জরিনা কোলে ধরে রাখা মেকুর দিকে তাকাল, বাচ্চাটা বেশ নির্লিপ্তভাবে শুয়ে আছে। ছোট বাচ্চা বলে রক্ষা, কোথায় কার কাছে আছে কিছু বুঝতে পারছে না। তাই কান্নাকাটি করছে না। মাঝে মাঝে অবশ্যি কোনো কারণ ছাড়াই বিকট চিৎকার করে ওঠে – সেটাই যন্ত্রণা। ছোট বাচ্চা বলে সেটা কখন করে বসবে জরিনার কোনো ধারণা নেই, সেটা একটা সমস্যা। আর কিছুক্ষণ এভাবে শান্ত হয়ে থাকলেই অবশ্যি কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে।
জরিনা শপিং সেন্টারের ভিতরে ঢুকল। পাশাপাশি কয়েকটা শাড়ির দোকান, তার পাশে একটা গয়নার দোকান। শাড়ি গয়নায় জরিনার বেশি উৎসাহ নেই কিন্তু দেখতে ভালোই লাগে। বিশেষ করে সোনার গয়না। সব গয়না ডাকাতি করে নিয়ে নেবে এরকম একটা কল্পনা করে তার মুখে মাঝে মাঝে পানি এসে যায়। জরিনা গয়নার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে শোকেসে সাজিয়ে রাখা ভারী ভারী গয়নাগুলি দেখতে লাগল, এগুলি ডাকাতি করে নিতে পারলে কত টাকায় বিক্রি করা যাবে আন্দাজ করার চেষ্টা করল।
গয়নার দোকানের সামনে থেকে সরে যেতেই জরিনা দেখল পাহাড়ের মতো একটা পুলিশ হেলতে হেলতে হেঁটে যাচ্ছে। পুলিশ দেখেই জরিনা একটু শিটিয়ে যায়, সে দাঁড়িয়ে গেল যেন পুলিশটা হেঁটে চলে যেতে পারে। কিন্তু ঠিক তখন খুব বিচিত্র একটা ব্যপার ঘটল, জরিনা শুনতে পেল কে যেন তার খুব কাছে থেকেক বলল, “এই ভটকু মিয়া।”
কথাটি বলল মেকু, কিন্তু দুই মাসের একটা বাচ্চা কথা বলতে পারে সেটা ঘুণাক্ষরেও জরিনার মাথায় আসে নি বলে সে সেটা ধরতে পারল না।
পাহাড়ের মতো পুলিশটা সাথে সাথে ঘুরে জরিনার দিকে তাকাল, চোখ লাল করে বলল, “কী বললেন?”
জরিনা থতমত খেয়ে বলল, “আমি বলি নাই।”
“তা হলে কে বলেছে?”
জরিনা ঘুরে পিছনে তাকাল, আশেপাশে কেউ নাই, সে একা দাঁড়িয়ে আছে। সত্যিই তো, তা হলে কে পুলিশটাকে ভটকু মিয়া ডেকেছে? মোটা মানুষকে ভটকু মিয়া ডাকলে রাগ তো করতেই পারে, আর সেই মোটা মানুষটি যদি পুলিশ হয় তা হলে তো কোনো কথাই নেই।
পুলিশ গর্জন করে বলল, “আপনি কেন আমাকে ভটকু মিয়া ডাকলেন?”
জরিনা আবার চিঁ চিঁ করে বলল, “আমি ডাকি নাই।”
পুলিশটা কিছুক্ষণ চোখ লাল করে জরিনার দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “খবরদার, কখনো এভাবে কথা বলবেন না।”
জরিনা মিনমিন করে বলল, “বলব না।”
পুলিশটা ঘুরে আবার হাঁটতে থাকে, ফাঁড়া কেটেছে মনে করে জরিনা বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করতে যাচ্ছিল কিন্তু মেকু সে সুযোগ দিল না, আবার পুলিশটাকে ডাকল, বলল, “ভোটকা মিয়ার, তেজ দেখো!”
এত বড় পাহাড়ের মতো পুলিশটা সাথে সাথে পাই করে ঘুরে জরিনার দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, “কী বললেন? কী বললেন আপনি? আমি ভোটকা মিয়া? আমার তেজ হয়েছে?”
