ঘণ্টা খানেক পর মতি টেলিফোন করল। টেলিফোনের অন্যপাশে ইলিয়াস আলীর চিৎকার এবং আহাজারি শোনার কথা ছিল। কিন্তু খুব পরিতৃপ্ত একজন মানুষের গলা শোনা গেল। মানুষটা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “হ্যালো।”
“ইলিয়াস আলী সাহেব।”
ইলিয়াস আলী বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ । কে আপনি কী চান?”
“প্রশ্নটা কী আমারই করার কথা না? কী চান?”
ইলিয়াস আলী ধমক দিয়ে বললেন, “ঢং রেখে কী বলতে চান বলে ফেলেন।”
মতি থতমত খেয়ে বলল, “আমি আপনার ছেলের কথা বলতে চাচ্ছি।”
“আমার ছেলের কী কথা?”
মতি হঠাৎ করে চুপ করে যায়। মনে হচ্ছে কোথাও কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। ইলিয়াস আলী টেলিফোনে আবার ধমক দিল, “কী হল? কথা বলছেন না কেন?”
“আপনার ছেলে কোথায়?”
“আমার ছেলে আমার পেটের উপর শুয়ে আছে। কেন?”
মতির মুখ হাঁ হয়ে গেল, “আপনার ছেলে আপনার পেটের উপর শুয়ে আছে?”
“হ্যাঁ। কেন কী হয়েছে?”
“আপনি – আপনি কী মগবাজারের তারানা ফ্ল্যাটে থাকেন?”
“হ্যাঁ। কেন কী হয়েছে?”
“তিন তলায়? লিফট থেকে নেমে বাম দিকে?”
“তিন তলায় না থার্ড ফ্লোরে। তার মানে চার তলায়। লিফট থেকে নেমে বাম দিকে।”
মতির চোয়াল ঝুলে পড়ল। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “থা-থা-থার্ড ফ্লোর? তা হলে তি-তি-তিন তলায় কে থাকে?”
“জানি না। আপনার এত খোঁজ নিয়ে কী দরকার?”
“আ-আ-আপনি জানেন না কে থাকে?”
“না। আমি এখানে থাকি না, কে কোথায় থাকে জানি না – আপনার জানার দরকার থাকে আপনি নিজে গিয়ে খোঁজ নেন।” কথা শেষ করার আগেই ইলিয়াস আলী খট করে টেলিফোনটা রেখে দিল।
মতি কিছুক্ষণ মোবাইল টেলিফোনটার দিকে তাকিয়ে রইল, তার মুখ দেখে মনে হতে লাগল এই টেলিফোনটা বুঝি সব সর্বনাশের মূল। জরিনা কোমরে দুই হাত রেখে মতির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “ বাসাটা ছিল চার তলায় তুমি আমাদের পাঠিয়েছ তিন তলায়?”
মতির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলল, “ইয়ে মানে আমি তো থার্ড ফ্লোরই বলেছিলাম। কিন্তু আসলে থার্ড ফ্লোর মানে যে চার তলা – ”
বদিও মতির সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, “তুমি থার্ড ফ্লোর বল নাই, তুমি তিন তলা বলেছ। আমার স্পষ্ট মনে আছে বলেছ তিন তলা।”
মতি কঠিন মুখে বলল, “চিৎকার করছ কেন?”
“চিৎকার করব না তো কী গান গাইব? লাইফ রিস্ক নিয়ে গেলাম বাচ্চা কিডন্যাপ করতে এখন তুমি বলছ ভুল বাসা থেকে ভুল বাচ্চা নিয়ে এসেছি। রং করার জায়গা পাও না? ঢং করার জায়গা পাও না?”
“দেখ বদি, মুখ সামলে কথা বলবে।”
“কেন আমি মুখ সামলে কথা বলল? তুমি কে যে তোমার সামনে আমার মুখ সামলে কথা বলতে হবে?” বদি চিৎকার করে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করে নিচে কথাবার্তা শোনা যায়। জরিনা জানালার কাছে গিয়ে হঠাৎ করে চাপা স্বরে বল, “চুপ।”
সাথে সাথে ভিতরে দুজনেই চুপ করে গেল। মতি ফিসফিস করে বলল, “কে?”
জরিনা নিচু গলায় “পুলিশ”
মতি এক লাফে জানালার কাছে এসে বলল, “পুলিশ কী করছে?”
“গাড়িটাকে দেখছে।”
তিন জনেই জানালায় পর্দার ফাঁক দিয়ে নিচে তাকিয়ে থাকে। অনেকগুলি পুলিশ বাসার সামনে, কয়েক জন তাদের বাসার দিকেতাকিয়ে আছে কয়েকজন গাড়িটাকে দেখছে। বদি মুখ শুকনো করে বলল, “ব্যাপারটা কী?”
মতি বলল, “বুঝতে পারছি না। বদি তুমি যাও তো নিচে গিয়ে দেখে আস ব্যাপারটা কী?”
“আমি? আমি কেন?”
“তা হলে কে যাবে?”
বদি বলল, “তুমি যাও।”
মতি চোখ লাল করে বলল, “যদি কোনো ইমারজেন্সি হয় তা হলে কে সামলাবে? তুমি? তোমার মাথায় সেইটুকু ঘিলু আছে? যাও, দেখে আস। নিশ্চয়ই অন্য কোনো ব্যাপার। পুলিশ মনে হয় কোনো কিছু রুটিন চেক করতে এসেছে।”
বদি গজ গজ করতে করতে নিচে নেমে গেল এবং দুই মিনিট না যেতেই প্রায় ছুটে উপরে উঠে এল। তার মুখ ফ্যাকাশে এবং রক্ত শুন্য। মতি ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“পুলিশ আমাদের খুঁজেছে।”
“আমাদের? আমাদের কেন খুঁজেছে? কোথা থেকে খবর পেল?”
“এই বাসার সামনে নাকি একটা প্যাকেট খুঁজে পাওয়া গেছে। সেই প্যাকেটে বাচ্চার ছবি আর বাসার ঠিকানা লেখা ছিল।”
মতি দুর্বল গলায় বলল, “বাসার সামনে প্যাকেট কীভাবে এল?”
জরিনা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তিন তলা আর থার্ড ফ্লোর যেভাবে হয়েছে সেইভাবে!”
