মা বাধা দিয়ে বললেন, “আমি সব জানি। ডক্টর স্পকের বই আমি গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি।”
“তা হলে?”
“তা হলে কী?”
“তা হলে তুমি কেমন করে বলছ তোমার ছেলে সব কিছু জানে?”
মা হাসলেন, বললেন, “সেই জন্যে তুমি হচ্ছ বাবা আর আমি হচ্ছি মা! মা তাদের বাচ্চাদের সবকিছু জানে। বাবারা জানে না।”
বাবা কী বলবেন, বুঝতে পারলেন না। তাই বললেন, “ও।”
মা মেকুকে বুকে চেপে ধরে বললেন, “আমি জানি আমার মেকু হচ্ছে অসাধারণ।”
বাবা একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “পৃথিবীর সব বাবা মা জানে যে তাদের বাচ্চারা অসাধারণ। সেটা কোনো দোষের ব্যাপার না।”
মা বললেন, “শুধু এখানে পার্থক্য হল যে আমার মেকু আসলেই অসাধারণ। আমি যদি এখন মেকুকে বলি, বাবা মেকু তুমি হাস, তা হলেই দেখতে সে মাড়ি বের করে হাসবে। যদি বলি বাবা মেকু তুমি তোমার পা উপরে তুলো, সে তুলবে। যদি বলি—”
বাবা বাধা দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে তা হলে বল দেখি মাড়ি বের করে হাসতে—”
মা বাবার দিকে আহত চোখে তাকিয়ে বললেন, “তুমি সত্যিই মনে কর আমি আমার নিজের বাচ্চাকে বিশ্বাস করব না? তাকে পরীক্ষা করে দেখব?”
বাবা কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে তুমি যা বলছ আমি তাই বিশ্বাস করছি। শুধু একটা কথা।”
“কী?”
“তুমি সত্যিই আমাকের বাচ্চাকে মেকু বলে ডাকবে?”
মা চোখ বড় বড় করে বললেন, “কেন? অসুবিধে আছে?”
বাবা মাথা চুলকালেন, বললেন, “না, তোমার নাম যদি ঘিড়িংগা সুন্দরী হত তা হলে কি অসুবিধা হত?”
মা কঠিন মুখে বললেন, “তার মানে তুমি বলতে চাইছ মেকু নামটা তোমার পছন্দ হয় নি। তুমি তা হলে আগে বল নি কেন?”
“আগে আমি কেমন করে বলব? বাচ্চার জন্ম হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে, এখন শুনছি তার নাম মেকু।”
“আগে যখন তাকে মেকু বলে ডেকেছি তখন তো তুমি আপত্তি কর নি।”
বাবা মাথা নেড়ে বললেন, “তখন তো আমি বুঝতে পারি নি যে তুমি সত্যি সত্যি ডেকেছ। তখন তো বাচ্চা ছিল তোমার পেটের ভিতরে। আমি ভেবেছি তুমি ঠাট্টা করছ।”
মা কঠিন মুখে বললেন, “তুমি যদি মা হতে তা হলে বুঝতে, মায়েরা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে কখনো ঠাট্টা তামাশা করে না।”
আব্বা ভয়ে ভয়ে বললেন, “তা হলে আমাদের ছেলের পুরো নাম কী হবে? মেকু আহমেদ?”
