বদি বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক তাকাল। চারপাশে যারা আছে তারা কী নিউমার্কেটের সাধারণ মানুষ নাকি সাদা পোষাকের পুলিশ বোঝা মুশকিল। বদি ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রইল এবং মুক্তিপণের টাকা নিয়ে কে আসতে পারে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। তারা বলে রেখেছে পলিথিনের ব্যাগে করে টাকা আনতে হবে কিন্তু কোনো মানুষের কাছেই পলিথিনের ব্যাগ নেই। বদি একটু অধৈর্য হয়ে এদিক সেদিক তাকাল এবং দেখতে পেল একজন মহিলা হাতে একটা বড় পলিথিনের ব্যাগ বোঝাই কিছু নিয়ে এগিয়ে আসছে। মহিলাটিকে দেখে মনে হল কাউকে খুঁজছে – তা হলে কি এই মহিলাই মুক্তিপণের টাকা এনেছে? এরকম একটা কাজে কি একজন মহিলা আসতে পারে? মহিলাটা দ্বিতীয়বার বদির সামনে দিয়ে হেঁটে যাবার সময় বদি চাপা গলায় বলল, “আপনি কী মেকুর কিছু হন?”
মহিলাটি – যিনি আসলে মেকুর আম্মা, চমকে উঠে বদির দিকে তাকালেন, মুহূর্তে মুখের মাঝে একসাথে ঘৃণা এবং রাগ ফুটে উঠে। তারপর চোখে আগুন ঢেলে বললেন, “ও! তুমি কিডন্যাপার?”
বদি ঠোটে আঙুল দিয়ে বলল, “শ-স-স-স। আস্তে।”
“কেন আস্তে কেন? আমার বাচ্চাকে কিডন্যাপ করার সময় মনে থাকে না? এখন আস্তে!”
বদি শুকনো গলায় বলল, “লোকজন শুনলে আপনারই অসুবিধা হবে।”
“কী অসুবিধে হবে?”
“আপনার বাচ্চা অন্য জায়গায় আছে- তার ভালোমন্দের ব্যাপার আছে।”
আম্মা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, “কী? কী বললে তুমি বদমাইশ? পাজির পা ঝাড়া? আমার বাচ্চার ভালো মন্দের ব্যাপার? তোমার কত বড় সাহস–”
বদি অস্বস্তিতে বলল, “আ-হা-হা! আস্তে বলেন, কেউ শুনে ফেলবে।”
“কোথায় আমার মেকু?”
বদি চাপা গলায় বলল, “আপনি টাকা বুঝিয়ে দেন – আমি বাচ্চা বুঝিয়ে দেব।”
আম্মা দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, “আমার সাথে তুমি মামদোবাজি কর? তোমরা নর্দমার কীট,সাপের বাচ্চা। তুমি ভাবছ আমি তোমাদের চিনি না? জুতো দিয়ে পিটিয়ে তোমাদের সিধে করা দরকার।”
বদি একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, “আপনি কী বলছেন?”
“মিথ্যে বলেছি? আমি মিথ্যে বলেছি?”
“সত্যি মিথ্যে জানি না। আপনি পলিথিনের ব্যাগটা দেন। টাকা সব এনেছেন তো?”
আম্মা গরম হয়ে বলল, “আমি আগেই দেব না। আমার মেকু কোথায় আছে না বললে দেব না।”
“আগে টাকা দেন। তারপর অন্য কথা।”
“আগে মেকুকে দাও। তারপর অন্যকথা।”
বদি বিরক্ত হয়ে বলল, “সেটা কেমন করে হয়? বইপত্রে কখনো কিডন্যাপের গল্প পড়েন নাই? টাকা না দিলে কেউ কখনো কাউকে ফেরত দেয়?”
“অশিক্ষিত মূর্খ চোরের দল। তুমি আমাকে বইপত্র শিখিও না। বল, কোথায় আছে আমার মেকু?”
“ঠিক আছে। আপনাকে যদি মেকুর সাথে কথা বলতে দেই তা হলে আপনি টাকা দেবেন?”
“আগে আমাকে কথা বলতে দাও তারপর দেখি।”
বদি বিরক্ত হয়ে তার পকেট থেকে টেলিফোন বের করে ডায়াল করে টেলিফোনটা আম্মার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নেন। আমার পার্টনারের সাথে কথা বলেন।”
“তোমার পার্টনার কে?”
