মেকুর কথা শেষ হবার আগে জরিনা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বিছানা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে তারপর হামাগুড়ি দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়, কোনোভাবে দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে পাশের ঘরের দরজায় দমাদম লাথি মারতে থাকে। হাসির চোটে মেকুর প্রায় পেট ফেটে যাবার অবস্থা হল, সে পেট চেপে একা একাই খিক খিক করে হাসতে লাগল।
কিছুক্ষণের মাঝেই মতি বদি এবং তাদের পিছু পিছু জরিনা এসে ঢুকল। ঘরে এসে আলো জ্বালিয়ে আবার ঘরের চারিদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হল, কোথাও কিছু নেই। জরিনা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলেল বলল, “আমি এই ঘরে থাকব না। এই ঘরের দোষ আছে।”
মতি বলল, “এই ঘরে থাকবে না কারণ এইখানে ভূত আছে। ওই ঘরে থাকবে না কারণ সেখানে মাকড়শা আছে। তুমি তা হলে থাকবে কোথায়?”
“আমি মাকড়শার সাথেই থাকব। কিন্তু ভূতের সাথে থাকব না।”
“ঠিক আছে তুমি তা হলে বাচ্চাটাকে নিয়ে ওই ঘরে যাও। আমি আর বদি এই ঘরে থাকি।”
জরিনা মাথা নাড়ল, “না না। আমি একলা থাকতে পারব না। আমার সাথে বড় একজনের থাকতে হবে। এই দেখ ভয়ে এখনো আমার হাত-পা কাঁপছে।”
বদি এবং মতি দুজনেই দেখল জরিনার হাত তির তির করে কাঁপছে, মুখ ফ্যাকাশে, উসকোখুসকো চুল এবং কিছুক্ষণের মাঝেই চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। মতি চিন্তিত মুখে বলল, “ঠিক আছে বদি তুমি জরিনার সাথে ওই ঘরে থাক। আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে এই ঘরে থাকি।”
মেকু চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে দেখল জরিনা আর বদি পাশের ঘরে গিয়েছে। মতি তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। হাতের রিভলবারটা টেবিলের ওপর রেখে ঘরের আনাচে কানাচে পরীক্ষা করে লাইট নিবিয়ে নিজের বিছানায় গিয়ে ঢুকে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। পুরো ব্যাপারটা যেভাবে যাওয়ার কথা সেটা মোটেও সেভাবে যাচ্ছে না। পদে পদে বাধা।
মতির চোখে যখন প্রায় ঘুম নেমে এসেছে হঠাৎ করে সে একটা বিচিত্র শব্দ শুনল, একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ। তারপর মেয়েলি গলায় কে যেন স্পষ্ট গলায় ডাকল, “মতি, এই মতি—”
মতি লাফিয়ে উঠে বসে। ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কে?”
মেকু চোখের কোনা দিয়ে মতিকে লক্ষ করল, তার কাছে একটা রিভলবার আছে আবার গুলি না করে দেয়। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে সুর করে বলল,
“মতি রে মতি
তোর নাই গতি
এক কামড়ে ছিঁড়ে নিব
তোর কানের লতি—”
মেকুর গানের গলা ভালো না, সুরও খুব আছে বলে মনে হয় না, গানের কথাও খুব উচু দরের না কিন্তু সব মিলিয়ে তার ফল হল ভয়ানক। মতি চিৎকার করে কলমা পড়তে পড়তে দরজার দিকে ছুটে গেল, দরজাটা বন্ধ সে কথাটা তার মনে নেই সেখানে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে সে উলটো দিকে আছাড় খেয়ে পড়ল। কাছাকাছি একটা পলকা চেয়ার ছিল সেটা ভেঙে মতি একেবারে মেঝেতে কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল। মেকু সুযোগ ছাড়ল না, আবার নতুন উৎসাহে গেয়ে উঠল,
“মতি মতি মতি
তুই যদি তেলাপোকা হতি
কী হতো রে ক্ষতি?”
মতি শুয়ে থাকা অবস্থা থেকে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে আবার দরজার দিকে ছুটে গেল। প্রচণ্ড জোরে দরজায় আঘাত করে এবারে দরজার ছিটকিনি ভেঙে বের হয়ে গেল। “আঁ আঁ আঁ” করে চিৎকার করে সে পাশের ঘরের দরজার সামনে আছাড় খেয়ে পড়ল। সেখানে হাঁটু ভেঙে পড়ে থাকা অবস্থায় অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো কলমা পড়তে লাগল।
দরজা খুলে বদি এবং জরিনা বের হয়ে আসে, মতির বিকট চিৎকার এবং ছিটকিনি ভেঙে বের হয়ে আসার শব্দে হোটেলের আশেপাশের লোক এবং নিচে থেকে হোটেলের কর্মচারীরাও উঠে এল। জরিনা চাপা গলায় বলল, “মতি! কী শুরু করেছ? মানুষের ভিড় জমে যাচ্ছে দেখেছ?”
