গভীর রাতে মেকুকে একটা বিছানায় শুইয়ে অন্যেরা কেউ মেঝেতে, কেউ চেয়ারে এবং কেউ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। ঘরে আলো জ্বলছে, আলো নিভিয়ে অন্ধকার করার কারো সাহস নেই। আজ রাতে কারো চোখে আর ঘুম আসবে বলে মনে হয় না। মেকু অবিশ্যি মজা দেখার জন্যে আর জেগে থাকতে পারল না, ঘুমে তার দুই চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল, সে ঘুমিয়ে পড়ল, আগামী কাল মেকুর অনেক কাজ – ভালো করে ঘুমিয়ে না নিলে কেমন করে চলবে? ঘুমের মাঝেও সে তার দুই হাত শক্ত করে মুঠি করে রাখল, সেখানে পাঁচটা ঘুমের ট্যাবলেট ধরে রেখেছে, ভোর বেলা কায়দা করে সেগুলো ব্যবহার করতে হবে।
জরিনা ঢুলু ঢুলু চোখে কিছুক্ষণ বসে থেকে হঠাৎ মতির দিকে তাকিয়ে খিল খিল করে হেসে ফেলল। মতি একটু গরম হয়ে বলল, “কী হল, হাস কেন?”
“তোমাকে দেখে।”
“আমাকে দেখে হাসির কী হয়েছে?”
“তুমি যখন দরজা ভেঙে বের হয়ে এসেছ তখন তোমার আরেকটা জিনিস ভেঙ্গেছে।”
“কী?”
“নাক। নাক্তা দেখেছ তোমার? এখন এক পাশে কাৎ হয়ে আছে।”
মতি নিজের নাকটা স্পর্শ করে একটা নিশ্বাস ফেলল, সত্যি সত্যি সে নিজের নাকটা নিজে ভেঙে ফেলেছে।
“শুধু যে কাৎ হয়ে আছে তাই না, লাল হয়ে টমেটোর মতো ফুলে উঠেছে। হি হি হি!” জরিনা আবার হাসতে থাকে।
মতি রেগে মেগে বলল, “এখন এইটা নিয়ে রাত দুপুরে হাসাহাসি করতে হবে?”
“কী করব? ঘুমাতে যখন পারবই না এই গুলি নিয়েই গল্প-গুজব করি। হাসি তামাশা করি।”
“ঠিক আছে। তা হলে আমিও তোমাকে নিয়ে হাসি তামাশা করি। তোমাকে দেখতে কী রকম লাগছে জান? তোমাকে দেখাচ্ছে ঠিক একটা পেত্নীর মতো। পেত্নী চিন তো? ওই যে গাব গাছে শুকনো ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে থাকে- ”
“কী বললে তুমি? আমি পেত্নী?” জরিনা সোজা হয়ে বসে একটা গ্লাস তুলে বলল, “এই গ্লাসটা ছুঁড়ে তোমার চোখ আমি কানা করে দেব।”
বদি বিরক্ত হয়ে বলল, “এই মাঝরাতে তোমরা এটা কী শুরু করলে বাচ্চা পোলাপানের মতো?”
জরিনা ক্রুদ্ধ গলায় বদিকে ধমক দিয়ে বলল, “তুমি চুপ কর হোঁদল কুতকুত কোথাকার –”
“কী বললে? কী বললে আমাকে?”
