কাজের মহিলাটা মেকুর গাল টিপে দিয়ে পেটে খানিকক্ষণ সুড়সুড়ি দিন এবং মেকু অনেক কষ্ট করে সেটা সহ্য করল। তখন মহিলাটি মেকুকে ছেড়ে দিয়ে কাজ করতে শুরু করল, ঘরের আসবাবপত্র মুছতে মুছতে আম্মার ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে মহিলাটা কাজ বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে শুরু করে। নানা রকম ভঙ্গি করে আয়নার সামনে দাঁড়ায় শাড়িটা নানাভাবে পেঁচিয়ে পরে শরীর বাঁকা করে দাঁড়াল। তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিল থেকে আম্মার পাওডার নিয়ে নিজের মুখে, গলায়, শরীরে ঢালতে থাকে। একটা ক্রিম নিয়ে মুখে মেখে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজেকে পরীক্ষা করে দেখে। মেকু অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখল। কাজের মহিলাটা তখন একটু পারফিউম নিয়ে কানের লতিতে লাগাল। সেটাও মেকু সহ্য করল। কিন্তু মহিলাটা যখন ড্রেসিং উপর থেকে আম্মার লিপস্টিকটা নিয়ে নিজের ঠোটে ঘষতে থাকে তখন সে আর সহ্য করতে পারল না, ধমক দিয়ে বলল, “কী হচ্ছে? কী হচ্ছে ওখানে?”
কাজের মহিলাটি এত জোরে চমকে উঠল যে তার হাতের ধাক্কায় পাউডারের কৌটা আর ক্রিমের শিশি নিচে পড়ে যায়। সে ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে চারিদিকে তাকাল, কে ধমকে উঠেছে সে বুঝতে পারে না। গলার স্বরটি যে মেকু থেকে আসতে পারে সেটা তার একবারও মনে হয় নি। চারিদিকে তাকিয়ে কাউকে না দেখে সে আবার লিপস্টিকটা নিয়ে নিজের ঠোটে লাগাতে শুরু করে তখন মেকু আবার গর্জন করে উঠে বলল, “ভালো হবে না কিন্তু ”
কাজের মহিলাটি এবারে একটা আর্ত চিৎকার করে ফ্যাকাসে মুখে ঘুরে তাকাল, মেকু তখন আবার ধমক দিয়ে বলল, “লিপস্টিক লাগাবেন না, ভালো হবে না কিন্তু ”
মহিলাটি সাথে সাথে লিপস্টিকটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে দেয়। তার হাত থেকে মোছার কাপড় নিচে পড়ে যায়। সে গলায় হাত দিয়ে নিজের একটা তাবিজ বের করে তাবিজটা চেপে ধরে বিড় বিড় করে সুরা পড়তে থাকে। ভয়ে তার হার্টফেল করার অবস্থা হয়ে যায়। মেকু তখন কঠিন গলায় বলল, “ আবার করলে আমি বলে দেব কিন্তু ”
মেকুর কথা শেষ হবার আগেই কাজের মহিলা সবকিছু ফেলে দিয়ে ছুটে যায়। নিজের বিছানায় শুয়ে মেকু শুনতে পেল ঘরের দরজায় ধাক্কা খেয়ে সে একটা আছাড় খেল, সেই অবস্থায় বাইরের দরজা খুলে সিঁড়ি ভেঙ্গে দুদ্দাড় করে ছুটে পালাচ্ছে। কী কারণে এত ভয় পেয়েছে মেকু বুঝতে পারল না।
খানিকক্ষণ পর আম্মা বাথরুম থেকে গোসল সেরে বের হয়ে এসে কাজের মহিলাকে না পেয়ে খুব অবাক হলেন। এদিক সেদিক খুঁজে না পেয়ে বাইরের দরজা বন্ধ করে ঘরে ফিরে এলেন। প্রত্যেকবার মুখ খুলতেই সবাই ভয় পাচ্ছে দেখে মেকু আর মুখ খুলল না, তার নিজের আম্মাও যদি তাকে ভয় পেয়ে যান তখন কী হবে?