মতি তখনো থর থর করে কাঁপছে, কথা বলতে পারছে না। হাতের রিভলবারটা সেই অবস্থায় লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করল। বদি বলল, “মতি, আল্লাহ্র কালাম পড়ছ, ওজু আছে তো?”
মতি সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল, যা ব্যাপার ঘটেছে তাতে ওজু থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না। হোটেলের একজন কর্মচারী এগিয়ে এসে বলল, “কী ব্যাপার? মাতলামী করছে কেন?”
বদি বলল, “মাতলামী না। ভয় পেয়েছে।”
“ভয় পেয়েছে? কী দেখে ভয় পেয়েছে?”
জোড়ীণা বোল্ল, “ভূত।”
হোটেলের কর্মচারী অবাক হয়ে বলল, “ভূত?”
“হ্যাঁ। এই ঘরে কে যেন নাকী সুরে কথা বলে। ডাকাডাকি করে।”
মানুষজন হঠাৎ করে পিচিয়ে গেল। এক-দুইজন অনুচ্চ স্বরে আয়াতুল কুরসি পড়ে নিজেদের বুকে ফুঁ দিয়ে দিল। হোটেলের কর্মচারী আমতা আমতা করে বলল, “ভূত কীভাবে আসবে?”
জরিনা কঠিন গলায় বলল, “আমার কথা বিশ্বাস না করলে এই ঘরে কিছুক্ষণ থাকেন। পেটের ভাত চাউল হয়ে যাবে।”
“আপনার বাচ্চাটা কোথায়?”
তখন সবার মেকুর কথা মনে পড়ল। জরিনা বলল, “ওই ঘরে।”
“ভূতের সাথে রেখে এসেছেন? বাচ্চা ভয় পাবে না।”
মেকু তখন তার শরীর বাঁকা করে ভয়ংকর চিৎকারটা দেওয়া শুরু করল। তার মনে হল এরকম অবস্থায় এ ধরনের একটা ভয়ংকর চিৎকার দেওয়া হলে পরিবেশটা আরো জমজমাট হবে। বাচ্চা বিপদে পড়লে মায়েরা নিজের জীবন বিপন্ন করে ছুটে যায় কিন্তু এখানে সেরকম কিছু ঘটল না। জরিনা বদিকে খোঁচা দিয়ে বলল, “বদি যাও, দেখ কী হয়েছে।”
“আমি কেন যাব? তুমি যাও।”
হোটেলের কর্মচারী অবাক হয়ে বলল, “আপনারা কী রকম বাবা মা? নিজের বাচ্চার জন্যে কোনো মায়া দয়া নাই?”
বদি এবং জরিনা তখন একসাথে আমতা আমতা করতে শুরু করল, বলল, “না-মানে-ইয়ে-আসলে – কিন্তু—ইয়ে—মানে—”
হোটেলের কর্মচারী মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “আপনাদের সবকিছুই কেমন জানি সন্দেহজনক। কোথা থেকে একটা বাচ্চা এনেছেন। কে বাচ্চার মা কে বাবা তাও ঠিক করে বলতে পারেন না। একবার সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়েন। একবার ঘরে আগুন দিয়ে দেন। একবার বলেন ভূতের ভয় পেয়েছেন। আপনাদের বাচ্চা একা একা ঘরে চিৎকার করে কাঁদছে কেউ একবার দেখতেও যাচ্ছেন না। কী হচ্ছে এখানে?”
উপস্থিত অন্য সবাই মাথা নাড়ল এবং হঠাৎ করে মতি বদি জরিনা বুঝতে পারল ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। জরিনা বদিকে নিয়ে গেল মেকুকে দেখতে আর মতি নিজেকে সামলে নিয়ে যেটুকু অঘটন ঘটেছে সেটা সামলানোর চেষ্টা করতে লাগল। হোটেলের কর্মচারী অবিশ্যি সোজা মানুষ নয়, আরেকটু হলে সে পুলিশকেই খবর দিয়ে দিতে যাচ্ছিল, একেবারে কড়কড়ে দুইটা পাঁচ শ টাকার নোট দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে শান্ত করতে হল।