“আমি বলেছি হোঁদল কুতকুত।”
“আমি যদি হোঁদল কুতকুত হই তা হলে তুমি হচ্ছ মাকড়শার ঠ্যাং –”
“কী বললে?” জরিনা আগুন হয়ে বলল, “কী বললে আমাকে? আমি মাকড়শার ঠ্যাং —”
মতি হাত তুলে বলল, “চুপ, চুপ সবাই চুপ। হোটেলের কর্মচারী এসে আমাদের বের করে দিলে একেবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই রাতে আমাদের কিন্তু আর থাকার জায়গা নেই। মহা কেলেংকারি হয়ে যাবে।”
কথাটা একেবারে পুরোপুরি সত্যি কাজেই বদি এবং জরিনা চুপ করে গিয়ে ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। মতি বলল, “এখন সবাই একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর। কালকে আমাদের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। সারারাত বসে বসে ঝগড়াঝাঁটি করলে সকালে কিছুই করতে পারব না।”
জরিনা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলেল মেকুর দিকে তাকাল, কী আরামে বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে দেখে হিংসায় তার চোখ ছোট ছোট হয়ে যায়।
আগামী কালের জন্যে মেকু কী পরিকল্পনা করে রেখেছে জানলে জরিনার অবশ্যি তখন তখনই হার্টফেল হয়ে যেত।
০৭. অভিযান – মেকু কাহিনী
ভোরবেলা মেকু ভরপেটে দুধ খেয়ে, বাথরুম সেরে শুকনো পরিষ্কার কাপড় পরে ফিটফাট হয়ে নিল। মতি বদি আর জরিনার অবস্থা অবশ্যি এত ভালো হল না। তিন জন সারা রাত ঘুমাতে পারে নি চেহারায় তাই একটা ঝড়ো কাকের ভাব চলে এসেছে। জরিনার চুল নোংরা পাটের দড়ির মতো হয়ে গেছে। না ঘুমিয়ে চোখ গভীর গর্তে ঢুকে গেছে, চোখের নিচে কালি, চোখ টকটকে লাল, মনে হচ্ছে চোখের পাতিগুলি শিরীষ কাগজ দিয়ে তৈরি, প্রত্যেক বার চোখের পাতি ফেললেই চোখের ভেতর কড় কড় করে উঠে।
গত রাত্রে ভয় পেয়ে ছোটাছুটি করার সম্য নানাভাবে আছাড় খেয়ে পড়েছে, তখন বুঝতে পারে নি কিন্তু এখন টের পাচ্ছে যে জরিনা অনেক খারাপভাবে ব্যথা পেয়েছে। ঠিক কপালের উপরে একটা জায়গা ঢিবির মতো ফুলে আছে। বাম কান দিয়ে মনে হয় ভালো করে শুনতে পাচ্ছে না, মাঝে মাঝে ভোঁ ভোঁ করে বোলতার পাখা ঝাপটানোর মতো একটা শব্দ হয়। ডান হাতটা ভালো করে নাড়াতে পারছে না, কনুইটা লাল হয়ে ফুলে ওঠেছে। বাম পা’টা একটু অকেজো হয়ে গেছে, হাঁটার সময় পা’টা ভিতরের দিকে চলে এসে এবং কনকন করে কোথায় জানি ব্যথা করে ওঠে।
বদির মচকে ওঠা পা’টা এখন ফুলে উঠেছে, সেই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। গরকাল সিঁড়িতে আছাড় খেয়ে তার যে দাঁতটা ভেঙে গিয়েছিল সেটা এখন প্রচণ্ড ব্যথায় কন কন করছে, পুরো মুখটাই ফুলে উঠেছে। সার্টের পকেটে আগুন লেগে বুকের ছাল চামড়ার যে অংশটা পুড়ে গিয়েছিল সেখানে এখন দগদগে ঘা, শুধু বুক নয় শরীরে চিঞ্চিনে ব্যথা। সারা রাত ঘুমাতে পারে নি বলে গা গুলিয়ে বমি বমি ভাব, মনে হচ্ছে হড় হড় করে বমি করে দেবে।
মতির অবস্থা আরো খারাপ, কপালের কাছে আগেই ফুলে উঠে একটা চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছিল, তার উপর নাকটা ভেঙে গিয়ে চেহারায় কেমন যেন হাস্যকর একটা ভাব চলে এসেছে। ডান হাতটা মোটামুটি অকেজো হয়ে আছে – মনে হয় সেটা সকেটের ভেতর থেকে যে কোনো মুহূর্তে খুলে আসবে, কেমন জানি ঢল ঢল করছে। সারা রাত না ঘুমিয়ে চোখের নিচে কালি, সেটাকে পরিপূর্ণ করার জন্যে মুখের অর্ধেক অংশ কালশিটেতে ঢেকে আছে। হঠাৎ করে দেখলে কেমন জানি আঁতকে উঠতে হয়।
