মেকুকে একটা বিছানায় শুইয়ে তার পাশে জরিনা বসে একটা সিগারেট টানছে। সিগারেটের দুর্গন্ধে মেকুর নাড়ি উলটো আসতে চায় কিন্তু কিছু করার নেই। মানুষ কেন যে এই দুর্গন্ধের জিনিসগুলি খায় কে জানে। সিগারেট টানা শেষ করে জরিনা তার ব্যাগ থেকে ওষুধের শিশিটা বের করল, শিশিটা খুলে সেখান থেকে একটা ট্যাবলেট হাতে নিয়ে শিশিটা বন্ধ করার জন্যে ছিপিটা লাগানর চেষ্টা করছিল, মেকু তখন বিছানায় শুয়ে থেকেই জরিনার হাতের কবজিতে গায়ের জোরে একটা লাথি কষালো। ওষুধের শিশিটা শুন্যে উড়ে গিয়ে সবগুলি ট্যাবলেট চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিছু ট্যাবলেট এসে পড়ল তার শরীরে, কিছু তার আশেপাশে।
জরিনা একটা চিৎকার করে মেকুর দিকে ছুটে এসে বলল, “বদমাইশ পাজি ছেলে! গলাটিপে মেরে ফেলব। একেবারে জানে শেষ করে ফেলব।”
মেকুর এক মুহূর্তের জন্যে মনে হল সত্যিই বুঝি জরিনা তার গলা টিপে ধরবে, সে তাড়াতাড়ি তার মাড়ি বের করে একটা হাসি দিল এবং এই হাসি দেখে জরিনা শেষ পর্যন্ত একটু নরম হল। সে নিচু হয়ে গজ গজ করতে করতে ট্যাবলেটগুলি তুলে নিতে শুরু করে। মেকু সেই ফাকে তার আশেপাশে পড়ে থাকা ট্যাবলেটগুলি তুলে নিতে শুরু করে, সব মিলিয়ে পাঁচটা ট্যাবলেট সে তার দুই হাতে মুঠি করে লুকিয়ে ফেলল। জরিনা মেঝে থেকে ট্যাবলেটগুলি তুলে বিছানায় পড়ে থাকা ট্যাবলেটগুলিও তুলে শিশিতে ভরে শিশিটা আবার ব্যাগে ভরে নেয়।
মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখল জরিনা একটা ট্যাবলেট খেয়ে লাইট নিবিয়ে তার বিছানায় গিয়ে শুয়েছে। ওষুধ খেয়ে শুয়েছে। নিশ্চয়ই কিছুক্ষণের মাঝে ঘুমিয়ে পড়বে। মেকু ইয়ে ইয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, এখনো তার দুই মাস হয় নাই আর মাঝে সে একি বিপদে পড়ল? তার আম্মা সত্যি সত্যি তাকে উদ্ধার করতে পারবেন তো?
মেকু শুনল জরিনা তার বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। মনে হচ্ছে ঘুম আসছে না। হোটেলের ঘরটা ছোট, দুটি বিছানা বেশ কাছাকাছি, আলো নিবিয়ে দেওয়ার পরও জানালা দিয়ে অল্প আলো এসে ঘরের মাঝে একটা আলো আঁধারি ভাব চলে এসেছে। কত রাত হয়েছে কে জানে, চারিদিক খানিকটা চুপচাপ হয়ে এসেছে। মেকুর কেমন জানি ভয় ভয় করতে থাকে। একা একা শুয়ে তার মন খারাপ হয়ে যায়। ইচ্ছে হয় চিৎকার করে একটু কেঁদে নেয়, মনে হয় শব্দ করে একটু কেঁদেও ফেলেছিল কারণ হঠাৎ জারিনা লাফিয়ে বসে ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কে?”
ঠিক তখন মেকুর মাথায় বুদ্ধিটা এল। আগে যতবার সে কথা বলেছে ততবারই মানুষেরা ভয় পেয়েছে, এখন ভয় দেখানোর জন্যেই কথা বললে কেমন হয়? মেকু চিন্তা করল কী বলা যায় – মানুষকে ভয় দেখানোর জন্যে কী বলতে হয় কে জানে? জরিনার নাম ধরে ডাকাডাকি করে দেখা যাক। মেকু যতটুকু সম্ভব গলার স্বর মোটা করে বলল, “ জরিনারে জরিনা —”
তখন যা একটা কাণ্ড হল সেটা আর বলার মতো না! জরিনা লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসে ভাঙা গলায় বলল, “কে? কে?”
মেকু গলার স্বর মোটা করে বলল, “আমি!”
“আমি কে?”
“আমারে তুমি চেনো না, হি- হি- হি –”
জরিনা তখন লাফিয়ে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করতে গিয়ে মশারিতে পা বেঁধে হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেল। একটা চিৎকার করে উঠতে গিয়ে টেবিলে মাথা ঠুকে গেল, অন্ধকারে কোনোমতে সে দরজার দিকে ছুটে যেতে থাকে, মেকু তখন আবার সুর করে গাইতে লাগল,
“জরিনারে জরিনা
কেন তরে ধরি না
ধরে কেন মরি না
ও জরিনারে জরিনা!”