মতি বিষ দৃষ্টিতে জরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “কাজের কথা যদি কিছু বলতে পার তা হলে বল।”
বদি জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বলল, “মগবাজারের সেই ফ্ল্যাটের সামনে যে দারোয়ান ছিল সেই ব্যাটা পুলিশের কাছে আমাদের বর্ণনা দিয়েছে, আমাদের গাড়ির বর্ণনা দিয়েছে।”
“সর্বনাশ!” মতি বলল, “তা হলে এই গাড়িটাও গেল!”
জরিনা বলল, “শুধু গাড়ি না আমরাও গেছি।”
“তা হলে?”
“এক্ষুনি পালাতে হবে। তাড়াতাড়ি চল, পিছন দিকে একটা রাস্তা আছে।”
তিন জন ছুটে পালাতে গিয়ে থেমে গেল, বিছানায় শুয়ে থাকা মেকুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আর এই বাচ্চাটাকে কী করব?”
জরিনা বলল, “সাথে নিতে হবে।”
বদি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “সাথে নিতে হবে ? কেন?”
“যদি পুলিশ এসে বাচ্চাটাকে পেয়ে যায় তা হলে আমাদের কোনো উপায় নাই। যদি না পায় তবু একটা আশা আছে। তা ছাড়া – ”
“তা ছাড়া কী?”
“বাচ্চাটাকে কিডন্যাপ করেছি, কিছু টাকাও আদায় করব না? দশ লাখ না হোক পাঁচ লাখ। পাঁচ লাখ না হোক দুই লাখ? বাবা-মা কি বাচ্চার জন্যে দুই লাখ টাকাও দেবে না?”
মতি মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছ।”
বদি ভয়ে ভয়ে বলল, “কিন্তু মনে নাই বাচ্চা কীভাবে চিৎকার দেয়? শরীর বাঁকা করে এখন যদি একটা চিৎকার দেয় তা হলে পুলিশ জেনে যাবে না?”
জরিনা বলল,”সেইটা তুমি আমার হাতে ছেড়ে দাও। হাতটা রাখব এর গলায়, যদি চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করে সাথে সাথে গলা চেপে ধরব। দেখি বাচ্চার কত তেজ।”
মেকু বিছানায় শুয়ে শুয়ে এতক্ষণ সবার কথা শুনছিল, পুলিশ এসেছে শুনে মনে মাঝে একটু আশাও হয়েছিল কিন্তু জরিনার কথা শুনে তার সব আশা শেষ হয়ে গেল। এই মহিলার চোখের দিকে তাকালেই কেমন জানি ভয় করে, মেরুদণ্ড শির শির করতে থাকে। তার গলায় হাত রেখে দরকার হলে চাপ দিয়ে একেবারে মেরে ফেলতেও তার কোনোই সমস্যা হবে না।
দরজা খুলে বের হতে গিয়ে মতি হঠাৎ থেমে গেল। বদির দিকে তাকিয়ে বলল, “বদি, একটা কাজ করে?”
“কী?”
“বাচ্চার জিনিসপত্র গুলি নিয়ে এস।”
“কেন?”
“তা না হলে আবার কিনতে হবে। এখন যেরকম অবস্থা কেনা-কাটা করার জন্যে আর বাইরে যেতে পারব না।”
বদি গজ গজ করে বলল, “আমাকে কেন আনতে হবে? তুমি কেন আনতে পারবে না?”
“কারণ কোনো ইমারজেন্সি হলে কে দেখবে? তুমি? তোমার মাথায় সেই পরিমাণ ঘিলু আছে?”
কথায় কথায় তার মাথায় ঘিলু নিয়ে খোঁটা দেওয়াটা বদির একেবারেই পছন্দ হল না। কিন্তু এখন আর সেটা নিয়ে তর্ক করার সময় নেই।
একটু পর দেখা গেল বাসার পিছনে একটা গলি দিয়ে প্রথমে মতি তারপর মেকুকে কোলে নিয়ে জরিনা এবং সবার শেষে এক হাতে ব্যাগ অন্য হাতে এক কাঁদি কলা নিয়ে বদি হন হন করে ছুটে যাচ্ছে। বড় রাস্তায় এসে তারা একটা স্কুটার থামিয়ে সেটাতে উঠে পড়ল। তিন জন বড় মানুষ এবং একটা ছোট বাচ্চা বেশ গাদাগাদি করে স্কুটারে বসেছে। হাতের ব্যাগটাও চাপাচাপি করে রাখা হল। কিন্তু কলার কাঁদিটা রাখার জায়গা হচ্ছিল না। জরিনা বিজলি দিয়ে বলল, “তুমি এই কলাগুলি কোন আক্কেলে নিয়ে এসেছ?”
“খিদে লেগেছে তাই এনেছি।”
“তুমি দশ মিনিট হল ঠেসে খেয়েছ। এখন আমার খিদে লেগেছে?”
“আমি টেনশনে থাকলেই আমার বেশি খিদে লাগে।”
কথাটা সত্যি প্রমাণ করার জন্যে বদি একটা কলা ছিঁড়ে খেতে শুরু করল। স্কুটারের গাদাগাদি ভিড় এবং ঝাঁকুনির মাঝে কলা খাওয়ার ব্যাপারটি এত সোজা নয় কিন্তু বদির নিশ্চয়ই বেশ ভালোই খুদে পেয়েছে সে দেখতে দেখতে কলাটা শেষ করে ফেলল। সে মাঝে বসেছে বলে কলার ছিলকেটা ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে বেশী সুবিধে করতে পারল না। মতি ধমক দিয়ে বলল, এখন স্কুটার থেকে কলার ছিলকে ফেল না, কেউ একজন আছাড় খাবে।”
“আছাড় খেলে খাবে।”
“না । কোনো সন্দেহজনক কাজকর্ম না।”
বদি ঠিক বুঝতে পারল না কলার ছিলকে ফেলা কেন সন্দেহজনক কাজকর্ম হবে, কিন্তু সেটা নিয়ে তর্ক করার ইচ্ছে করল না। সে এক হাতে কলার কাঁদি অন্য হাতে কলার ছিলকে নিয়ে বসে রইল। মেকু কিছুক্ষণ কলার ছিলকেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। অস্ত্র হিসেবে কলার ছিলকে জিনিসটা মন্দ নয়, এটা হাতে নিয়ে রাখলে ভালই হয়। মেকু হাত বাড়িয়ে কলার ছিলকেটা নেওয়ার চেষ্টা করল, কাজটি খুব সোজা নয় কিন্তু ঝাঁকুনির কারণে একটা সুযোগ পেয়ে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছিলকেটা নিজের কাছে নিয়ে নিল।
জরিনা বিরক্ত হয়ে বলল, “কী হল? এই বাচ্চাটার হাতে তুমি কলার ছিলকে দিয়েছ কেন?”