মা বললেন, “না। তুমি তোমার পছন্দ মতো ভালো একটা নাম রাখতে পার। সমুদ্র আহমেদ কিংবা তরঙ্গ আহমেদ কিংবা সৈকত আহমেদ। তবে আমার কাছে আমার ছেলে হবে মেকু। মেকু, মেকু এবং মেকু।”
বাবা এবং মা’র মাঝে যখন কথা হচ্ছিল তখন মেকু পুরো কথা বার্তাটি চুপ করে শুনেছে। মাঝে মাঝেই যে তার মা’র পক্ষে একটা-দুইটা কথা বলার ইচ্ছে করে নি কিংবা হাত পা নেড়ে কিছু একটা করার ইচ্ছে করে নি তা নয়, কিন্তু সে কিছু করে নি। খুব ধৈর্য্য ধরে চুপ করে থেকেছে। বাবা নামক মানুষটা তার মা’র সাথে যেভাবে কথাবার্তা বলেছে সেটা থেকে মেকু দুইটা জিনিস বুঝতে পেরেছে। এক: বাবা মানুষটা তাদের দুই জনেরই খুব আপনজন। দুই: মানুষটা মন্দ না, ভালোই। কাজেই সে চুপচাপ কথাবার্তা শুনে গেছে, আপত্তি করে নি। রাত্রি বেলা মেকু যখন তার মা’র শরীর লেপটে ঘুমানোর জন্যে তৈরি হচ্ছিল তখন তার মনে হল পৃথিবী জায়গাটা মনে হয় খারাপ না। সে এসেছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা হয়েছে কিন্তু এর মাঝেই জায়গাটাকে সে পছন্দ করে ফেলেছে। যদি তার জন্ম না হত তা হলে সে কি কখনো এর কথা জানতে পারত?
০২. পরিচয় – মেকু কাহিনী
জন্মের তিন দিনের পর মেকুকে বাসায় নিয়ে আসা হল। মগবাজারে তিনতলায় একটা ফ্ল্যাট। আব্বা আম্মা আর মেকু এই তিন জনের সংসার। আগে যখন দুজন ছিলেন তখন কাজকর্মে সাহায্য করার জন্যে একজন মহিলা বিকেল বেলা কয়েক ঘণ্টার জন্যে আসত। এখন হয়তো সারাদিনের জন্যেই লাগবে। পরিচিত অপরিচিত সবাই ভয় দেখাচ্ছে যে একটা ছোট বাচ্চা নাকি দশ জন বড় মানুষের সমান। সারা দিনে বাচ্চা নাকি শুধু পেশাব করেই ন্যাপি আর কাঁথা ভেজাবে কমপক্ষে এক ডজন। সময়ে অসময়ে খিদে লাগার কথা তো ছেড়েই দেওয়া যাক। সারা রাত নাকি চিৎকার করে কাঁদবে। নিজে ঘুমাবে না অন্য কাউকেও ঘুমাতে দেবে না। অসুখবিসুখ লেগে থাকবে, কান পাকা হবে তার মাঝে এক নম্বর। এগুলি দিয়ে শুরু, বাচ্চা যখন আরেকটু বড় হবে তখন আরো নতুন নতুন ঝামেলা তৈরি হবে এবং সেইসব ঝামেলা শুধু বাড়তেই থাকবে।
আম্মা আর আব্বা অবিশ্যি আবিষ্কার করলেন মেকুকে নিয়ে বাড়াবাড়ি কোনো ঝামেলা হল না। শুধু কাজের মহিলাটি হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল, কেন উধাও হয়ে গেল সেটি কেউ বুঝতে পারল না। ব্যাপারটি যে ব্যাখ্যা করতে পারত সেটি হচ্ছে মেকু কিন্তু সে চুপচাপ ছিল বলে কেউ কিছু জানতেও পারল না। ব্যাপারটি ঘটেছিল এভাবেঃ আম্মা মেকুকে তার ছোট রেলিং দেওয়া বিছানায় শুইয়ে বাথরুমে গিয়েছেন। মেকু ঘুম থেকে উঠে শুয়ে শুয়ে তার বিছানায় সাজিয়ে রাখা খেলনা, বাসার ছাদ, দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ক্যালেন্ডার, জানালার পাখিগুলির কিচির মিচির সবকিছু দেখে শেষ করে ফেলে একটু বিরক্তি বোধ করতে শুরু করেছে। ঠিক তখন দেখতে পেল বাসায় কাজের মহিলাটি ঘর মোছার জন্যে একটা ন্যাকড়া নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। মেকুর বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ মেকুর সাথে হাসি মশকরা করল, মেকু এতদিনে টের পেয়েছে ছোট বাচ্চাকে দেখলেই সবাই তাদের সাথে হাসি মশকরা করতে শুরু করে, অর্থহীন শব্দ করে নিজেদেরকে একটা হাসির পাত্র বানিয়ে ফেলে। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে করে একটা ধমক লাগিয়ে দিতে কিন্তু মহা ঝামেলা হয়ে যাবে বলে কিছু বলে না।