দুদিন পর জাঁদরেল ধরনের একজন মহিলা মেকুকে দেখতে এলেন। মেকুর জন্মের পর থেকে অসংখ্য মানুষ তাকে দেখতে এসেছে, বলতে গেলে তাদের সবাই মেকুকে দেখে খুশি হয়েছে। মেকুর গাল টিপে দিয়েছে, পায়ে সুড়সুড়ি দিয়েছে, মাথায় হাত বুলিয়েছে। তার চোখগুলি কত বড় এবং কর সুন্দর সেটা নিয়ে কিছু না কিছু মন্তব্য করেছে। মেকুর প্রায় অসহ্য হয়ে যাবার অবস্থা কিন্তু সে কষ্ট করে সহ্য করে যাচ্ছে, সে এর মাঝে আবিষ্কার করে ফেলেছে মানুষের ভালবাসা অসহ্য মনে হলেও সেটা সহ্য করতে হয়।
জাঁদরেল মহিলার মাঝে মেকু অবশ্যি কোনো ভালবাসা খুঁজে পেলেন না। তিনি ভুরু কুঁচকে মেকুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই বুঝি তোর ছেলে? এত শুকনো কেন? আমার মেয়ের বাচ্চা ছিল চার কেজি।”
আম্মা কিছু বললেন না, মেকু মনে মনে বলল, ওজন বেশি হউয়াই যদি ভালো হয়ে থাকে তা হলে মানুষের বাচ্চা না পুষে হাতির বাচ্চাকে পুষলেই হয়।
জাঁদরেল মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, “রাতে ঘুমায়?”
আম্মা মাথা নাড়লেন, “ঘুমায়।”
“খাওয়া নিয়ে যন্ত্রণা করে?”
“না।”
“কলিক আছে?”
“না।”
“নাম কী রেখেছিস?”
“ভালো নাম এখনো ঠিক করি নি, আমি মেকু বলে ডাকি।”
“মেকু?” জাঁদরেল মহিলা হঠাৎ হায়েনার মত হেসে উঠলেন, “মেকু আবার কী রকম না? এই নামের জন্যে বড় হলে তোর মেকুর বিয়ে হবে না। যার নাম মেকু তাকে কোন মেয়ে বিয়ে করবে?” জাঁদরেল মহিলা আবার হায়েনার মতো খ্যাক খ্যাক করে হাসতে শুরু করলেন।
মেকু দেখল তার আম্মা চুপ করে রইলেন কিছু বললেন না। মেকুর ইচ্ছে হল চিৎকার করে বলে, “আমি বিয়ে করার জন্যে মারা যাচ্ছি না।’ কিন্তু সে কিছু বলল না। যে বাচ্চার বয়স এখনো এক সপ্তাহও হয় নি তার মনে হয় বিয়ে নিয়ে কথা বলা ঠিক না।
জাঁদরেল মহিলা উবু হয়ে মেকুকে দেখে বললেন, “সারা দিনে কয়বার ন্যাপি-কাঁথা বদলাতে হয়?”
আম্মা ইতস্তত করে বললেন, “আসলে বদলাতে হয় না।”
জাঁদরেল মহিলা এবারে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, আম্মার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, “তোর বেকুর হিসি করতে হয় না?”
“বেকু না, মেকু।”
“ওই হল। মেকু হিসি করে না? বাথরুম করে না?”
“করে! আমি তার পটিতে বসিয়ে হিসি করতে বলি সে তখন হিসি করে। বাথরুম করে।”
জাঁদরেল মহিলা কেমন জানি রেগে উঠলেন, বললেন, “আমার সাথে মশকরা করছিস?”