তিন জন এক জন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে ভয়ে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। নিচে নাস্তা দেওয়ার জন্যে খবর দেওয়া হয়েছিল, নাস্তা খেয়েই তারা রওনা দেবে।
কিছুক্ষণের মাঝেই এক জন নাস্তা দিয়ে গেল। সবারই খুদে লেগেছে কিন্তু সারা রাত না ঘুমিয়ে খাওয়ায় রুচি নেই। যেটুকুই রুচি ছিল মুখের নানা জায়গায় প্রচণ্ড ব্যথার কারণে কেউ ভালো করে কিছু খেতে পারল না। মেকুর হাতে ঘুমের ওষুধ সে চোখের কোনা দিয়ে দেখছিল, চা খাবার সময় সেগুলো দিয়ে দেবার চেষ্টা করতে হবে, সুযোগ না পেলে কী হবে সেটাই হচ্ছে কথা।
নাস্তা শেষ করে তিন জন চা খেতে শুরু করেছে, মেকু তখন একটু অস্থির হয়ে পড়ল। কাছাকাছি না গিয়ে তো সে চেষ্টাও করতে পারবে না। কাছে যাওয়ার একটিই উপায়, সেটা হচ্ছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করা – কাজেই মেকু হঠাৎ সারা শরীর বাঁকা করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে আরম্ভ করল। জরিনা বলল, “কেউ একজন বাচ্চাটাকে কোলে নাও।”
বদি বলল, “আমি পারব না। এই বাচ্চাকে দেখলেই আমার মেজাজ গরম হয়ে যায়।”
মতি বলল, “দুই মাসের ছোট একটা বাচ্চার ওপরে মানুষ আবার রাগ করে কেমন করে?”
বদি বলল, “এই বাচ্চার জন্যে তোমার যদি এত দরদ তা হলে তুমি কোলে নাও না কেন?”
মতি বিরক্ত হয়ে মেকুর কাছে এগিয়ে গেল এবং তার ব্যথা পাওয়া হাতে খুব সাবধানে মেকুকে কোলে নিল, মেকু সাথে সাথে কান্না থামিয়ে ফেলে। মতি বলল, “দেখেছ? ছোট বাচ্চাদের এক ধরনের সাইকোলজি থাকে, একটুখানি আদর করলেই তারা খুশি হয়ে উঠে।”
বদু মুখ ভেংচে বলল, “ভালো। এই ছোট বাচ্চাকে তুমি যদি এত ভালো বুঝতে পার তা হলে তুমিই রাখ, আমি এই ফিচকে বদমাইশের ধারে কাছে নেই।”
মতি হতাশ হওয়ার চান করে বলল, “বদি, তুমি যতক্ষণ ছোট শিশুকে ভালবাসতে পারবে না ততক্ষণ তুমি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারবে না।”
বদি ফোঁস ক্রেও একটা নিশ্বাস ফেলেল বলল, “ সেটাই যদি সত্যি হয় তা হলে আমি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতেও চাই না। বনমানুষ হয়েই থেকে যাবো।”
মতি এক হাতে মেকুকে কোলে ধরে রেখে অন্য হাতে চায়ের কাপটা তুলে নিল, সাবধানে এক চুমুক খেয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, “এইটা কি চা নাকি ইঁদুর মারার বিষ।”
জরিনা বলল, “জোর করে খেয়ে নাও, সারা রাত ঘুমাও নি কাজে দেবে।”
মেকু চোখের কোনা দিয়ে চায়ের কাপটা লক্ষ করল, একেবারে তার হাতের নাগালে চলে এসেছে, একটু সময় পেলেই সে তার হাতে ধরে রাখা পাঁচটা ট্যাবলেট চায়ের কাপে ছেড়ে দিতে পারে। মেকু তক্কে তক্কে রইল এবং মতি একটু অন্য দিকে তাকাতেই মেকু তার হাতের মুঠোয় ধরে রাখা ট্যাবলেটগুলি মতির চায়ের কাপে ছেড়ে দিল, কেউ টের পেল না।
মতি আবার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “চা’টা কী বিস্বাদ দেখেছ? শুধু যে বিষের মতো কড়া তাই না কেমন ওষুধ ওষুধ গন্ধ।”
বদি বলল, “জরিনা ঠিকই বলেছে, জোরে করে খেয়ে নাও। ফ্রেশ লাগবে।”
মতি জোরে করে চায়ের কাপ শেষ করে ফেলল। মেকু একটু কৌতূহল নিয়ে মতির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে – এই ওষুধের কাজ শুরু হতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে!