“আমি দেই নাই সে নিয়েছে।”
“এই বাচ্চার বয়স মাত্র দুই মাস, সে নিজে থেকে কিছু নিতে পারে না। কিছু করলে সেটা না বুঝে করে।”
“ঠিক আছে বাবা নিয়ে নিচ্ছি।” বলে বদি কলার ছিলকেটা নেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু মেকু তখন তার শরীর ঝাঁকিয়ে গলা ফাটিয়ে সেই ভয়ংকর চিৎকারটা শুরু করল। সেই চিৎকার এতই ভয়ংকর যে স্কুটার ড্রাইভার তাড়াতাড়ি রাস্তার পাশে স্কুটার থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
বদি তাড়াতাড়ি কলার ছিলকে থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “না, না কিছু না।”
কাজেই মেকু কলার ছিলকেটা দুই হাতে শক্ত করে ধরে রাখল। কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সে এটা কাজে লাগাবে।
মেকুকে নিয়ে এই তিন জন মহাখালীর কাছে একটা ঘিঞ্জি হোটেলে এসে থামল। তিন তলায় দুইটা রুম ভাড়া করে তিন জন উপরে উঠতে শুরু করে। মেকু তখনো দুই হাতে কলার ছিলকেটা ধরে রেখেছে, এটাকে ঠিক সময়ে ব্যবহার করতে হবে। সিঁড়িতে ওঠার সময় মেকু সেই ‘ঠিক সময়’টা পেয়ে গেল। সিঁড়িতে প্রথমে জরিনা মেকুকে নিয়ে উঠেছে, তারপর বদি এবং সবশেষে মতি। মেকু চোখের কোনা দিয়ে পুরো অবস্থাটা দেখল তারপর হাত থেকে ছিলকেটা ঠিক বদির পায়ের তলায় ফেলেল দিল।
তখন যা একটা ঘটনা ঘটল তার কোনো তুলনা নেই। সমান জায়গাতেই কলার ছিলকে নিয়ে মানুষ ভয়ংকর আছাড় খেয়ে থাকে। খাড়া সিঁড়িতে সেই আছাড় আরো এক শ গুণ বেশী ভয়ংকর। বদির পায়ের নিচে কলার ছিলকে পড়ার সাথে সাথে হঠাৎ করে পা হড়কে সে মুখ থুবরে নিচে পড়ল, শক্ত সিঁড়িতে মুখ লেগে সাথে সাথে তার একটা দাঁত ভেঙে গেল। বদির হাতের ব্যাগ এবং কলার কাঁদি শুন্যে উড়ে যায় এবং সে নিজে উলটে পালটে নিচে পড়তে থাকে। ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মতি বদির প্রচণ্ড ধাক্কায় গড়িয়ে পড়ল এবং তারপর কখনো মতি এবং কখনো বদি এইভাবে তারা খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়তে থাকে। মেকু জরিনার কোলে বসে তাদের আর্তচিৎকার শুনতে থাকে। একটা মাত্র কলার ছিলকে দিয়ে এত বড় একটা কাণ্ড করা যেতে পারে সেটা মেকুর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
দুর্ঘটনাটা ঘটেছে তিন তলার কাছাকাছি, বদি আর মতি সেখান থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে প্রথমে দুইতলা এবং শেষে এক তলায় এসে থামল। তাদের কপাল ভালো দুইজনকে চিৎকার করে গড়িয়ে পড়তে দেখে হোটেলের একজন কর্মচারী কোলাপসিবল গেইটটা বন্ধ করে দিয়েছিল, তা না হলে দুইজনেই গড়িয়ে গড়িয়ে একেবারে বাইরে রাস্তায় গিয়ে পড়ত এবং একটা দোতলা বাস চাপা দিয়ে তাদের চেপটা করে ফেলত।
হোটেলের কর্মচারী এবং বোর্ডাররা সবাই ভিড় করে দেখতে এল, জরিনাও ওপর থেকে আবার নিচে নেমে আসে। মতি এবং বদি নাম মুখ খিচিয়ে অনেক কষ্টে উঠে বসে। বদি থুঃ করে থু তু ফেলতেই একটা দাঁত বের হয়ে এল। মতি উঠে বসে আবিষ্কার করল কপালের কাছে ফুলে গিয়ে তার বাম চোখটা বুজে এসেছে। তার ডান হাতটা নাড়তে পারছিল না, মনে হয় সকেট থেকে খুলে এসেছে। বদি দাঁড়ানোর চেষ্টা করে আবার বসে পড়ল, তার পা মচকে গিয়েছে।
হোটেলের ম্যানেজার বলল, “এই রকম ঘটনা আর দেখি নাই। এক সাথে দুইজন আছাড় খেয়ে তিন তলা থেকে একেবারে একতলায়!”
জরিনা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বদি আর মতির দিকে তাকিয়ে বলল, “বুড়োধাড়ি দুই জন মানুষ কখনো এইভাবে আছাড় খায়?”
বদি হিংস্র চোখের মেকুর দিকে তাকিয়ে বলল, “এই বদমাইস বাচ্চা ইচ্ছা করে এইটা করেছে। আমি স্পষ্ট দেখেছি ইচ্ছা করে আমার পায়ের তলায় কলার ছিলকা ফেলেছে!”
জরিনা ধমক দিয়ে বলল, “বাজে কথা বলো না। দুই মাসের বাচ্চার কোন মোটর কো অর্ডিনেশান থাকে না।”
বদি দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “ এই পাজি ছেলের শুধু মোটর কো অর্ডিনেশান না ট্যাংক কো অর্ডিনেশান আর প্লেন- কো অর্ডিনেশানও আছে। আমি এই বাচ্চারে গলা টিপে শেষ করব।”
হোটেলের ম্যানেজার বলল, “এই বাচ্চা আপনাদের কী হয়? মাসুম একটা বাচ্চাকে গলা টিপে মারতে চাচ্ছেন কেন?”
বদি আমতা আমতা করতে লাগল, জরিনা সামলে নিয়ে বলল, “এটা আমার বাচ্চা। কেউ বাচ্চাকে মারতে চাইছে না, রেগে গেছে বলে এরকম বলছে।”
“মাসুম বাচ্চাকে নিয়ে এরকম কথা বলা ঠিক না।”
জরিনা বদি আর মতির কাছে গিয়ে বলল, “তোমরা দাঁড়াতে পারবে কি? নাকি টেনে তুলতে হবে?”
