বুড়ি গজগজ করে বলল, “বাচ্চার যা মেজাজ, কোলে নেয়ার ঠ্যালা আছে।”
ডাক্তার বাবার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই মি. হাসান। কংগ্র্যাচুলেশন।”
বাবা একটু হেসে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ।”
“কী চেয়েছিলেন আপনি? ছেলে না মেয়ে?”
“আমি আর কী চাইব! আমার স্ত্রী আগের থেকেই জানত যে তার ছেলে হবে!”
“তাই নাকি? অ্যামনিওসিণ্টোসিস করেছিলেন নাকি?”
“না না, সেরকম কিছু না। কোনো মেডিক্যাল ডায়াগনসিস না। তার এমনিতেই নাকি মনে হত যে বাচ্চাটা ছেলে!”
বাবা যেন খুব একটা মজার কথা বলেছেন সেরকম ভান করে ডাক্তার হা হা করে হেসে উঠে। হাসি থামিয়ে সে মায়ের কাছে এগিয়ে যায়। একটু ঝুঁকে পড়ে মেকুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ডেলিভারির পর যা ভয় পেয়েছিলাম!”
“কেন? কী হয়েছিল?”
“ডেলিভারির পর বাচ্চা বাতাসের অক্সিজেন দিয়ে তার লাংস ব্যবহার শুরু করে। সেটা শুরু হয় বিকট একটা কান্না দিয়ে! সেই জন্যে সব বাচ্চা জন্মানোর পর কেঁদে ওঠে। কিন্তু আপনার বাচ্চা জন্মানোর পর কাঁদছিল না।”
“সর্বনাশ! তারপর?”
“তারপর আর কী? উলটো করে ধরে পাছায় একটা থাবা মেরে দিলাম—দুই নম্বর থাবাটা খেয়েই বাচ্চার সে কী চিৎকার!” ডাক্তার যেন খুব মজার একটা গল্প বলছে সেইরকম ভাব করে হা হা করে হাসতে লাগল।
মেকু চোখের কোনা দিয়ে ডাক্তারকে দেখতে লাগল। এই তা হলে সেই ডাক্তার যে লোহার মত শক্ত হাত দিয়ে তার পাছায় এত জোরে থাবড়া মেরেছিল। কত বড় সাহস একবার কাছে এসে দেখুক না। বুড়িকে যেভাবে জোড়া পায়ে লাথি মেরেছিল সেইভাবে একটা লাথি বসিয়ে দেবে।
ডাক্তার অবিশ্যি বেশ কাছে এসে তাকে পরীক্ষা করতে লাগল কিন্তু মাথার কাছে থাকায় মেকু বেশি সুবিধে করতে পারল না। হাত দিয়ে অন্তত একটা খামচি দিতে পারলেও খারাপ হয় না। কিন্তু এখনো হাতের ব্যবহারটা ভালো করে শিখতে পারে নি। মেকু তবু একবার চেষ্টা করল, ডাক্তারের মুখটা কাছে আসতেই তার নাকে একটা খামচি দেওয়ার চেষ্টা করল, খামচিটা লাগল না। কিন্তু কিছু একটায় তার হাত লেগে যাওয়ায় সে শক্ত করে ধরে ফেলল।
ডাক্তার অবাক হবার ভঙ্গি করে বলল, “কী আশ্চর্য! আমার চশমাটা ধরে ফেলেছে।”
মেকু মনে মনে বলল, তোমার কপাল ভালো যে নাকটা ধরতে পারি নি। ধরতে পারলে দেখতে কী মজা হত। কিন্তু এই চশমাও আমি ছাড়ছি না।
খুব একতা মজা হচ্ছে এরকম ভান করে ডাক্তার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই মেকু চশমা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিল এবং চশমাটা ডাক্তারের নাক থেকে ছুটে এল। মেকু এখনো তার হাত আর হাতের আঙুলকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে শিখে নি। তাই চশমাটা ধরে রাখতে পারল না, হাত থেকে সেটা ছুটে গেল এবং শূন্যে উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ল, শব্দ শুনে মনে হল কাচ ভেঙ্গে এক শ টুকরো হয়ে গেছে।
ডাক্তার কাতর গলায় বলল, “চশমা! আমার চশমা!”