জরিনা একেবারে হতবাক হয়ে গেল। কে কথা বলছে? সে কি বলবে বুজতে পারল না কিন্তু তার আগেই স্পষ্ট মনে হল এই বাচ্চাটা কথা বলেছে! এটা কি সম্ভব?
পুলিশটা মহা তেড়িয়া হয়ে প্রায় জরিনার উপর ঝাপিয়ে পড়ল, চিৎকার করে বলল, “কী বললেন আপনি? আপনার কত বড় সাহস একজন পুলিশ অফিসারের সাথে এইভাবে কথা বলেন? মুখ ঢেকে রেখেছেন বাঁদরামো করার জন্যে?”
জরিনা বিস্ফোরিত চোখে মেকুর দিকে তাকিয়ে রইল, তার মাথা ঘুরতে শুরু করেছে – এই বাচ্চাকে কিডন্যাপ করার পর থেকে তাদের দুর্গতি, রাতে ভূতের কথা বলা, সবকিছু হঠাৎ যেন পরিষ্কার হয়ে যেতে থাকে। ভয়ে আতঙ্কে জরিনার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। পুলিশ অফিসারটা একেবারে জরিনার গায়ের উপর উঠে হুংকার দিল, বলল, “কী হল? কথা বলেন না কেন?”
জরিনার হয়ে মেকু কথার উত্তর দিল, বলল, “এই তো বলছি। আমাকে চেনো না ভোটকা মিয়া? আজকের পত্রিকায় আমার ছবি দেখ নাই?”
“কী ছবি?” পুলিশ আরো একটু এগিয়ে এল।
“দূর থেকে কথা বল। বেশি কাছে আসলে ঘুষি মেরে তোমার দাঁত ভেঙে ফেলব।”
“কী বললেন? কী বললেন আপনি?” পুলিশ অফিসার দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “আপনি ভাবছেন মহিলা হয়েছেন দেখে আপনি যা ইচ্ছা তাই বলতে পারবেন? আপনাকে এরেস্ট করে এমন কোৎকা দেব –”
মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখল তাদের ঘিরে বেশ একটা ভিড় জমে উঠেছে। শুধু তাই নয় মনে হয়, একজনের হাতে আজকের পত্রিকাও আছে। সে বলল, “চোপ কর ব্যাটা বদমাইশ । পত্রিকায় আমার ছবি দেখলে তোমার কাপড়ে বাথরুম হয়ে যাবে।”
যার হাতে পত্রিকাটি ছিল সে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, আজকের পত্রিকায় বাচ্চা কিডন্যাপের ছবি ছাপা হয়েছে।”
পুলিশ অফিসার বলল, “আপনি কী বলতে চান আপনি সেই কিডন্যাপার?”
এতক্ষণে জরিনা নিজেকে একটু সামলাতে পেরেছে। কাঁদো কাঁদো হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মেকু বলল, “হ্যাঁ। বিশ্বাস না হলে আরেকটু কাছে আস – ভোটকা মিয়া। ব্যাগ থেকে রিভলবার বের করে তোমার মাথা ফুটো করে দেব।”
“কী বললেন?” পুলিশ অফিসার হুংকার দিয়ে চোখের পলকে তার কোমরে ঝোলানো রিভলবারটা হাতে নিয়ে নিল। জরিনার দিকে তাক করে বলল, “কত বড় সাহস – একজন পুলিশ অফিসারকে গুলি করার ভয় দেখায়!”
জরিনা এবারে মোটামুটি ভেঙে পড়ল, কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “দেখেন, আমি আপনাকে কিছুই বলি নাই।”
পুলিশ অফিসার মুখ খিঁচিয়ে বলল, “এখন আমার হাতে রিভলবার দেখে ভয় পেয়ে সিধে হয়ে গেছেন!”
“না না সেটা নয়। আমি আপনাকে কিছু বলি নাই।”
“তা হলে কে বলেছে?”
“আমার মুখ ঢাকা তাই আপনি ভেবেছেন আমি কথা বলছি। আসলে আমি বলি নাই।”
পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বলল, “তা হলে কে বলেছে?”