কিছুক্ষণের মাঝেই মেকুকে নিয়ে তিনজনের দলটা বের হয়ে গেল, তাদেরকে দেখে আর যাই হোক দুর্ধর্ষ কোনো অপরাধীর দল মনে হচ্ছিল না – প্রত্যেকেই কোনো-না-কোনোভাবে ঘায়েল হয়ে আছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কিংবা ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে কিংবা কোঁকাতে কোঁকাতে যাচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বদির, তার সার্টে বুকের কাছাকাছি অর্ধেক পুড়ে গেছে সেই পোশাকে তাকে একটা কাক তাড়ুয়ার মতো দেখাতে থাকে। বদি মুখ কালো করে মাথা নেড়ে বলল, “আমি তো এই পোশাকে বের হতে পারি না।”
জরিনা বলল, “তা হলে কোন পোশাকে বের হবে?”
বদি মাথা চুলকে বলল, “ একটা সার্ট কিনতে হবে।”
“কোথা থেকে কিনবে? আশেপাশে কোনো সার্টের দোকান নেই।”
বদি মুখ ভারী করে বলল, “ এই সার্ট পরে বের হওয়ার থেকে খালি গায়ে বের হওয়া ভালো।”
বদির কথাটি কিছুক্ষণের মাঝেই সত্যি প্রমাণিত হল। নিচে হোটেলের ম্যানেজার বদির দিকে তাকিয়ে হা হা করে হেসে উঠল। বলল, “আরে ভাই আপনার হৃদয়ের আগুন দেখি বড় গরম। সার্ট পর্যন্ত পুড়ে গেছে।”
বদি অনেক কষ্ট করে মেজাজ ঠাণ্ডা রাখল। হোটেলের বিল মিটিয়ে বাইরে বের হবার পর রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটা ফাজিল ছেলে বলল, “মিয়া ভাইয়ের বুকের মাঝে কী আগ্নেয়গিরি?”
রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটা টোকাই হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “স্যার কী বুক দিয়ে পেট্রল বোমা মারেন?”
রিকশা দিয়ে যেতে যেতে দুটি কমবয়সী মেয়ে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বদিকে দেখে হাসতে লাগল, কী বলছে সেটা সৌভাগ্যক্রমে বদি শুনতে পেল না।
এর মাঝে বদি পুরোপুরি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে – কাজেই যখন ঠিক তার সামনে একটা গাড়ি ব্রেক কষে থেমে গেল এবং ড্রাইভারের সিটে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বদির দিকে তাকিয়ে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগল বদি এর সহ্য করতে পারল না, মচকে যাওয়া পায়ে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে গাড়ির কাছে গিয়ে দরজা খুলে মানুষটার কলার ধরে টেনে গাড়ি থেকে বের করে ফেলল। জরিনা ভয় পাওয়া গলায় বলল, “আরে বদি, তুমি কী করছ?”
“এই মানুষটাকে মজা দেখাচ্ছি – কত বড় সাহস, আমাকে দেখে হাসে!”
“এইটা কী মজা দেখানোর সময়?”
মতি বলল, “খারাপ কী? আমরা এই গাড়িটাই নিয়ে নিই।”
কেউ কিছু বলার আগে মতি গাড়ির পিছনের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেল। তার হঠাৎ ভয়ানক ঘুম পেতে শুরু করেছে।
জরিনা বলল, “এই গাড়িটা?”
“হ্যাঁ।” মতি ঢুলু ঢুলু চোখে বলল, “খামোখা গাড়ি ভাড়া করে পয়সা নষ্ট করে কী হবে? উঠ সবাই।”
জরিনা একবার অবাক হয়ে বদির দিকে আরেকবার মতির দিকে তাকাল। বদিও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে, মতি কী চাইছে বুঝতে তার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। গাড়ির মালিক হঠাৎ করে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চিৎকার শুরু করে দিল, “ফাজলেমি পেয়েছেন? এইটা রং তামাশার জায়গা? নামেন আমার গাড়ি থেকে।”
মতি বলল, “বদি গাড়িতে ওঠ। চালাও।”
বদি বলল, “দাঁড়াও।” তারপর সে পকেট থেকে তার রিভলবার বের করে মানুষটার মাথায় ধরে বলল, “চোপ শালা। একটা কথা বললে খুলি ফুটো করে দেব।”
মানুষটা হঠাৎ করে একেবারে ঠাণ্ডা মেরে গেল।
বদি বলল, “সার্ট খোল।”
মানুষটা তোতলাতে তোতলাতে বলল, “কী-কী-কী-খুলব?”
