাঝে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আসছে না। লিপি মেকুর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে তাকে লক্ষ্য করে বলল,
“ইশ! এই বাবুটাকে কী আদর লাগে!”
মেকুর একটু লজ্জা লজ্জা লাগে, একটা ছোট বাচ্চার সামনে সে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে কিছু করতে পারছে না, বাচ্চাটা তাকে এমনভাবে দেখছে যেন সে একটা দর্শনীয় জিনিস। লিপি মেকুর বিছানা ঘিরে রাখা রেলিং ধরে তাকে বলল,
“এই বাবু তোমার নাম কী? বল তোমার নাম কী? বল। বল না।”
মেকু মাথা ঘুরিয়ে লিপিকে দেখার চেষ্টা করল, লিপির চোখে চোখ পড়তেই সে হাত নেড়ে একটু হেসে দেয়। লিপি আবার হাসিমুখে কথা বলার চেষ্টা করে,
“বাবু। এই বাবু , তুমি কথা বল না কেন?”
মেকু কিছু বলল না। লিপি তখন মুখ সুচালো করে মেকুকে আদর করার চেষ্টা করতে থাকে, “কুচু কুচু বুগু বুগু ওরে ওরে ওরে –”
মেকু আর সহ্য করতে পারল না হঠাৎ করে বলে বসল, “আমাকে জ্বালিও না বলছি – ” বলেই সে চমকে উঠে, সর্বনাশ! এখন এই বাচ্চাটি চিৎকার করে সবাইকে বলে দেবে। মেকু নিঃশ্বাস বন্ধ করে লিপির দিকে তাকিয়ে রইল কিন্তু লিপি চিৎকার করে উঠল না, বরং ভুরু কুচকে বলল, “কে বলছে আমি তোমাকে জ্বালাচ্ছি? আমি তোমাকে আদর করছি না?” বলে সে আবার আদর করার ভঙ্গি করে বলল, “কুচু কুচু কুচু বুগু বুগু বুগু ওলে ওলে ওলে – ”
মেকু খুব সাবধানে তার বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দেয়, এই বাচ্চাটা তার কথা বলাটা খুব সহজভাবে নিয়েছে। একটুও অবাক হয় নি। ছোট বাচ্চারাই ভালো, সব কিছু সহজ ভাবে নিতে পারে, এটা যদি একটা বড় মানুষ হত তা হলে এতক্ষণে চিৎকার করে হই চই করে একটা কেলেংকারী করে ফেলত।
লিপি আরো কিছুক্ষণ অর্থহীন শব্দ করে মেকুকে আদর করে বলল,
“তোমার নাম কী বাবু?”
মেকু ভয়ে ভয়ে বলল, “মেকু।”
“মেকু! ইশ তোমার নামটা শুনলে কী আদর লাগে।”
মেকু সাবধানে আবার একটা নিশ্বাস ফেলল, এই প্রথম একজনকে পাওয়া গেল যে তার নামটাকে পছন্দ করেছে।
লিপি রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মেকুকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে বলল,
“তুমি আমার সাথে খেলবে?”
মেকু বলল, “কেমন করে খেলব? দেখছ না আমি ছোট। শুধু শুয়ে থাকতে হয়।”
লিপি গম্ভীর মুখে বলল, “ও।” একটু পড়ে বলল, “তা হলে শুয়ে শুয়েই খেলি?”
“শুয়ে শুয়ে কেমন করে খেলে?”
“ওই যে হাচুতানী খেলাটা?”
“হাচুতানী খেলাটা কেমন করে খেলে?”
লিপি চোখ বড় বড় করে বলল, “আমি বলব হাচুতানী হাচুতানী, সামনে পিছে হাচুতানী, ডাইনে বামে হাচুতানী – তারপর আমি তোমার কান ধরব।”
“কান ধরবে?”
“হ্যাঁ তারপর তুমি আমার কান ধরবে। তারপর আমরা কান ধরে টানাটানি করব। কী মজা হবে!”
মেকু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমি তো ছোট, আমি কানও ধরতে পারি না।”
লিপি এবারে খানিকটা অভিমান নিয়ে বলল, “তুমি দেখি কিছুই করতে পার না –”
মেকু উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু বলল না, হঠাৎ করে দেখতে পেল বসার ঘর থেকে সবাই হেঁটে হেঁটে আসছে। বড় মামা লিপিকে জিজ্ঞেস করলেন, “লিপি সোনামণি, তুমি কী করছ?”
“কথা বলছি আব্বু।”
“কার সাথে কথা বলছ?”
“মেকুর সাথে।”
“মেকুর সাথে কী নিয়ে কথা বলছ লিপি?”
“এই তো কেমন করে হাচুতানী খেলব সেটা বলেছি।”
বড় মামা হাসি হাসি মুখে বললেন, “মেকু কী বলেছে?”
“মেকু বলেছে সে ছোট তাই সে কান ধরতে পারবে না।”
“তাই বলেছে?”
“হ্যাঁ আব্বু। মেকু সব কথা বলতে পারে।”
বড় মামা হাসি হাসি মুখে বললেন, “নিশ্চয়ই পারে। পারবে না কেন?”
লিপির বড় ভাই সুমন হাসি চেপে বলল, “লিপি, মেকু কি উড়তে পারে?”
লিপি একটু রাগ হয়ে বলল, “মেকু উড়বে কেমন করে? মেকু কি পাখি?”
লিপির আম্মু সুমনকে ধমক দয়ে বললেন, “কেন ওকে জ্বালাতন করছিস?” তারপর ঘুরে লিপিকে বললেন, “আয় লিপি আজ বাসায় যাই।”
লিপি মেকুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আরেকদিন এসে তোমার সাথে খেলব। ঠিক আছে?”
মেকু চুপ করে রইল, তার চারপাশে এত মানুষ সে কোনো কথা বলার ঝুঁকি নিল না। সুমন বলল, “কী হল লিপি, তোর মেকু কথা বলছে না কেন?”
লিপির আম্মা বললেন, “আহ সুমন! কেন জ্বালাতন করছিস মেয়েটাকে?”
সুমন বলল, “ওকে সত্যি মিথ্যা শিখতে হবে। প্রত্যেকদিন রাতে উঠে বলে ওর টেডি বিয়ার ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিয়েছে। এখন বলছে মেকু ওর সাথে গল্পগুজব করছে। আরেকদিন বলবে সে উড়তে পারে। আরেকদিন বলবে –”
বড় মামা বললেন, “আহ সুমন। এটা মিথ্যা কথা না। এটা হচ্ছে ওর কল্পনার জগৎ!”
সুমন বলল, “কল্পনার জগৎ না হাতী!”
মেকু শুয়ে শুয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কাউকে যদি জানাতেই না পারে টা হলে তার এই কথা বলার ক্ষমতা দিয়ে সে কী করবে?”