দুজনে অনেক কষ্টে দাঁড়াল। মতি মুখ বিকৃত করে বলল, “হাঁটতে পারব বলে মনে হয় না।”
হোটেলের ম্যানেজার তার কয়েক জন কর্মচারীকে বলল, “এই স্যারদের ওপরে তুলে দিয়ে আয়।”
দুই জন মতিকে চ্যাংদোলা করে ওপরে তুলতে থাকে। বদিকে দুজন মিলে টানাটানি করে বেশী সুবিধে করতে পারে না, শেষ পর্যন্ত জরিনাও হাত লাগায় এবং অনেক কষ্টে তাকে টেনে ওপরে নিয়ে যায়। হোটেল রুমের দরজা খুলে তিন জন যখন মেকুকে বিয়ে ভিতরে ঢুকেছে তখন কারো গায়ে আর কোন ও শক্তি অবশিষ্ট নেই।
০৫. ফন্দি ফিকির – মেকু কাহিনী
ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে বলে আবার একটা মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। মেকুকে বিছানায় শুইয়ে রেখে আবার মতি, বদি আর জরিনা গোল হয়ে বসেছে। চব্বিশ ঘণ্টা আগে তারা যখন এভাবে বসেছিল তখন তাদের মাঝে উৎসাহ ছিল। এখন তাদের মাঝে উৎসাহের ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট নেই।
বদি চেয়ারে সোজা হয়ে বসতে পারছিল না, খানিকটা বাঁকা হয়ে বসে বলল, “আমি এখনো বলছি এই হতচ্ছাড়া পাজি বাচ্চাটাকে জানালা দিয়ে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাড়ি যাই।” তার মুখের সামনের একটা দাঁত পরে যাওয়ায় কথাগুলি বলার সময় মুখ থেকে বাতাস বের হয়ে কথাটা কেমন যেন বিচিত্র শুনায়।
জরিনা বদির দিকে তাকিয়ে বলল, “কী বললে? বাড়ি যাবে? তোমার বাড়িতে গিয়ে দেখ এখন পুলিশ বসে আছে!”
বদি হতাশভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “ঠিকই বলেছ।” তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, “এই কিডন্যাপ করতে গিয়ে আমাদের কী লাভ হয়েছে?”
মতি তার বুজে যাওয়া চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে করতে বলল, “এখনো হয় নাই। কিন্তু -”
জরিনা বলল, “আমার হিসাবে মাইনাস তিন লাখ টাকা।”
“মাইনাস?”
“হ্যাঁ। কারণ এখন পর্যন্ত শুধু ক্ষতি। বাড়ি গেছে, গাড়ি গেছে এখন তোমাদের দুই জনের চিকিৎসা করতে গিয়ে কত যাবে কে জানে!”
বদি তার একটা পা সোজা করার চেষ্টা করতে করতে বলল, “ঠিকই বলেছ।”
জরিনা মতির দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন কী করবে বল?”
“প্রথমে এই বাচ্চার বাসার টেলিফোন নম্বর দরকার।”
“হ্যাঁ। কিন্তু কীভাবে পাবে সেটা? তোমাদের যে অবস্থা এখান থেকে তো বেরই হতে পারবে না।”
মতি পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোন বের করে বলল, “বের হতে হবে নয়া। এখান থেকেই বের করতে পারব। তিন চারটা টেলিফোন করলেই বের হয়ে যাবে।”
গত কয়েক ঘণ্টায় অবস্থা যেদিকে গিয়েছে মতির কাজকর্মে কারো সেরকম বিশ্বাস নেই কিন্তু দেখা গেল মতি সত্যি সত্যি মেকুর আব্বা আম্মার টেলিফোন নম্বর বের করে নিল। টেলিফোন নম্বরটা একটা কাগজে লিখে মতি যখন সেই নম্বরে ডায়াল করতে যাচ্ছিল তখন বদি বলল, “মতি তুমি করো নয়া। তুমি হচ্ছ কুফা।”
মতি খুব রেগে গেল, বলল, “কুফা? আমি কুফা? তুমি যান আমি এই পর্যন্ত কয়টা কিডন্যাপ কেস করেছি?”
“করে থাকলে করেছ। কিন্তু এই কেসটা তো দেখছ কী হচ্ছে।”
“সেটা কী আমার দোষ?”
“কার দোষ আমি জানি নয়া, কিন্তু তুমি টেলিফোন করতে পারবে নয়া। কারণ তুমি হচ্ছ কুফা। হয় আমি টেলিফোন করব নয়া হয় জরিনা।”
জরিনা বলল, “ঠিক আছে আমিই করছি।”
মতি অত্যন্ত বিরস বদনে টেলিফোনটা জরিনার কাছে এগিয়ে দিল। জরিনা ফোনটা হাতে নিয়ে ডায়াল করতে গিয়ে থেমে গেল, মতি এবং বদির দিকে তাকিয়ে বলল, “ইলিয়াস আলীর বাচ্চাটা ছেলে ছিল। এইটা কী ছেলে ননা মেয়ে?”
তিন জনেই মেকুর দিকে তাকাল, সত্যি সত্যি কারো এটা জানা নেই। ছোট বাচ্চার চেহারা দেখে সে ছেলে না মেয়ে বোঝার কোনো উপায় নেই, সেটা নিঃসন্দেহ হতে হলে ন্যাপি খুলে দেখতে হবে। বদি বলল, “দাঁড়াও দেখছি।”
বদি তার মচকে যাওয়া পায়ে ভর দিয়ে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে মেকুর কাছে এগিয়ে যায়, তার ন্যাপি ধরে টানাটানি করতে থাকে। মেকু এত বড় অপমান এত সহজে মেনে নিতে রাজি হল না, সে দুই পা একত্র করে অপেক্ষা করতে থাকে। বদির মুখটা নাগালের মাঝে আসতেই জোড়া পায়ে সমস্ত গায়ের জোরে সেখানে প্রচণ্ড একটা লাথি কষিয়ে দিল। বদির মুখে এমনিতেই ব্যথা, দাঁত ভেঙে সেখানে ফুলে উঠেছে, তার উপর মেকুর জোড়া পায়ে লাথি খেয়ে সে যন্ত্রণায় কোঁক করে শব্দ করে পিছনে গড়িয়ে পড়ল। মুখে এবং মচকে যাওয়া পায়ে চেপে ধরে সে চিৎকার করে ওঠে। মতি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, “এই টুকুন বাচ্চার লাথি খেয়ে গড়িয়ে পড়লে এই লাইনে এসেছ কেন? তোমার হওয়া উচিত ছিল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর।”
বদি মুখে হাত চেপে রেখে হিংস্র গলায় বলল, “এই বাচ্চা সাক্ষাৎ ইবলিশ! আমি একে খুন করে ফেলব।”
মতি ধমক দিয়ে বলল, “বাজে কথা বল না। দুই মাসের বাচ্চা বুঝে শুনে কিছু করে না। ওরা তো হাত পা ছুঁড়বেই তুমি দূরে থাকতে পার না। মুখ নিয়ে এত কাছে যাবার দরকার কী?”