“সার্ট।”
মানুষটা সার্ট খুলতে শুরু করে। বদি ধমক দিয়ে বলল, “সাবধানে খুলিস। ইস্তিরি যেন নষ্ট না হয়।”
কাজেই কিছুক্ষণের মাঝে দেখা গেল বদি ইস্ত্রি কড়া সার্ট পরে একটা টয়োটা টার্সেল গাড়ি এয়ারপোর্ট রোড ধরে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির পিছনের সিটে জরিনা মেকুকে কোলে নিয়ে বসেছে। জরিনার পাশে মতি, সে গাড়ির সিটে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে।
গাড়ি বাংলা-মোটরের কাছাকাছি এসে বামে ঘুরে গেল। বদি বলল, “আমাদের হাতে অনেক সময়।”
জরিনা বলল, “হ্যাঁ। খামোখা ঘুরাঘুরি না করে কোথাও বসে পুরো ব্যাপারটা একবার ঝালাই করে নিলে হয়।”
বদি বলল, “এইখানে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে। ফাস্ট ক্লাস পরটা এর খাশির কলিজা বানায়।”
“এখনো তোমার খিদে আছে?”
“টেনশান হলেই আমার খিদে পায়।” বলে বদি একটা বড় রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামিয়ে বলল, “চল,নামি।”
বদি গাড়ি থেকে নেমে মতির দিকে তাকিয়ে বলল, “আরে! মতি দেখি ঘুমিয়ে গেছে! এরকম সময় মানুষ ঘুমায় কেমন করে?”
জরিনা মুখ বাঁকা করে হেসে বলল, “টেনশান হলে তোমার যেরকম খুদে পায় মতিরও মনে হয় সেরকম ঘুম পায়!”
বদি গাড়ির ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে বলল, “মতি। এই মতি ওঠো।”
মতি অনেক কষ্ট করে চোখ খুলে আমতা আমতা করে কিছু একটা বলে আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেল। জরিনা অবাক হয়ে বলল, “আরে! এ দেখি কাদার মতো ঘুমিয়ে আছে!”
বদি মতিকে জোরে ধাক্কা দিতেই সে এবারে চোখ খুলে তাকাল, বলল, “কী হয়েছে?”
“কিছু হয় নাই। ঘুম থেকে উঠো।”
“কেন?”
“কেন মানে? এখন কী ঘুমানোর সময়?”
মতি ঢুলু ঢুলু চোখে বলল, “আমি একটু ঘুমিয়ে নিই তোমরা যাও।”
বদি এবারে রেগে উঠে মতিকে ধরে প্রায় টেনে বের করে ফেলল, “ফাজলেমি পেয়েছ? আমরাও তো সারা রাত ঘুমাই নি – আমরা কি এত ঢং করছি?”
মতি কোন উত্তর দিল না, বদিকে জড়িয়ে ধরে অনেকটা ঈদের কোলাকুলির মতো ভঙ্গি করে আবার ঘুমিয়ে গেল, শুধু যে ঘুমিয়ে গেল তাই নয়, বদি স্পষ্ট শুনতে পেল মতি নাক ডাকতে শুরু করেছে। একজন মানুষ যে এভাবে নাক ডেকে ঘুমাতে পারে বদি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করত না।
বদি ঘুমন্ত মতিকে টেনে হিঁচড়ে কোনো মতে রেস্টুরেন্টের মাঝে এনে ঢোকালো। আলাদা একটা কেবিনের মতো জায়গায় মতিকে বসাতেই মতি টেবিলে মাথা রেখে আবার ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেল। জরিনা এর বদি দুজনেই অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে মতির দিকে তাকিয়ে থাকে, ঘুম নিয়ে কেউ যে এত বাড়াবাড়ি করতে পারে সেটা তারা একেবারেই বিশ্বাস করতে পারে না।
একজন বয় এসে জানতে চাইল তারা কী খাবে, অর্ডার দিয়ে বদি জরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “মতি এটা কী শুরু করেছে বল দেখি?”