কে একজন তুলে এনে চশমাটা ডাক্তারের হাতে দেয়, একটা কাচ ভেঙে আলাদা হয়ে গেছে, অন্যটা তিন টুকরো হয়ে কোনো মতে ঝুলে আছে। ডাক্তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। দুর্বল গলায় বলল, “আমার এত দামি চশমা! আমেরিকা থেকে আনিয়েছিলাম, সিংগল লেন্স, বাইফোকাল, ননস্ক্রেচ গ্লাস। চার শ ডলার দিয়ে কিনেছিলাম।”
বাবা এগিয়ে এসে অপরাধীর মতো বললেন, “আমি খুবই দুঃখিত ডাক্তার সাহেব। আপনার চশমাটা এইভাবে ভেঙে ফেলবে—”
ডাক্তার সাহেব চশমাটা হাতে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আসলে জন্মের পর কখনো কখনো প্রথম চব্বিশ ঘণ্টা ছোট বাচ্চাদের রিফ্লেক্স খুব ভালো থাকে। আপনার এই বাচ্চার মনে হয় রিফ্লেক্স খুব ভালো। কীভাবে তাকিয়ে আছে দেখছেন? যেন সবকিছু বুঝতে পারছে!”
সবাই চলে যাবার পর মা বাবাকে বললেন, “ডাক্তার সাহেব বলছেন না জন্মের পর প্রথম চব্বিশ ঘণ্টা বাচ্চাদের রিফ্লেক্স খুব ভালো থাকে?”
“হ্যাঁ।”
“আমার কী মনে হয় জান?”
“কী?”
মা লাজুক মুখে হেসে বললেন, “আমার এই বাচ্চার শুধু যে রিফ্লেক্স ভালো তা নয়, আসলে—”
“আসলে কী?”
“আসলেই সে সব বুঝতে পারে।”
বাবা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “আসলে সব বুঝতে পারে?”
“হ্যাঁ। তোমার চাচি সব খারাপ খারাপ কথা বলছিল তাই তাকে কেমন শাস্তি দিল দেখলে না? কিছুতেই তার কাছে যেতে রাজি হল না।”
বাবা মুখ হাঁ করে কিছুক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ঢোক গিলে বললেন, “তুমি বলতে চাইছ সে সবকিছু বুঝে করেছে? ডাক্তার সাহেবের চশমা ভাঙার ব্যাপারটাও?”
“হ্যাঁ। যখন শুনল পাছায় থাকা দিয়েছেন তখন রেগে গেল। তার ভালোর জন্যেই করেছেন সেটা বুঝতে পারে নি। ছেলে মানুষ তো! মেকুর জন্ম হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা—”
“মেকু?”
মা লাজুকভাবে হেসে বললেন, “হ্যাঁ। আমি ওকে সবসময় মেকু ডাকি।”
“সবসময়? ওত তো জন্ম হল মাত্র ঘণ্টা।”
“তাতে কী হয়েছে? মেকু আমার পেটে ছিল না নয় মাস? তখন থেকে তাকে আমি মেকু ডাকি।”
বাবা হাত নেড়ে কথা বলার জন্য কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে কিছুই খুঁজে পেলেন না। একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “যখন পেটে ছিল তখন থেকে তাকে ডাকাডাকি করেছে?”
“মনে নেই তোমার?” মা চোখ বড় বড় করে বললেন, “মেকুকে গান শোনাতাম, কথা বলতাম, বই পড়ে শোনাতাম!”
বাবার মনে পড়ল, তখন ভেবেছিলেন এক ধরনের কৌতুন—এখন দেখা যাচ্ছে মোটেও কৌতুক নয়, মা ব্যাপারটিতে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বাবা খানিকক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন, “তুমি তো জান, বাচ্চারা যখন জন্ম নেয় তখন তারা কিছুই বুঝে না। তারা তখন অপারেটিং সিস্টেম বিহীন একটা কম্পিউটারের মতো। যখন বড় হয় তখন তারা সবকিছু শিখে—”