জরিনা মেকুকে দেখিয়ে বলল, “এই যে, এই বাচ্চাটা।”
পুলিশ অফিসার এবং চারপাশে থাকা মানুষগুলি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হঠাৎ এক সাথে উচ্চস্বরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে সবাই একবারে গড়াগড়ি খেতে থাকে।
জরিনা চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যিই বলছি! খোদার কসম!”
পুলিশ অফিসার হাসি থামিয়ে উপস্থিত মানুষগুলির দিকে তাকিয়ে বলল, “ড্রাগস খেয়েছে। ড্রাগস খেয়ে মাতলামি করছে।”
জরিনা বলল, “আমি মাতলামি করছি না। সত্যি কথা বলছি এই বাচ্চা কথা বলতে পারে। মহা ত্যাঁদড় –”
পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বলল, “চুপ করেন। ফাজলেমি করবেন না।”
“খোদার কসম।”
মেকু তখন ঠিক ছোট বাচ্চারা যেভাবে কাঁদে সেরকম ভান করে ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদতে লাগল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলল, “এই যে বাচ্চা কথা বলছে!”
আরেকজন টিটকারী করে বলল, “হ্যাঁ! একেবারে ব্যান্ড সংগীত!”
উপস্থিত সবাই আবার হা হা করে উচ্চস্বরে হেসে উঠে – জরিনা ঠিক বুঝতে পারল না, এই কথাটার মাঝে এত হাসির কী আছে!
জরিনা মেকুর দিকে তাকাল, মেকু তার মাড়ি বের করে হেসে জরিনার দিকে তাকিয়ে একবার চোখ টিপে দেয়! কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার, এইটুকু পুঁচকে ছোঁড়া তাকে এভাবে নাকানী চুবানী খাইয়েছে? এটা কী সম্ভব? সে অবিশ্বাস করবে কেমন করে একেবারে নিজের চোখে দেখছে! জরিনা চারিদিকে তাকাল, একেবারে নাকের ডগায় রিভলবার ধরে একটা পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, চারিদিকে মজা দেখার জন্যে মানুষের ভিড় এবং মানুষগুলির একজনেও তার কথা বিশ্বাস করছে না। সে হেরে গেছে এবং হেরেছে দুই মাসের একটা পুঁচকে ছোঁড়ার কাছে। পুঁচকে ছোঁড়াটাকে উপরে তুলে একটা আছাড় দিলে হয়তো মনে ঝাল একটু মিটবে। জরিনা মুখ শক্ত হয়ে আসে, নিশ্বাস দ্রুততর হয়, চোখ থেকে আগুন বের হতে থাকে – কিন্তু ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছে। মেকু জরিনার উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছে, সে তার দুই পা জোড়া করে জরিনার মুখের উপর গায়ের জোরে লাথি বসিয়ে দিল – জরিনা কোঁক করে একটা আর্ত শব্দ করে পড়ে যাচ্ছিল, পুলিশ অফিসারটা খপ করে ধরে ফেলল, ভিড়ের মাঝে থেকে একজন এসে মেকুকে ধরল। টানাটানিতে জরিনার মুখের উপর থেকে কাপড় স্বরে এসেছে, খবরের কাগজ হাতে মানুষটি বিস্ময়ের শব্দ করে বলল, “ব্যাপারটা দেখ! এই মহিলা তো ডেঞ্জারাস মহিলা। পত্রিকায় তো এরই ছবি!”
জরিনার মাথা ঘুরছে তার মাঝে ব্যাগ খুলে সে রিভলবারটা বের করার চেষ্টা করল, কিন্তু তার আগেই পুলিশ অফিসার তার হাত থেকে ব্যাগটা চিনিয়ে নিয়েছে। মানুষজন আরো ভিড় করে এগিয়ে আসে। ব্যাগের ভিতর থেকে একটা রিভলবার আর একটা মোবাইল ফোন বের হয়ে এসেছে। জরিনা মোবাইল ফোনটা দেখে একটা নিশ্বাস ফেলল, বদি হয়তো এক্ষুনি ফোন করবে, তখন কী হবে?