“আমি বুঝতে পারছি না। মতি তো এরকম মানুষ না।”
“হ্যাঁ। আমি বেশ ঘুমাই বলে সব সময় আমাকে বকাবকি করে। এখন নিজেই কলাগাছের মতো ঘুমাচ্ছে।”
“জোর করে ঘুম থেকে তুলে বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুইয়ে এনে কড়া লিকারের দুই কাপ চা খাওয়াও।”
বদি তখন মতিকে অনেক কষ্টে ধাক্কাধাক্কি করে জাগিয়ে তুলল। বলল, “কী হল মতি? তুমি এখন ঘুমাচ্ছ কেন?”
মতি কোনো মতে চোখ খোলা রেখে বলল, “বুঝতে পারছি না। ঘুমে চোখ ভেঙে যাচ্ছে।”
“বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দাও।”
“ঠিক আছে” বলে মতি আবার ঘুমে কাদা হয়ে টেবিলে মাথা রাখতে যাচ্ছিল বদি ধাক্কা দিয়ে তুলে ফেলল। তারপর টেনে সোজা করে বাথরুমে ঠেলে নিতে থাকে। বাথরুমের ভিতরে ঠেলে দিয়ে বদি খুব চিন্তিত মুখে ফিরে এল।
রেস্টুরেন্টের কেবিনের ভিতর জরিনার কোলে মেকুকে নিয়ে চিন্তিত মুখে বসে আছে। মুক্তিপণ নেবার সময় তিন জনেরই দরকার – মতি যদি এভাবে ঘুমাতে থাকে তা হলে কীভাবে কী হবে সে বুঝতে পারছে না। বদি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল জরিনা বাধা দিয়ে বলল, “একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ?”
“কী জিনিস?”
জরিনা চোখের কোনা দিয়ে দেখিয়ে বলল, “রেস্টুরেন্টের মানুষগুলি আমাদের দিকে এভাবে তাকাচ্ছে কেন?”
বদি নিজের মুখে হাত বুলিয়ে বলল, “এমনভাবে ঘায়েল হয়েছি, চোখ মুখ ফুলে আছে, জামা কাপড়ের ঠিক নাই সেই জন্যে।”
“উঁহু। সবাই খবরের কাগজের দিকে তাকাচ্ছে এর আমাদের দিকে তাকাচ্ছে।”
বদি চমকে উঠল, “তাই নাকি?”
“হ্যাঁ। বদি, তুমি যাও দেখি, একটা খবরের কাগজ কিনে আন।”
বদি হেঁটে হেঁটে খবরের কাগজ কিনতে গেল কিন্তু ফিরে এল দৌড়াতে দৌড়াতে। জরিনা অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
বদি খবরের কাগজটা জারিনার সামনে রেখে বলল, “এই দেখ।”
জরিনা দেখল খবরের কাগজের প্রথম পাতায় নিচের অংশে ডান দিকে তাদের তিন জনের ছবি, উপরে বড় বড় করে হেডিং “শহরে দুর্ধর্ষ শিশু অপহরণকারী!”
জরিনা কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না,খানিকক্ষণ মুখ হাঁ করে থেকে বলল, “আমাদের ছবি কোথায় পেয়েছে?”
“ফাইল থেকে। মনে নাই, প্রত্যেকবার এরেস্ট করলে একটা ছবি তুলে?”
“কী লিখেছে?”
বদি চাপা গলায় বলল, “পড়ি নাই। সময় কই পড়ার, এখনি পালাতে হবে। তাড়াতাড়ি।”
জরিনা মেকুকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটতে থাকে, পিছনে পিছনে খবরের কাগজ হাতে বদি। মাঝপথে রেস্টুরেন্ট বয়ের সাথে দেখা হল, পরটা আবনং খাসির কলিজা নিয়ে আসছে। সে অবাক হয়ে বলল, “স্যার আপনার খাবার!”