মতি এবারে নিজেই এগিয়ে গেল। নিজের মাথাটা মেকুর শরীর থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে রেখে সে সাবধানে তার ন্যাপি খুলে ফেলল। মেকু গত কয়েক ঘণ্টা থেকে বাথরুম করার সুযোগ পায় নি তলপেটে প্রচণ্ড চাপ নিয়ে বসে আছে। নিজের কাপড়েরও কিছু করে ফেলতে সাহস পাচ্ছে না, হয়তো ভিজে কাপড়েই সারা রাত শুয়ে থাকতে হবে। এইবার তলপেটের চাপ কমানোর সুযোগ পেয়ে আর দেরি করল না, মতির মুখের দিকে নিশানা করে কাজ সেরে ফেলল। মতি লাফিয়ে সসরে যাবার আগে সে ভিজে চুপসে গিয়েছে, এত যন্ত্রণার মাঝেও বদি খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলল, “এখন বিশ্বাস হয়েছে; এই ছেলে কত পাজি?”
জরিনাও হি হি করে হেসে বলল, “এই বাচ্চাও তা হলে ছেলে।”
মতি বিষ দৃষ্টিতে মেকুর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “হ্যাঁ, এই বাচ্চাও ছেলে। মহা বিচ্ছি ছেলে।”
জরিনা এইবারে টেলিফোনে ডায়াল করল, প্রায় সাথে সাথেই অন্য পাশে মেকুর আব্বার উদ্বিগ্ন গলার স্বর শোনা গেল, “হ্যালো।”
জরিনা বলল, “আমি কী প্রফেসর হাসান সাহেবের সাথে কথা বলতে পারি ?”
“জি। কথা বলছি।”
“চমৎকার হাসান সাহেব। আমি আপনার ছেলের বিষয় নিয়ে কথা বলতে ফোন করেছি।”
টেলিফোনের অন্যপাশে হঠাৎ করে আব্বা চুপ করে গেলেন, কয়েক মুহূর্ত পরে ভয় পাওয়া গলায় বললেন, “আপনি কে বলছেন?”
“সেটা জেনে আপনি কী করবেন।” আপনার ছেলে নিয়ে কথা বলতে চাইছি সেটা নিয়েই বলা যাক।”
“কোথায় আমার ছেলে? কোথায়?”
“আছে আমাদের কাছে।”
আব্বা কিছু একটা বলতে চাইছিলেন, তার আগেই আম্মা আব্বার হাত থেকে টেলিফোন কেরে নিয়ে চিৎকার করে বললেন, “কে? কে আমার মেকুকে নিয়ে গেছে? কে?”
জরিনা শুকনো গলায় বলল, “আপনি কে?”
“আমি মেকুর মা। তুমি কে?”
জরিনা আমতা আমতা করে বলল, “ইয়ে, আমি মানে ইয়ে -”
“তোমার কত বড় সাহস যে আমার বাসা থেকে তুমি মেকুকে চুরি করে নিয়ে যাও?” আম্মা হুংকার দিয়ে বললেন, “তোমার মাথার চুল আমি ছিঁড়ে ফেলব। ঘুষি মেরে তোমার সব কয়টা দাঁত আমি ভেঙে ফেলব। লাথি মেরে আমি তোমার পাঁজরের হাড্ডি একটা একটা করে ভাঙব। কত বড় সাহস তোমার যে তোমরা আমার মেকুকে চুরি করে নিয়ে যাও?”
জরিনা এই ধমক খেয়ে একেবারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কারো বাচ্চা কিডন্যাপ করে নেওয়ার পর সে যে এরকম খেপে যেতে পারে তার এরকম ধারণা ছিল না। সে কী বলবে বুঝতে পারল না। আম্মা ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন তোমরা আমার ছেলেকে চুরি করেছ? কেন?”
জরিনা মিন মিন করে বলল, “ইয়ে মানে, মুক্তিপণ – মানে – ”
আম্মা চিৎকার করে বললেন, “কত বড় ছোটলোক তুমি মুক্তিপণের জন্যে বাচ্চা চুরি কর? লজ্জা করে না বেহায়া বেশরম ধড়িবাজ? তোমার মা বাবা নাই? তোমার বাচ্চা কাচ্চা নাই? কুকুর বিড়াল পর্যন্ত অন্যের বাচ্চা টানাটানি করে না, আর তুমি মানুষ হয়ে আমার বাচ্চা চুরি করেছ? তুমি কুকুর বিড়ালের অধম – ”
জরিনার পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হল না। সে ফ্যাকাসে মুখে টেলিফোনটা মতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও। তুমি কথা বল।”
“কেন?”
“বড় গালাগাল করছেন।”
মতি অবাক হল, তার সুদীর্ঘ কিডন্যাপ জীবনে অভিজ্ঞতায় দেখেছে এরকম অবস্থায় সাধারণত কেউ গালাগালা করে না। সে টেলিফোনটা নিয়ে মধুর, গলায় বলল, “হ্যালো।”
আম্মা এবারে আরো রেগে গেলেন, চিৎকার করে বললেন, “তুমি আবার কোথা থেকে হাজির হয়েছ? তুমি কে?”
“সেটা নিয়ে কথা বলার অনেক সময় পাওয়া যাবে। আগে আমরা যে জন্যে ফোন করেছি সেটা নিয়ে কথা বলি।”
“আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। আমার মেকুকে ফিরিয়ে দাও।”
“কী বললেন? মেকু?”
আম্মা বললেন, “হ্যাঁ। মেকু। আমার ছেলের নাম মেকু।”
“মেকু আবার কী রকম নাম?”
“সেইটা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। এই মুহূর্তে আমার ছেলেকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।”
মতি আরো মধুর গলায় বলল, “সেই জন্যেই তো আপনার কাছে ফোন করেছি। আপনার মেকুকে কীভাবে আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব সেটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে না? সবাই যেন খুশি থাকে সেটা একটু দেখবেন না?”