জরিনা দরজায় মাথা ঠুকে খামচা খামচি করতে করতে কোনমতে দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। একটু পরে মেকু শুনতে পেল জরিনা পাশের ঘরে গিয়ে হাউ মাউ করে কান্নাকাটি করছে।
কিছুক্ষণের মাঝেই মতি এবং বদিকে নিয়ে জরিনা ফিরে এল। তিনজন খুব সাবধানে দরজা খুলে ভিতরে এসে ঢুকল, মতি এবং বদি দুজনের হাতেই একটা করে রিভলবার। জরিনা লাইট জ্বালাতেই মেকু চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে যাবার ভান করল। মতি এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল, “ এই ঘরে কেউ নাই।”
জরিনা বলল, “আমি জানি কেউ নাই।”
“তা হলে কে কথা বলবে?”
“আমি জানি না।”
“কোথা থেকে শব্দটা এসেছে?”
জরিনা মেকুর বিছানা দেখিয়ে বলল, “ওইদিক থেকে।”
“ওই দিকে তো কেউ থাকতে পারে না, খালি বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে।”
বদি মাথা নিচু করে মেকুর বিছানার নিচে তাকিয়ে বলল, “এই ঘরে কেউ নাই জরিনা। তুমি ভুল শুনেছে।”
“আমি ভুল শুনি নাই। আমি স্পষ্ট শুনেছি। বলেছে, জরিনারে জরিনা –”
মতি ভুরু কুঁচকে বলল, “গলার স্বর কী রকম?”
জরিনা দুর্বল গলায় বলল, “নাকী গলার স্বর। মেয়েদের মতন।”
“মেয়েদের মতন?” মতি অবাক হয়ে বলল, “মেয়েদের গলায় কে কথা বলবে?”
জরিনা কাঁপা গলায় বলল, “আমার মনে হয় এই ঘরটায় দোষ আছে।”
বদি অবাক হয়ে বলল, “ঘরের আবার দোষ থাকে কেমন করে?”
মতি গম্ভীর গলায় বলল, “ কোনো ঘরে ভূত প্রেত থাকলে বলে ঘরে দোষ আছে।”
বসি এবারে ঘাবড়ে গেল, বলল, “এই ঘরে ভূত আছে?”
“ধুর!” মতি হাত এরে বলল, “ভূত আবার কোথেকে আসবে?”
“তা হলে আমি কী শুনেছি?”
“ভুল শুনেছ।”
জরিনা রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলল, “আমি ভুল শুনি নাই। স্পষ্ট শুনেছি।”
মতি ঠোটে আঙুল দিয়ে বলল, “আস্তে কথা বল। এই বাচ্চা ঘুমিয়েছে, ওঠে গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে।”
জরিনা গলা নামিয়ে বলল, “আমি স্পষ্ট শুনেছি। কোনো ভুল নাই।”
মতি বলল, “তুমি কী ঘুমের ওষুধটা খেয়েছিলে?”
“হ্যাঁ। একটা ট্যাবলেট খেয়েছি।”
মতি গম্ভীভাবে মাথা নেড়ে বলল, “মনে হয় ওষুধের জন্যে হয়েছে। হেলুসিনেশান হয়েছে।”
জরিনা মুখ শক্ত করে বলল, “আমার হেলুসিনেশান হয় নাই।”
বদি বিরক্ত হয়ে বলল, “ তাহলে কী তুমি বলতে চাও এই বাচ্চাটা ঘুমের মাঝে তোমাকে নিয়ে গান গাইছে?”
জরিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, আমি সেটা বলছি না।”
“তা হলে এটা নিয়ে আর কথা বলে কাজ নেই। কাল অনেক কাজ, এখন ঘুমাও। তোমার যদি ভয় লাগে তা হলে আমি এই ঘরে ঘুমাই।”
ভয় লাগার কথা বলায় জরিনার আত্মসম্মানে একটু আঘাত লাগল। সে বলল, “না, ঠিক আছে। আমিই ঘুমাব।”
বদি আর মতি বের হয়ে যাবার পড় জরিনা দরজা বন্ধ করে পুরো ঘরটা আবার ভালো করে পরীক্ষা করে বিছানায় বসে একটা সিগারেট খেল। তারপর লাইল নিভিয়ে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। মেকু আবার চোখ খুলে তাকাল, ভয় দেখানোর ব্যাপারটি সে যতটুকু আশা করছিল তার থেকে অনেক ভালোভাবে কাজ করেছে। ঘুমানোর আগে আরো একবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
মেকু বেরশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। যখন মনে হল জরিনা প্রায় ঘুমিয়ে যাচ্ছে তখন সে আবার সুর করে ডাকল, “জরিনা-আআআআআআ—-”
মেকুর ডাক শুনে জরিনা এক লাফ দিয়ে বিছানা থেকে ওঠে বসে। এবারে সে আগেরবার থেকেক বেশি ভয় পেয়েছে। মেকু আবার সুর করে গাইল,
“জরিনা…আ্…আ…আ…আ…আ…আ………”
তোরে ছাড়া নড়ি না…আ…আ…আ…আ…আ…আ…………”