নার্স ইতস্তত করে বলল, বাচ্চার নানি, খালা, দাদি, চাচা-চাচি সবাই বাচ্চা দেখার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
“করুক। বলনে জানালা দিয়ে দেখতে।”
মেকু টের পেল নার্স তাকে জড়িয়ে ধরে নার্সারি নিয়ে যাচ্ছে। মাথা ঘুরিয়ে সে তার মা’কে দেখার চেষ্টা করল কিন্তু ভালো করে দেখতে পেল না।
নার্সারি ঘরে সারি সারি ছোট ছোট বিছানা, সেখানে আরো কিছু বাচ্চা কাদার মতো ঘুমিয়ে আছে। নার্স মেকুকে খালি একটা বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চলে গেল। খালি ঘর, আশে পাশে আর কেউ নেই। মেকু এদিক ওদিক তাকাল এবং তখন তার নজরে পড়ল আশেপাশে ছোট ছোট বিছানাগুলিতে একটা করে বাচ্চা শুয়ে আছে। মেকু মাথা ঘুরিয়ে দেখল ঠিক তার পাশের বিছানাতেই গাবদাগোবদা একটা বাচ্চা শুয়ে আছে। সে গলা উঁচিয়ে ডাকল, “এই। এই বাচ্চা—”
বাচ্চাটা কো কো করে একটু শব্দ করল কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। মেকু আবার ডাকল, “এই বাচ্চা। উঠ না—”
বাচ্চাটা এবারে চোখ পিট পিট করে তাকাল, মেকু জিজ্ঞেস করল, “কী হল? কথা বল না কেন? কী নাম তোমার?”
বাচ্চাটা বুড়ো আঙুল চুষতে চুষতে আবার চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর জন্যে প্রস্তুত হয়। মেকু রেগে গিয়ে একটা ধমক দিয়ে বলল, “বেশি ঢং হয়েছে নাকি? একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, কানে যায় না?”
মেকুর ধমক খেয়ে বাচ্চাটা হঠাত চমকে উঠে ঠোঁট উলটে কাঁদতে শুরু করল। প্রথমে আস্তে আস্তে তারপর গলা ফাটিয়ে। তার কান্না শুনে পাশের জনও জেগে উঠে কাঁদতে শুরু করল এবং তার দেখাদেখি অন্য সবাই। মনে হল ঘরে বুঝি কান্নার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
এতজনের কান্না শুনে পাশের ঘর থেকে নার্স ছুটে এসে বাচ্চাগুলিকে শান্ত করতে থাকে। একজন একজন করে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ল, তখন মেকু নার্সকে বলল, “এই যে, শুনেন।”
নার্স হঠাত করে ভয়ে একটা চিৎকার করে উঠে, তার কথায় এভাবে চিৎকার করে ওঠার কী আছে মেকু বুঝতে পারছে না। মেকু তার হাত নাড়ার চেষ্টা করে আবার ডাকল, “এই যে, এদিকে—”
নার্স আবার একটা চিৎকার করে উঠে—এখনো মেকুকে দেখতে পায় নি। মেকু আবার ডাকার আগেই নার্স হঠাত করে গুলির মতো ছুটে ঘরে থেকে বের হয়ে গেল। কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে, হঠাত করে কী দেখে ভয় পেল কে জানে। মহা মুশকিল হল দেখি, মেকু খুব বিরক্ত হল। প্রচণ্ড বাথরুম পেয়েছে কিন্তু ঠিক কীভাবে করবে বুঝতে পারছে না, যেভাবে বাথরুম চেপেছে, জামাকাপড় ভিজিয়ে ফেলার একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে—তা হলে কী লজ্জারই না একটা ব্যাপার হবে।
মেকু দরজায় একটা শব্দ শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, দেখতে পেল নার্সটা আবার ফিরে এসেছে এবারে সাথে বয়স্কা আরেক জন নার্স। বয়স্কা নার্সটা বলল, “এখানে কেউ একজন তোমাকে ডেকেছে?”
