বয়স্কা মহিলাটি একটু অসন্তুষ্ট হল মনে হল, কিন্তু মুখে জোর করে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, “হ্যাঁ হাসান, তুই আগে কোলে নে। তুই যখন বাবা, ছেলেকে তো তুইই আগে কোলে নিবি।”
মেকু মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল বাবাটা কে। দেখল মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ফরসা মতন মানুষটাই হচ্ছে বাবা। বাবাকে কেন এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সে ঠিক বুঝতে পারল না। বাচ্চাকে শরীরের ভিতরে রেখে বড় করার পুরো কাজটা তো মা একাই করেছে, আর কাউকে তো তখন আশেপাশে দেখে নি। এখন হঠাত করে বাহাবা নেওয়ার জন্যে অনেকে এসে হাজির হচ্ছে মনে হল।
মা সাবধানে ফরসা মতন মানুষটার কাছে মেকুকে তুলে দিল। মানুষটা যত্ন করে দুই হাতে ধরে মেকুর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “ওমা। এইটুকুন একজন মানুষ।”
বয়স্কা মহিলাটা খনখনে গলায় বলল, “এই টুকুনই ভালো। যখন বড় হবে তখন দেখবি গাঞ্জা খাওয়া শিখবে, ফেনসিডিল খাওয়া শিখবে, মাস্তানি করবে, চাঁদাবাজি করবে—”
বাবা মেকুকে বুকে চেপে ধরলেন, বললেন, “কী বলছেন চাচি! আমার ছেলে মাস্তানি করবে?”
বয়স্কা মহিলাটি হড়বড় করে কথা বলতে লাগল, মেকু সেদিকে কান না দিয়ে তার বাবার দিকে তাকাল। মানুষটা ভালোই মনে হচ্ছে, তার জন্যে অনেক আদর রয়েছে। মেকুর বেশ পছন্দই হল মানুষটাকে।
বয়স্কা মহিলাটা এবারে একটু কাছে এগিয়ে এসে বাবাকে বলল, “দে হাসান আমার কাছে দে দেখি। পাজি ছেলেটাকে একবার কোলে নেই।”
মেকু তার বাবাকে ধরে রাখার চেষ্টা করল, এই বুড়ির কাছে তার একটুও যাবার ইচ্ছে নেই। কিন্তু সে এখনো হাত দুটি ভালো করে ব্যবহার করা শেখে নি, বাবাকে ভালো করে ধরতে পারল না, শুধু হাত দুটি ইতস্তত নড়তে লাগল। বুড়ি মহিলাটি আরো একটু এগিয়ে এল, হাত বাড়িয়ে মেকুকে ধরতে ধরতে বলল, “ওই তোরা ক্যামেরা এনেছিস না? একটা ছবি তুলিস না কেন?”
কে একজন ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে এল, বুড়ি মেকুর আরো একটু কাছে এসেছে। তখন মেকু প্রথমবার তার পা ব্যবহার করল। বুড়ির মুখটা কাছাকাছি আসতেই দুই পা ভাঁজ করে আচমকা বুড়ির নাকে শক্ত করে লাথি কষিয়ে দিল—ঠিক তখন ক্যামেরায় ফ্লাশ জ্বলে উঠল। মনে হল একেবারে মোক্ষম লক্ষভেদ হয়েছে, কারণ মেকু শুনতে পেল ঘরের সবাই হি হি করে হেসে উঠেছে। বুড়ি মহিলাটি নিজের নাক চেপে ধরে পিছিয়ে যায়, এখনো সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, কয়েক ঘণ্টা বয়স হয়েছে একটা ছেলে এত জোরে তাকে লাথি মেরে বসেছে। বুড়ি নিজের নাকে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “আমি বলেছি না ছেলে বড় হয়ে মাস্তানী করবে। এখনই তার নিশানা দেখাতে শুরু করেছে, লাথি ঘুষি মারতে শুরু করেছে।”
বাবা বললেন, “না চাচি। আপনি তো বলেছেন আমার ছেলে বড় হয়ে মাস্তান হবে সেজন্যে রেগে গিয়েছে!”