“না খালা। সত্যি বলছি।”
“তুই বললেই আমি বিশ্বাস করব? সাত দিনের একটা বাচ্চা যার এখনো ঘাড় শক্ত হয় নি সে পটিতে বাথরুম করে।”
আম্মা কেমন জানি হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ ঠিক আছে খালা তুমি যা বল তাই।”
“কিন্তু তুই আমার সাথে মিথ্যে কথা বলবি কেন? আমি তোর খালা না? তোর মা আর আমি এক মায়ের পেটের বোন না?”
আম্মা কেমন জানি অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “খালা, আমি তোমার সাথে মিথ্যা কথা বলি নি।”
“তা হলে দেখা। দেখা তোর পেকু না মেকু সাত দিন বয়সে পটিতে বসে হিসি করে।”
‘সেটা আমি করতে পারি না খালা। আমার সাত দিনের বাচ্চাকে এখন তোমার সামনে পরীক্ষা দেওয়াতে পারি না।”
“কেন পারিস না?”
আম্মা কঠিন মুখে বললেন, “সেটা তুমি বুঝবে না খালা।”
জাঁদরেল মহিলার মুখ কেমন জানি থম থমে হয়ে উঠল, বাঘের মতো নিশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে! আমিই তা হলে দেখব।”
“কী দেখবে?”
“তোর ফেকু না খেকুকে পটিতে বসিয়ে দেখব কী করে।”
“না খালা। ওটা করতে যেও না।” আম্মার নিষেধ না শুনেই জাঁদরেল খালা মেকুর কাছে এগিয়ে গেলেন এবং একটান দিয়ে মেকুর ন্যাপি খুলে তাকে ন্যাংটো করে ফেললেন, ঠিক সাথে সাথে দুর্ঘটনাটি ঘটল। মেকু একেবারে নিখুঁত নিশানা করে জাঁদরেল খালার চোখে মুখে হিসি করে দিল। জাঁদরেল খালা একটা চিৎকার দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, তার মুখ চোখ শাড়ি ব্লাউজ ভেজা, মুখের রং খানিকটা উঠে এসেছে, সব মিলিয়ে তাকে অত্যন্ত হাস্যকর দেখাতে লাগল।
আম্মা হতাশভাবে মাথা নেরে বললেন, “এই জন্যে তোমাকে না করেছিলাম খালা।”
খালা দুই হাত দুইদিকে ছড়িয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো ফোঁস করে একটা শব্দ করে বললেন, এই জন্যে তুই না করেছিলি?”
আম্মা দুর্বলভাবে মাথা নাড়লেন। জাঁদরেল খালা মেঘ স্বরে বললেন, “তুই জানতি যে তোর গেকু আমার শরীরে হিসি করে দিবে?”
আম্মা মুখ শক্ত করে বললেন, “জানতাম।”
“কেন?”
“কারণ তুমি একবার তাকে বেকু ডেকেছ, একবার পেকু ডেকেছ একবার ফেকু ডেকেছ, খেকু দেখেছ গেকু ডেকেছ, কিন্তু ঠিক নামতা ডাক নাই। সেই জন্যে সে তোমার উপর রেগে আছে। আমার বাচ্চার নাম হচ্ছে মেকু। মেকু মেকু মেকু। মেকুকে যদি রাগিয়ে দাও তা হলে সে কঠিন শাস্তি দেয়।”
জাঁদরেল খালা প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ে কিছু একটা বলতে চাইছিলেন, আম্মা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “যাও খালা বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে নাও। তোমাকে দেখতে বিদঘুটে দেখাচ্ছে।”
জাঁদরেল খালা কোনো কথা না বলে পা দাপিয়ে বাথরুমের দিকে গেলেন। আম্মা মেকুর কাছে গিয়ে বললেন, বাবা মেকু। তুই এই কাজটা কি ঠিক করলি?”
মেকু তার মাড়ি বের করে হাসল, সে একেবারে এক শ ভাগ নিশ্চিত কাজটা সে ঠিকই করেছে।