বদি ছুটতে ছুটতে বলল, “তুমি খেয়ে নাও। আমাদের সময় নাই।”
গাড়ির কাছাকাছি গিয়ে বদির মনে পড়ল মতিকে বাথরুমে রেখে এসেছে, তখন সে আবার ছুটল মতিকে আনতে। রেস্টুরেন্টের মানুষেরা সবাই ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে রইল এবং তার মাঝে বদি বাথরুমে গিয়ে দেখল মতি বেসিনে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। মতিকে টেনে সোজা করে বদি তাকে জাগানোর চেষ্টা করল, কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে দুই গালে বার কয়েক শক্ত চড় মারার পর মতি কোনোমতে চোখ খুলে জড়ানো গলায় বলল, “কী হল বদি, আমাকে মারো কেন?”
“সর্বনাশ হয়েছে!”
কি জিনিস সর্বনাশ হয়েছে সেটা জানতে মতি খুব একটা উৎসাহ দেখাল না, বদির ঘাড়ে মাথা রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করল, বদি তখন চুলের ঝুঁটি ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে তাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করল। মতি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আমি কী করেছি ভাই, আমাকে ব্যথা দেও কেন?”
“ব্যথা দিচ্ছি না, জাগানোর চেষ্টা করছি। তোমার কী হয়েছে?”
“কিছু হয় নি।”
“তুমি জান পত্রিকায় আমাদের ছবি চাপা হয়েছে?”
মতি বলল, “বাহ, কি মজা!” তারপর মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বদির ঘাড়ে মাথা রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
বদি আর কোনো উপায় না দেখে মতিকে ধরে প্রায় টেনে হেঁচড়ে নিতে থাকে। রেস্টুরেন্টের বেশ কিছু লোকজন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, কয়েক জনের হাতে পত্রিকা। বদি কারো চোখের দিকে না তাকিয়ে মতিকে টানতে টানতে প্রায় দৌড়িয়ে গিয়ে গাড়িতে ঢুকল এবং গাড়ি স্টার্ট করে সাথে সাথে বের হয়ে গিয়ে বলল, “ওহ! কী বাঁচা বেঁচে গেছি।”
জরিনাও বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, “একেবারে কানের কাছে দিয়ে গুলি গেছে।”
বদি বলল, “পত্রিকায় কী লিখেছে পড় দেখি।”
জরিনা বলল, “গাড়ি চালাতে চালাতে আমি পড়তে পারি না, আমার মাথা ঘোরায়।”
বদি বিরক্ত হয়ে বলল, “আহ! ঢং করো না। কী লিখেছে পড়।”
জরিনা তখন পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করে। তারা খুব অবাক হয়ে আবিষ্কার করল তাদের গোপন শলাপরামর্শের একটি অডিও ক্যাসেট বিশ্লেষণ করে পুলিশ নাকি তাদের সম্পর্কে সকল গোপন তথ্য যোগাড় করেছে। বদি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “অসম্ভব! আমাদের গোপন শলা পরামর্শের অডিও ক্যাসেট পুলিশের কাছে যেতেই পারে না।”
“কিন্তু নিশ্চয়ই গিয়েছে তা না হলে আমাদের তিন জনের কথা জানল কেমন করে?”
“কিন্তু এই কিডন্যাপের ব্যাপারটা কী আমরা তিন জন ছাড়া আর কেউ জানে?”
“না।”
“তা হলে কী তুমি বলতে চাও আমাদের তিন জনের মাঝে একজন ঘিড়িংগাবাজি করেছে?”
জরিনা কোনো কথা না বলে তীক্ষ্ণ চোখে একবার বদির দিকে আরেকবার মতির দিকে তাকাল। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলেল বলল, “যাই হোক, এখন আর পেছানোর কোনো রাস্তা নেই। কেউ গিড়িংগাবাজি করলে করেছে। যেভাবে পুরোটা প্ল্যান করেছি, এখন সেইভাবে এগুতে হবে।”
“মতিকে নিয়ে কী করব?”
“আরেকটু ঘুমাতে দাও তারপর নিশ্চয়ই ওঠে যাবে।”
“যদি না উঠে?”