বুড়ি খনখনে গলায় বলল, “নে অনেক হয়েছে। কয়েক ঘণ্টা হলো বাপ হয়েছিস, এখনই ছেলের হয়ে দালালি শুরু করে দিয়েছিস।”
বুড়ি আবার দুই হাত বাড়িয়ে মেকুর কাছে এগিয়ে আসে। মেকু তক্কে তক্কে ছিল, হাত দিয়ে কিছু ধরাটা এখনো শেখে নি। কিন্তু দুই পা দিয়ে শক্ত করে একটা লাথি মেরে দেওয়াটা মনে হয় সে শিখেই গিয়েছে। বুড়ি আরেকটু নিচু হয়ে যখন কাছাকাছি চলে এল তখন আচমকা দুই পা ভাজ করে একেবারে সমস্ত শক্তি দিয়ে আবার লাথি কষিয়ে দিল, আগের চেয়ে অনেক জোরে। বুড়ি এবারে কোঁক করে একটা শব্দ করে পিছিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে পা বেধে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক জন সময়মতো তাকে ধরে না ফেললে সত্যি সত্যি একেবারে মেঝেতে লম্বা হয়ে পড়ে যেত।
আগের বার সবাই যেভাবে জোরে হেসে ওঠেছিল এবার কেউ সেভাবে জোরে হাসল না, মুখে কাপড় দিয়ে নিঃশব্দে হাসতে লাগল। বুড়ি চেয়ারে বসে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নেয়। শাড়ির আঁচল দিয়ে খানিকক্ষণ নাক ঢেকে রাখে, তারপর উঠে দাঁড়ালো, তার মুখ এবারে হিংস্র হয়ে ওঠেছে। চোখ দিয়ে রীতিমতো আগুন বের হচ্ছে, বুড়ি নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে এগিয়ে আসে। মেকুর বুকের ভেতর কেঁপে উঠে। এই বুড়ি এখন তার কোনো ক্ষতি করে ফেলবে না তো? এখন একটাই উপায়, সেটা হচ্ছে মায়ের কাছে চলে যাওয়া। মা’ই তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবে। মেকু এবারে সারা শরীর বাঁকা করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, মুখ হা করে জিভ বের করে এত জোরে কাঁদতে আরম্ভ করল যে বাবা ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি মেকুকে মায়ের হাতে দিয়ে দিলেন। মেকু সাথে সাথে মাকে শক্ত করে ধরে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। হাত পুরোপুরি ব্যবহার করা শেখে নি তবু কষ্ট করে সে মায়ের কাপড় এখানে সেখানে ধরে ফেলল। মা মেকুকে একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কাঁদিস না বাবা! আমি আছি না?”
মেকু সাথে সাথে কান্না থামিয়ে ফেলল, সত্যিই তো, তার মা আছে না? কার সাধ্যি আছে ধরে কাছে আসে।
ঘরে যারা আছে তাদের একজন বলল, “দেখেছ, দেখেছ—মা’কে কেমন চিনেছে? মায়ের কাছে গিয়েই একেবারে শান্ত হয়ে গেল।”
বুড়ি দাঁতের ফাঁক দিয়ে বাতাস বের করে কী একটা কথা বলতে এসেছিল, কিন্তু ঠিক তখন দরজা খুলে ডাক্তার এসে ঢুকল। শুকনো মতন ডাক্তার, কাঁচাপাকা চুল এবং নাকের নিচে ঝাঁটার মতো গোঁফ। ঘরের ভেতরে এত মানুষ দেখে ডাক্তার বলল, “আপনারা কিন্তু এখানে ভিড় করবেন না। বাচ্চাকে সবার কোলে নেওয়ার দরকার নেই। দূর থেকে একবার দেখে চলে যান।”