“সবাই যেন খুশি থাকে?”
“হ্যাঁ। আপনার মেকুর যদি কিছু একটা হয়ে যায় তা হলে সেটা কী আপনার ভালো লাগবে?”
আম্মা একেবারে বোমার মতো ফেটে পড়লেন। “কী বললে? তোমরা বদমাইশের দল, চামচিকার দল, খাটাসের দল, তোমরা কী আমার মেকুর গায়ে হাত দিয়েছ?”
মতি মিন মিন করে বলল, “এখনো দেই নাই।”
“খেতে দিয়েছ? বাথরুম করিয়েছ? শুকনো কাপড় পরিয়েছ?”
“না, মানে – ।”
“ঘুমাতে দিয়েছ?”
“ইয়ে – ”
আম্মা মেঘস্বরে বললেন, “আমি বলেছি টেলিফোনটা আমার মেকুকে দাও।”
মতি অবাক হয়ে বলল, “আপনার মেকুর বয়স মাত্র দুই তিন মাস – ”
আম্মা শুদ্ধ করে দিয়ে বললেন, “দুই মাস এগারো দিন।”
“ওই হল। দুই মাস এগারো দিন। দুই মাস এগারো দিনের বাচ্চা কী টেলিফোনে কথা বলতে পারে?”
“তুমি মেকুর কানে টেলিফোনটা লাগাও। আমি তার সাথে কথা বলল।”
“আপনার মেকু টেলিফোনে কথা শুনে কি কিছু বুঝবে?”
“সেইটা নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। চুরি-চামারি করতে নেমেছ, চুরি চামারি নিয়েই থাক। মা কীভাবে বাচ্চার সাথে কথা বলে সেটা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। টেলিফোনটা মেকুর কানে লাগাও। আমি দেখতে চাই আমার মেকু ভালো আছে কি না।”
মতি কী করবে বুঝতে পারল না। অনেকটা বোকার মতন সে টেলিফোনটা মেকুর কাছে নিয়ে তার কানে লাগাল। আম্মা টেলিফোনে চিৎকার করে ডাকলেন, “মেকু! মেকু – বাবা তুই ভালো আছিস?”
মেকুর ইচ্ছে হল চিৎকার করে বলে, “হ্যাঁ মা ভালো আছি। তুমি কোনো চিন্তা করো না, আমি এই বদমাইশগুলিকে এমন শিক্ষা বেদ যে এরা জন্মের মতো সিধে হয়ে যাবে।” কিন্তু সে এসব কিছুই বলতে পারল না, মায়ের গলার আওয়াজ শুনে দুই মাসের বাচ্চার আনন্দে যেরকম শব্দ করার কথা সেরকম একটা শব্দ করল।
“মেকু বাবা তোকে ব্যথা দিচ্ছে না তো? কোনো যন্ত্রণা দিচ্ছে না তো?”
মেকু “ভ্যারররররর” করে মুখ দিয়ে একটা শব্দ করে মাথা নাড়ল।
“তুই যেখানেই থাকিস না কেন আমি তোকে নিয়ে আসব।”
মেকু আবার মুখ দিয়ে তার শব্দটা করে সম্মতি জানাল। মতি তখন টেলিফোনটা সরিরে নিজের কানে লাগিয়ে বলল, “ছেলের কথা শুনলেন?”
আম্মা বললেন, “হ্যাঁ শুনেছি।”
“চমৎকার। এবার তা হলে বিজনেস সেরে দেখা যাক।”
“বিজনেস?” আম্মা চিৎকার করে বললেন, “আমার ছেলে কি সিমেন্টের বস্তা নাকি গাড়ির পার্টস যে তাকে নিয়ে বিজনেস করবে?”
মতি গলায় স্বরে মধু ঢেলে বলল, “আমার মন হয় আপনি ব্যাপারটার গুরুত্ব ধরতে পারছেন না। হাজার হলেও আপনি তো মা ব্যাপারটা খুব ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে নিচ্ছেন। এটাকে ব্যক্তিগতভাবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। আপনার সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আপনার ছেলের সাথেও নেই -”
আম্মা ধমক দিয়ে বললেন, “খবরদার তুমি আমার ছেলের কথা মুখে নেবে না। তোমার দুর্গন্ধ ভরা মুখ তোমার নোংরা মুখ – ”
মতি প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “আমি কী আপনার স্বামী প্রফেসর সাহেবের সাথে কথা বলতে পারি?”
“কেন? হাসানের সাথে কেন কথা বলতে হবে?”
“কারণ ব্যাপারটা জরুরি। আমরা আপনাদের মেকুকে আপনাদের হাতে তুলে দিতে চাই। ব্যাপারটা যত সহজে করা যায় ততই ভালো। আমি সেটা নিয়ে আপনার স্বামী প্রফেসর হাসানের সাথে কথা বলতে চাই।”
“আমার সাথেই বল ব্যাটা ধড়িবাজ।”
“না, আপনার সাথে বলা যাবে না। চেষ্টা করেছি এতক্ষণ থেকে, আপনি শুধু গালাগাল করছেন।”
“তোমাদের গালাগাল করব না তো কি মাথায় তুলে নাচব? তোমাদের জুতিয়ে সিধে করা দেওয়া দরকার – ”
হঠাৎ করে আম্মার কথা বন্ধ হয়ে গেল, এবং আব্বার গলা শোনা গেল। মনে হল আব্বা এক রকম জোর করে আম্মার হাত থেকে টেলিফোনটা কেড়ে নিয়েছেন। আব্বা বললেন, “হ্যালো।”
“প্রফেসর হাসান সাহেব?”
“হ্যাঁ।”
“আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলা খুব কঠিন, খুব অল্পে রেগে যান। আপনার সাথে কথা বলতে আশা করছি কোনো সমস্যা হবে না।”
“কী বলতে চান বলে ফেলেন।”
“মুক্তিপণের টাকার পরিমাণটা আপনাকে জানাই।”
“কত?”
“দশ লক্ষ টাকা।”
আব্বা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “দেখেন, আমাদের ছেলেকে ফিরে পাওয়ার জন্যে আমাদের যা আছে সব দিয়ে দেব। কিন্তু আমরা তো আসলে চাকরিজীবী আমাদের হাতে কোনো ক্যাশ টাকা নেই। আমি জীবনে একসাথে দশ লক্ষ টাকা দেখি নি। আমরা – ”
মতি বাধা দিয়ে বলল, “এই সব খুঁটিনাটি নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে চাই না। আপনারা নিজেদের মাঝে আলোচনা করেন। শুধু একটা ব্যাপার – ”
“কী ব্যাপার?”