“না উঠবে কেন? ঘুম থেকে তুলে দিলেই তো উঠবে।”
মেকু এরকম সময় তার মাড়ি বের করে হেসে মনে মনে বলল, “না গো সোনার চাঁদ এই মক্কেল আজ কিংবা আগামী কাল এই ঘুম থেকে উঠবে না! পরশু উঠলেও উঠতে পারে তবে কোনো গ্যারান্টি নাই।”
বদি পরবর্তী এক ঘণ্টা গাড়িতে ঘুরে বেড়াল, তার কোথাও থামতে সাহস হয় না, যেখানেই থামে সেখানেই মনে হয় কেউ একজন খবরের কাগজ হাতে তাদের দিকে সরু চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ঢাকা শহরের লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে তাদের কোনো লুকানোর জায়গা নেই – ব্যাপারটা এখনো তাদের বিশ্বাস হয় না।
শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা মতো বদি মীরপুর রোডে একটা শপিং সেন্টারের সামনে গাড়ি থামালো। এখানে মেকুকে কোলে নিয়ে জরিনা নেমে গেল।বদি চাপা গলায় বলল, “মোবাইলটা ঠিক আছে তো?”
জরিনা মাথা নাড়ল, বলল, “আছে।”
“আমার টেলিফোন পেলেই বাচ্চাটারে ছেড়ে দেবে।”
“ঠিক আছে। বদি এদিক সেদিক তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, “রিভলবারটা আছে তো?”
জরিনা ব্যাগ খুলে দেখে বলল, “আছে।”
“ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।”
“সাবধানে কাজ করো। ভয়ের কিছু নাই।” জরিনা মেকুর পিছনে একটা থাবা দিয়ে বলল, “এই ট্রাম্প কার্ড আমাদের কাছে, যতক্ষণ এই চিড়িয়া আমাদের হাতে আছে কেউ আমাদের কিছু করতে পারবে না।”
বদি মাথা নাড়ল, “কেউ কিছু করতে পারবে না।”
“যাও দেরি করো না।”
“যাচ্ছি।”
“শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখটা ঢেকে রাখবে, কেউ যেন চেহারা দেখতে না পারে।”
“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।” জরিনা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল, শুধু চোখ গুলি দেখা যাচ্ছে, এখন কেউ চেহারা দেখতে পারবে না।
“আমি গেলাম।”
“যাও।”
বদি জোর করে হাসার চেষ্টা করে গাড়ি স্টার্ট দিল, মুক্তিপণের টাকাটা তাদের কাছে দেওয়ার কথা নিউ মার্কেটে। সকাল বেলা এখনো নিশ্চয়ই সেখানে ভিড় শুরু হয় নি। ঠিকমতো কাজটা উদ্ধার করতে পারলে হয়।
গাড়িটা বাইরে পার্ক করে বদি মতিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তলার চেষ্টা করল, চুলের ঝুঁটি ধরে কয়েকবার ঝাঁকুনি দেওয়ার পড় মতি চোখ খুলে তাকাল, জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, “কী হয়েছে বাবা? আমাকে মার কেন?”
“নিউ মার্কেট এসে গেছি।” বদি চাপা গলায় বলল, “এখন উঠ।”
“আমি তো উঠেই আছি।”
“ড্রাইভিং সিটে বস।” বদি চাপা গলায় বলল, “আমি যখন মুক্তিপণ নিয়ে আসব, তখন তুমি ড্রাইভ করবে।”
মতি আধো আধো চোখ খুলে বলল, “ঠিক আছে।”
বদি তাকে ঠেলে গাড়ি থেকে বের করে ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে দিল। মতি স্টিয়ারিঙে মাথা রেখে আমার ঘুমিয়ে পড়ল। বদি বিরক্ত হয়ে বলল, “এখন ঘুমালে হবে না, জেগে থাকতে হবে।” মতি চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে বলল, “আমি তো জেগেই আছি।”
“ঠিক আছে। জেগেই থাক।”
বদি গাড়ি থেকে নামল। এক পকেটে রিভলবার অন্য পকেটে মোবাইল টেলিফোন। এই অপারেশনে দুটোই দরকার হবে। বদি লম্বা লম্বা পা ফেলে নিউমার্কেটের ভিতরে ঢুকল, কিছুক্ষণের মাঝেই বছর খানেক নিশ্চিন্তে থাকার মতো টাকা এসে যাবে। ঠিক মতো পুরো ব্যাপারটা করতে পারবে তো? বদির বুকের ভিতর ধুক ধুক করতে থাকে। সে হেঁটে হেঁটে পশ্ছিম পাশে বইয়ের দোকানগুলির দিকে যেতে থাকে, টাকার ঝোলা নিয়ে সেখানেই আসার কথা।