বদি মুখ শক্ত করে বলল, “দুর্ধর্ষ মহিলা। তিন বার এরেস্ট হয়েছে। দুই বার জেল খেটেছে। নাম জরিনা।”
আম্মা টেলিফোনটা কানে লাগিয়ে বললেন, “হ্যালো।”
অন্যপাশ থেকে একটা মোটা এবং ভারি পুরুষ মানুষের গলা শোনা গেল, “হ্যালো।”
আম্মা একটু অবাক হলেন, বললেন, “আপনি কে বলছেন?”
মোটা এবং ভারি গলা বলল, “আপনি কে বলছেন?”
“আমি আমার ছেলের খবর নেওয়ার জন্যে জরিনার খোঁজ করছি। তারা আমার ছেলেকে কিডন্যাপ করেছে।”
“ও! আপনার ছেলে কিডন্যাপ করেছে। সে ভালোই আছে – কোনো চিন্তা করবেন না। কিন্তু জরিনার সাথে তো এখন কথা বলতে পারবেন না।”
“কেন?”
“কারণ, তার দুই হাত পিছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগানো হয়েছে। এখন তো ফোন ধরতে পারবে না। তা ছাড়া তার মেজাজ খুব খারাপ, কাছে গেলে কামড় দেবে মনে হয়।”
আম্মা একটা নিশ্বাস ফেলেল বললেন, “তা হলে আপনি বলছেন আমার ছেলে ভালো আছে?”
“হ্যাঁ। ভালো আছে। আমি পুলিশ ইন্সপেক্টর। আমি বলছি ভালো আছে।”
“দেখেন তো তার ন্যাপি শুকনো না ভিজা।”
“কী বললেন?”
“বলেছি, দেখেন দেখি ন্যাপিটা শুকনো না ভিজা।”
কিছুক্ষণ পর মোটা এবং ভারী গলা বলল, “শুকনো।”
“আপনি আমার ছেলেকে বলেন হিসি করতে।”
মোটা এবং ভারী গলা অবাক হয়ে বলল, “কী বললেন?”
“বলেছি, আমার ছেলের কাছে গিয়ে তাকে বলেন হিসি করতে।”
“হিসি?”
“হ্যাঁ, বলেন, তোমার আম্মু বলেছে হিসি করতে।”
আবার কয়েক মুহূর্ত নীরবতা তারপর ভারী আবনফ মোটা গলা বলল, “বলেছি।”
“গুড। আমার ছেলে হিসি করেছে?”
“আবার কয়েক মুহূর্ত নীরবতা, তারপর ভারী এবং মোটা গলা আনন্দময় সুরে বলল, “করেছে।”
“গুড। ভেরি গুড।” আম্মার আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন – কিন্তু বদি বাধা দিল। বলল, “কী হয়েছে?” কার সাথে কথা বলছেন?”
আম্মা হাতের ব্যাগটা তুলে বদির মাথায় এক ঘা বসিয়ে দেবার প্রস্তুতি নিয়ে বললেন, “পুলিশের সাথে। তোমার দুর্ধর্ষ পার্টনার চতুর্থবার এরেস্ট হয়েছে। খুব নাকি মেজাজ গরম। যেই কাছে আসছে তাকেই কামড় দিচ্ছে।”
বদির চোয়াল হঠাৎ ঝুলে গেল। সে চোখের কোনা দিয়ে চারিদিকে তাকাল তারপর হঠাৎ আম্মার উপর ঝাপিয়ে পড়ে পলিথিনের ব্যাগটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, আম্মা বাধা দিতে গিয়ে থেমে গেলেন, কারণ – প্রথমত বদি এক হাতে তার পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে এনেছে। দ্বিতীয়ত পলিথিনের ভিতরে নোটের বান্ডিলের মতো জিনিসগুলিতে আসলে টাকা নেই। কাগজের বান্ডিল!
বদি পলিথিনের ব্যাগটা হাতে নিয়ে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে দৌড়াতে থাকে, পিছু পিছু বেশ কিছু মানুষ একটু দূরত্ব নিয়ে তার পিছু পিছু যেতে থাকে, হাতে রিভলবার বলে কেউ কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না।
বদি ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে দৌড়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পলিথিনের ব্যাগটা পিছনের সিটে রেখে মতিকে বলল, “মতি! চালাও – জলদি ।”
মতি স্টিয়ারিঙে মাথা রেখে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে আছে, গাড়ি চালানোর কোনো প্রশ্নই আসে না। বদি মতিকে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিতেই মতি চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে বদি?”
