মেকু লজ্জার মাথা খেয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল, নার্স তাকে পুরো ন্যাংটো করে শুকনো কাপড় পরিয়ে দিচ্ছে, কী লজ্জার কথা। একজন অপরিচিতা মহিলা তাকে এভাবে ন্যাংটো করে ফেলছে, ছিঃ ছিঃ ছিঃ! মেকু লজ্জায় লাল হয়ে শুয়ে রইল। শুকনো কাপড় পরিয়ে নার্স তাকে তুলে নেয় তারপর বুকে চেপে হেঁটে যেতে থাকে। মেকু একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়, ভুল করে তাতে অন্য কোনো মায়ের কাছে দিয়ে দেবে না তো?
মা বিছানায় আধ-শোয়া হয়ে শুয়েছিলেন, নার্স মেকুকে মায়ের বুকের ওপর শুইয়ে দিল। মেকু একবার বুক ভরে ঘ্রাণ নেয়। কোনো সন্দেহ নেই—এই হচ্ছে তার মান—তাকে ভুল করে অন্য কোনো মায়ের কাছে দিয়ে দেয় নি। মায়ের শরীরের ভিতরে সে কতদিন কাটিয়েছে, কী পরিচিত মায়ের শরীরের এই ঘ্রাণ—আহা! কী ভালোই না লাগল মেকুর। মা মেকুকে বুকে চেপে ধরে তার গালে ঠোঁট স্পর্শ করে আদর করলেন। মেকু চেষ্টা করল হাত দিয়ে মা’কে ধরে ফেলতে কিন্তু হাত-পা-গুলি এখনো ঠিক করে ব্যবহার করা শেখে নি, ডান দিকে নিতে চাইলে বাম দিকে চলে যায়, বাম দিকে নিতে চাইলে ওপরে ওঠে যায়, তাই মা’কে ধরতে পারল না। মা মেকুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, আঙুলগুলি মেলে ধরলেন, পায়ের পাতায় চুমু খেলেন, নাক টেনে দিলেন, পেটের মাঝে কাতকুতু দিলেন। মেকু চোখ খোলা রেখে পুরো আদরটা উপভোগ করল। জন্মের পর থেকে যে তার ভিতরে ভিতরে একটা অস্থিরতা ছিল, দুশ্চিন্তা ছিল—এখন সব কেটে গেছে। এখন আর তার ভিতরে কোনো চিন্তা নেই। সে জানে তার মা তাকে সব বিপদ আপদ থেকে রক্ষ করবে। খিদে পেলে খেতে দেবে, ঘুম পেলে বুকে চেপে ঘুম পাড়িয়ে দেবে, বাথরুম পেলে বাথরুম করিয়ে দেবে আর যখন সেই খারাপ খারাপ ডাক্তারগুলি শক্ত লোহার মতো হাত দিয়ে থাবড়া দিতে আসবে তাদের হাত থেকে রক্ষা করবে। পৃথিবীর কারো কোনো সাধ্যি নেই এখন তার কোনো ক্ষতি করে। আসুক না সেই ব্যাটাম যে তার পাছায় থাবড়া দিয়েছিল, মা একেবারে তার বারটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবে না?
নার্স বলল, “আপনার ছেলের চোখগুলি দেখেছেন?”
মা মাথা নাড়লেন, “দেখেছি।”
“দেখে মনে হয় সবকিছু বোঝে।”
মা কিছু বললেন না, একটু হেসে মেকুকে আবার সাবধানে বুকে চেপে আদর করলেন। নার্স বলল, “আপনার সব আত্মীয়-স্বজন অপেক্ষা করছে। আসবে বলব?”
মা তার গায়ের কাপড় টেনে টুনে ঠিক করে বললেন, “বলেন।”
নার্স বের হয়ে যাওয়ার প্রায় সাথে সাথেই অনেকগুলি মানুষ এসে ঢুকল। নানা বয়সের মানুষ, কেউ মোটা, কেউ চিকন, কেউ বয়স্ক, কেউ বাচ্চা, কেউ পুরুষ এবং কেউ মহিলা। সবাই একসাথে কথা বলতে বলতে মেকু আর তার মায়ের কাছে ছুটে আসতে শুরু করে দিল কিন্তু নার্স পুলিশ সার্জেন্টের মতো দুই হাত তুলে তাদের মাঝপথে থামিয়ে দিল। মুখ শক্ত করে বলল, “আপনারা কেউ বেশি কাছে আসবেন না।”
বয়স্কা একজন মহিলা বলল, “কেন কাছে আসব না? আমরা নাতিকে দেখবে না?”