“পুলিশকে কিছু জানাতে পারবেন না। পুলিশ আমাদের ধরে ফেলবে সেটা নিয়ে আমরা একবারও মাথা ঘামাচ্ছি না, কিন্তু তাদেরকে জানালে টাকার একটা ভাগ তো তাদেরকেও দিতে হবে কাজেই আপনাদের উপর চাপটা একটু বেশি পড়বে। এই হচ্ছে ব্যাপার।”
আব্বা কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু মতি বাধা দিয়ে বলল, “আমি এখন আর কিছুই বলতে চাই না। একটু পরে আবার ফোন করব। শুভ সন্ধ্যা প্রফেসর সাহেব।”
টেলিফোনটা বন্ধ করে মতি যুদ্ধ জয় করার ভঙ্গি করে বদি এবং জরিনার দিকে তাকাল, বলল, “দেখেছ? কেমন চমৎকার প্রফেশনাল ভাবে কাজ করলাম!”
বদি তার ফুলে যাওয়া মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “কী মনে হয় তোমার, দেবে টাকা?”
“নিশ্চয়ই দেবে। কিন্তু কত দিতে পারবে সেটা হচ্ছে কথা ইউনিভার্সিটির মাষ্টারদের বেতন আর কত? বেচারারা প্রাইভেট টিউশানিও করতে পারে না। কাজেই তাদের কাছে ক্যাশ টাকা কম।”
“যতই হোক, কিছু তো নিশ্চয়ই দেবে।”
“তা দেবে।”
টেবিলে রাখা মোমবাতিটা প্রায় শেষ হয়ে নিভু নিভু হয়ে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে জরিনা বিরক্ত হয়ে বলল, “কী যন্ত্রণা – ইলেক্ট্রিসিটি আসছে না, গরমে সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি।”
জরিনার কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ করে লাইট জ্বলে উঠল। আবছা অন্ধকারে সস্তা হোটেলটার দৈন্য দশা বোঝা যাচ্ছিল না, কর্কশ উজ্জ্বল আলোতে হঠাৎ করে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। মলিন বিছানা, নোংরা মশারি, রং ওঠা দেওয়াল এবং সেটাকে আরো প্রকট করার জন্যে ঘরের দেওয়ালে গোবদা একটা মাকড়শা তার পা ছড়িয়ে বসে আছে।
মেকুর খিদে পেয়েছে, কোনো রকম সঙ্কেত না দিলে এরা খেতে দেবে বলে মনে হয় না। সব সময়েই মায়ের দুধ খেয়ে এসেছে এখন কী খেতে দেবে কে জানে। কিন্তু কিছু একটা তো খেতে হবে। মেকু তখন খাবার জন্যে ঘ্যান ঘ্যান করে একটু কাঁদবে বলে ঠিক করল, তারপর সত্যি সত্যি কাঁদতে শুরু করল।
বদি মতি আর জরিনা তিন জনেই এক সাথে মেকুর দিকে তাকাল, মেকুর কান্নাকে তারা খুব ভয় পায়। বদি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হল? কাঁদে কেন?”
মতি বলল, “ছোট বাচ্চার কাজ তিনটা, খাওয়া ঘুম আর বাথরুম। এই মাত্র সে আমার মুখে বাথরুম সেরেচে। কাজেই বাথরুম করতে হবে না। ঘুমের দরকার হলে ঘুমাতে পারে, সে তো শুয়েই আছে। তা হলে বাকি থাকল খাওয়া।”
“কীভাবে খাওয়াবে?”
“ফিডার বোতল কিনে এনেছি, বাচ্চার পাওডার দুধ কিনে এনেছি। পানির সাথে দুধ মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। দুধের কৌটায় লেখা আছে।”
বদি জরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “জরিনা, তুমি তা হলে এই বাচ্চাকে একটু খাওয়াবে। এর চিৎকার শুনলে আমার এত ভয় লাগে!”
জরিনা বলল, “কেন? আমি কেন খাওয়াব?”
“ছোট বাচ্চাদের তো মহিলারাই দেখে শুনে রাখে।”
জরিনা নাক দিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলেল বলল, “আমাকে কী তোমার সেরকম মহিলা মনে হচ্ছে? বাচ্চা কাচ্চাই যদি আমার জীবনের উদ্দেশ্য হতো তা হলে বিয়ে শাদী করে সংসার করতাম, এই লাইনে আসতাম না।”
মতি বলল, “তর্ক করে লাভ নেই। আছাড় খেয়ে বদি আর আমার দুজনেরই বারটা বেজে গেছে, আমরা খুব বেশি নাড়াচাড়া করতে পারছি না। জরিনা, এখন তোমাকেই কিছু কাজ কর্ম করতে হবে।”
জরিনা গজ গজ করতে করতে উঠে গেল। ফিডার বোতল বের করে তার মাঝে পানি ঢালল, দুধের কৌটা খুলে সেখান থেকে পাওডার দুধ বের করে মিশিয়ে ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিয়ে বোতলটা মেকুর মুখে ধরিয়ে দিল। মেকু সাথে সাথে কান্না থামিয়ে ফিডার বোতল টানতে থাকে কিন্তু এক মুহূর্ত পর বোতল থেকে মুখ সরিয়ে বিকট স্বরে চিৎকার করতে শুরু করে।
বদি ভয় পেয়ে বলল, “কী হল? কাঁদছে কেন? এভাবে কাঁদলে তো লোক জমা হয়ে যাবে।”
জরিনা বলল, “বুঝতে পারছি না কেন কাঁদছে।”
মেকুর ইচ্ছে হল দশ কেজি একটা ধমক দিয়ে বলে, “বেকুবের দল, দুধ খেতে হলে নিপলে ফুটো করতে হয়।” কিন্তু সেটা বলতে পারল না, দুই মাসের বাচ্চার যেরকম ভঙ্গিতে কান্নাকাটি করা দরকার ঠিক সেই রকম ভঙ্গিতে চিৎকার করতে লাগল।
জরিনা কী করবে বুঝতে না পেরে ফিডার বোতলটা আবার মেকুর মুখে ঠেসে ধরল। মেকু এক দুইবার চুষে মুখে থেকে বের করে দিয়ে আবার তার স্বরে চিৎকার করতে থাকে।
জরিনার পাশাপাশি বদি এবং মতি এসে দাঁড়াল। মতি চিন্তিত মুখে বলল, “এ তো ঝামেলা হল দেখছি। কী করা যায়?”