“মানুষ ধরতে আসছে! চালাও গাড়ি। জলদি।”
মতি স্টীয়ারিং ঘোরাতে শুরু করে, হর্ন দেয়, গীয়ার পালটে এক্সেল্টরে চাপ দিয়ে গাড়ি চালানোর ভান করে বলল, “কী গাড়ি এটা? নড়ে না কেন?”
বদি চিৎকার করে বলল, “আগে গাড়ি স্টার্ট দেবে না?”
“দেই নাই?”
মতি চাবিটা বদির হাতে দিয়ে বলল, “তুমি স্টার্টটা দাও দেখি – আমি ততক্ষণ একটু ঘুমিয়ে নেই –”
কথা শেষ করার আগেই মতি স্তিয়ারিং হুইলে মাথা রেখে আবার ঘুমিয়ে গেল। বদি সামনে এবং পিছনে তাকাল; দুই পাশেই অনেক পুলিশ, রীতিমতো অস্ত্র তাক করে আসছে। তাদের পিছনে মানুষ। তাদের পিছনে মেকুর আম্মা। মনে হচ্ছে বদির মাথাটা টেনে ছিঁড়ে ফেলবেন।
বদি গাড়ির ড্যাশবোর্ডে একটা ঘুষি মেরে মাথা নেড়ে হতাশ ভঙ্গিতে বলল, “ধরা পড়ে গেলাম!”
মতি চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, “সত্যি?”
বদি মুখ খিঁচিয়ে বলল, “সত্যি কি না চোখ খুলে দেখ।”
মতির মুখে শিশুর মতো একটা হাসি ফুটে উঠে, সে চোখ বুজে বলল, “ভালোই হল, এখন আরামে ঘুমাতে পারব। তুমি বড় ডিস্টার্ব কর বদি। ঘুমাতে দেও না।”
একটা বাঁশির মতো শব্দ আসে সেটা কি মতির নাক ডাকার শব্দ নাকি পুলিশের বাঁশির শব্দ বদি ঠিক বুঝতে পারল না।
০৮. শেষ কথা – মেকু কাহিনী
দুর্ধর্ষ শিশু অপহরণ মামলাটি নিয়ে কিছু মজার ব্যাপার হল। জরিনা মেকু নামের আড়াই মাসের একটা বাচ্চার নামে কোর্টে কেস করার চেষ্টা করল, বাচ্চাটি নাকি তাদের নানাভাবে শারীরিক যন্ত্রণা দিয়েছে, এমনকি খুন করে ফেলার চেষ্টা করেছে। পুলিশ অবশ্যি কেসটি নেয় নি। শেষ পর্যন্ত কোর্টে যখন মামলা উঠেছে তখনো জরিনা সাক্ষী হিসেবে মেকুকে কোর্টে আনার চেষ্টা করেছিল, মেকু নাকী মূল্যবান তথ্য দিতে পারবে। জজ সাহেব রাজী হন নি – জরিনা তবুও অনেক চেষ্টা করেছে। তাতে অবিশ্যি জরিনার একটু লাভ হয়েছে – তাকে পাগল ভেবে জজ সাহেব শাস্তিটা একটু কমিয়ে দিয়েছেন। তারা তিন জনই এখন জেলে আছে, ছাড়া পেলে কী করবে সেটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে। তবে তারা কান ধরে প্রতিজ্ঞা করেছে আর কখনো বাচ্চা-কাচ্চা কিডন্যাপ করবে না। মরে গেলেও না।
মেকু ভালোই আছে। তার বয়স এখন এক বছর তিন মাস। তার প্রিয় লেখক য়োহান ভোলফ গাঙ ফন গ্যাতে। প্রিয় বিজ্ঞানী স্টিফান হকিং, প্রিয় খেলা দাবা, প্রিয় শিল্পী পাবলো পিকাসো। এই বয়সেই তার নানারকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। তার বয়স যখন ছয় মাস এগারো দিন, তখন একদিন হঠাৎ করে –
না, থাক । শুরু করলে সেটা আবার একটা বিরাট ইতিহাস হয়ে যাবে ।