“আগে ভালো করে হাত ধুয়ে আসেন। ওই যে বেসিন আছে। বেসিনে সাবান রাখা আছে।”
“কেন? হাত ধুতে হবে কেন?”
“কারণ আপনারা বাইরে থেকে এসেছেন। আর যাকে দেখতে এসেছেন তার মাত্র কিছুক্ষণ হল জন্ম হয়েছে।”
“আমাদের কি বাচ্চাকাচ্চা হয় নি?” বয়স্কা মহিলাটি খনখনে গলায় তর্ক করতে লাগল, “আমরা কি বাচ্চা মানুষ করি নি?”
নার্সটি বলল, “অবিশ্যিই করেছেন। আপনারা করেছেন আপনাদের মতো, আর আমরা করছি আমাদের মতো। এটাই আমাদের নার্সিং হোমের নিয়ম।”
“কী রকম নার্সিং হোম এটা? বাচ্চা জন্মানোর পর আলাদা ফেলে রাখল, এখন ধরতে দেবে না।”
“এটাই নিয়ম। আপনারা এই নিয়ম মেনেই আমাদের নার্সিং হোমে এসেছেন। খোঁজ নিয়ে দেখেন।” নার্স কঠিন মুখ বলল, “সবাই হাত ধুয়ে আসেন। যারা ছোট তারা যেন কাছাকাছি না আসে।”
মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখল ফরসা মতন একজন মানুষ সবার আগে হাত ধুয়ে এগিয়ে এল। মানুষটা মায়ের কাছে এসে মেকুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ওমা! শানু, দেখতে দেখি একেবারে তোমার মতো হয়েছে!”
মা একটু হেসে বললেন, “কে বলেছে আমার মতো?”
“হ্যাঁ। একেবারে তোমার মতো। এই দেখ একেবারে তোমার মতো নাক।”
মেকু তাকিয়ে মায়ের নাকটা দেখল, কী সুন্দর মায়ের নাক। যদি সত্যি মায়ের মতো নাক হয়ে থাকে তাহলে তো ভালোই হয়। মেকু নিজের নাকটা দেখার চেষ্টা করল কিন্তু দেখতে পেল না। মানুষ নিজের নাক নিজের কেমন করে দেখে কে জানে।
খনখনে গলায় সেই বয়স্কা মহিলাটি বলল, “কে বলেছে তোমার বউয়ের মতো নাক? এর তো দেখি নাকই নাই।”
মহিলার কথা শুনে ঘরের অনেকে হি হি করে হেসে উঠে। মেকু চোখ পাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল কে কথাটা বলেছে আর কারা কারা হাসছে। তাকে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে দেখে সবাই আবার হি হি করে হেসে উঠল, মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ফরসা মতন মানুষটা বলল, “দেখেছ? মনে হচ্ছে সবার কথা বুঝতে পারছে।”
মেকু একবার ভাবল বলেই ফেলে, “অবশ্যি বুঝতে পারছি! বুঝতে পারব না কেন? আমাকে কি গাধা পেয়েছ না বেকুব পেয়েছ?” কিন্তু সে কিছু বলল না, তার মাত্র জন্ম হয়েছে, পৃথিবীর নিয়ম কানুন সে কিছুই জানে না, উলটা পালটা কাজ করে সে কোনো ঝামেলায় পড়তে চায় না।
খনখনে গলায় বয়স্কা মহিলাটি বলল, “দেও দেখি বউমা তোমার বাচ্চাটা একটু কোলে নিয়ে দেখি।”
পিছন থেকে একজন বলল, “না চাচি, আগে বাবার কোলে দেয়া যাক, দেখি বাবা কী করে!”