“হ্যাঁ।”
“এখানে কে ডাকবে? কেউ তো নেই। শুধু বাচ্চাগুলি।”
“আমি স্পষ্ট শুনলাম। প্রথমে বলল, ‘এই যে শুনেন’। তারপর বলল, ‘এই যে, এদিকে—’”
“কী রকম গলা?”
“ছোট বাচ্চার মতো গলা।”
বয়স্কা নার্সটা এবার হো হো করে হেসে বলল, “তুমি বলছ কোনো একটা বাচ্চা তোমাকে ডেকেছে?”
ভয় পাওয়া নার্সটা ইতস্ততঃ করে বলল, “না, মানে ইয়ে—”
বয়স্কা নার্সটা ভয় পাওয়া নার্সটার হাত ধরে বলল, “আসলে আজকে ডাবল ওভার টাইম করে তুমি বেশি টায়ার্ড হয়ে গেছ, তাই এরকম মনে হচ্ছে। বাসায় গিয়ে একটা টানা ঘুম দাও দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“হ্যাঁ। তাই করতে হবে।”
“কথাটা আমাকে বলেছ ঠিক আছে। আর কাউকে বল না। বাচ্চারা জন্মানোর সাথে সাথে তোমাকে ডাকাডাকি করছে শুনলে সবাই ভাববে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। চাকরি নিয়ে টানাটানি হয়ে যাবে।”
নার্স দুই জন নিচু গলায় কথা বলতে বলতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। মেকু এবারে মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল, নার্স দুজনের কথা শুনে মনে হচ্ছে তার কথা বলার ব্যাপারটা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। কী কারণ? অন্য পাশের বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করে দেখবে নাকি? মেকু মাথা ঘুরিয়ে দেখল একেবারে কাদার মতো ঘুমাচ্ছে ডেকে লাভ হবে মনে হয় না। এরকমভাবে ঘুমাচ্ছে যে দেখে মেকুরও নিজের চোখে ঘুম এসে যাচ্ছে, জেগে থাকাই মনে হয় মুশকিল হয়ে যাবে। তার সাথে এখন আরেক যন্ত্রণা শুরু হল, বেশ কিছুক্ষণ থেকেই টের পেয়েছে এখন সেটা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। চেপে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কী করবে বুঝতে না পেরে সে ছটফট করতে থাকে এবং কিছু বোঝার আগেই হঠাত করে তার বাথরুম হয়ে গেল। নিজের কাপড়ে বাথরুম? কী লজ্জা! কী লজ্জা! যখন অন্যেরা বুঝতে পারবে তখন কী হবে? জন্ম হয়েছে এখনো এক ঘণ্টা হয়নি তার মাঝে সে এরকম একটা লজ্জার কাজ করে ফেলল? সর্বনাশ!
মেকু অত্যন্ত অশান্তিতে খানিকক্ষণ ছটফট করে ভেজা কাপড়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখতে পেল নার্স আর ডাক্তার মিলে তার কাপড় খুলে ফেলেছে, কী লজ্জার কথা। যখন দেখবে সে নিজের জামা কাপড়ে বাথরুম করে ফেলেছে নিশ্চয়ই কী রকম রেগে যাবে। আবার ধরে একটা থাবড়াই দেয় নাকি কে জানে! মেকু ভয়ে ভয়ে নার্স আর ডাক্তারের দিক তাকিয়ে রইল।
কিন্তু ঠিক উলটো ব্যাপার হল, ডাক্তার খুশি খুশি গলায় বলল, “পারফেক্ট! বাচ্চা পেশাবও করে ফেলেছে। ভেরি গুড! শুকনো একটা ডাইপার পরিয়ে মায়ের কাছে নিয়ে যান। বেচারি মা আর অপেক্ষা করতে পারছে না।”