বদি মাথা চুলকে বলল, “এর মা’কে ফোন করে জিজ্ঞেস করা যায় না?”
মতি বলল, “হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। তাই করা যাক।”
বদি জরিনার দিকে টেলিফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও টেলিফোন কর।”
জরিনা ভয়ে ভয়ে বলল, “আমি করব? যদি আবার গালাগাল শুরু করে দেয়?”
মতি বলল, “দিলে দেবে। তুমিও উলটো গালাগাল করবে। কিন্তু এই বাচ্চার কান্না থামানো না গেলে আমরা বিপদে পরে যাব।”
জরিনা বলল, “টেলিফোন নাম্বারটা জানি কত?”
মতি বলল, “টেলিফোন নাম্বার লাগবে না। মাঝখানের হলুদ বাটনটা চাপ দিলেই লাস্ট নাম্বার রিডায়েল হয়ে যাবে।”
জরিনা হলুদ বোতাম টিপে দিতেই ফোন ডায়াল হয়ে গেল এবং প্রায় সাথে সাথেই মেকুর আম্মার গলার স্বর শোনা গেল, “হ্যালো।”
জরিনা ভয়ে ভয়ে বলল, “আপনি মেকুর মা?”
“হ্যাঁ। আপনি কে?”
“আমি একটু আগে ফোন করেছিলাম, মনে নেই?”
“মনে নেই আবার? একশ বার মনে আছে। কী চাও এখন? আমার মেকুকে ফেরত দেবে কখন? তাকে খাইয়েছ? তার কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি কেন, কী হয়েছে?”
“সেই জন্যেই ফোন করেছি। খাওয়া নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে, খেতে চাচ্ছে না। কী করা যায় জানার জন্যে ফোন করেছি।”
“মেকু খেতে চাচ্ছে না?”
“না।”
“দুধ বেশি গরম হয় নাই তো?”
“না।”
“কতটুকু পানিতে কয় চামুচ দুধ দিয়েছ?”
“সেটা মাপ মতো দিয়েছি, কৌটায় যা লেখা আছে।”
“একেবারেই খেতে চাচ্ছে না? না কি একটু খেয়ে এর খেতে চাচ্ছে না?”
জরিনা বলল, “একেবারেই খেতে চাচ্ছে না।”
আম্মা কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বললেন, “ফিডার বোতলের নিপলে ফুটো আছে তো?”
জরিনা বলল, “দাঁড়ান দেখি।” বোতলটা হাতে নিয়ে নিপলটি দেখল, সত্যি সত্যি নিপলে ফুটো নেই।
আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, “কী ? আছে?”
“না, নেই।”
আম্মা আবার মহা খাপ্পা হয়ে চিৎকার করতে লাগলেন, “তোমরা কী রকম কিডন্যাপ করো যে একটা বাচ্চাকে কীভাবে দুধ খাওয়াতে হয় সেটা পর্যন্ত জানো না? মাথার মাঝে কী ঘিলু নেই? সেখানে কী গোবর ভরা আছে? তোমরা কী ভাত খাও নাকি ঘাস খেয়ে থাকো – ”
রাগারাগি এবং গালাগালি আরো বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাবার আগে জরিনা তাড়াতাড়ি টেলিফোনের কানেকশান কেটে দিল।
নিপলের মাঝে ফুটো করে ফিডারটি মেকুর মুখে ধরে দেবার পর সে এবারে চুক চুক করে চুষতে শুরু করল। ঘরের ভেতরে শেষ পর্যন্ত এবারে শান্তি ফিরে আসে।
মেকু দুধ খেতে খেতে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে। জরিনা টেলিফোনটা রেখেছে একেবারে তার হাতের কাছে। একটু চেষ্টা করলেই সে নাগাল পেয়ে যাবে, আর হলুদ বোতামটা চেপে ধরলেই তার আম্মার কাছে টেলিফোন চলে যাবে। ব্যাপারটা মন্দ নয়।
মেকু শান্ত হয়েছে আবিষ্কার করার পর মতি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, “ এবারে তা হলে আমরা ঠিক করে নিই এখন কী করব।”
“হ্যাঁ। বদিও মাথা নাড়ল, “মনে হচ্ছে কিডন্যাপ করাটা পুরোটা জলে যায় নাই। কিছু টাকা বের করা যাবে।”
জরিনা ঠোটে একটা সিগারেট চেপে ধরে ফস করে ম্যাচ জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ, এই অংশটা খুব ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। ধরা পড়ার আশঙ্কা এই খানে সবচেয়ে বেশি।”
তখন তিন জন মিলে কথাবার্তা বলতে শুরু করে। মেকুকে কোথায় রেখে যাবে। যেহেতু গাড়িটা পুলিশ নিয়ে গেছে আবার নতুন একটা গাড়ি ভাড়া করতে হবে কার কাছ থেকে সেই গাড়ি নেওয়া যায়। মুক্তিপণটা ঠিক কোথায় হস্তান্তর হবে এই রকম খুঁটিনাটি।
আলোচনাটা শুরু হবার সাথে সাথে মেকু বুঝতে পারল এই কথাবার্তাগুলি তার আম্মা আব্বার শোনা দরকার। তার হাতের কাছাকাছি মোবাইল টেলিফোন, মেকু একটু গড়িয়ে সেই টেলিফোনটার কাছে পৌঁছে হলুদ বোতামটা চেপে ধরল। তার আর কিছুই করতে হবে না। আব্বা-আম্মা বাসায় বসে এখন এদের সব কথাবার্তা শুনতে পাবেন।
আসল ব্যাপারটা হল তার থেকে অনেক ভালো। কিডন্যাপ করে ফোন করেছে শুনে পুলিশ রেকর্ড করার যন্ত্র নিয়ে বসেছিল। ফোন বাজার সাথে সাথে তারা রেকর্ড করতে শুরু করল – আম্মা টেলিফোন তুলে বার কতক “হ্যালো হ্যালো” বললেন কিন্তু অন্য পাশে কেউ উত্তর দিল না। টেলিফোনটা রেখে দিতে গিয়ে আম্মা থেমে গেলেন হঠাৎ করে শুনতে পেলেন খুব আবছাভাবে কিছু মানুষের কথা শোনা যাচ্ছে। কথা খুব স্পষ্ট নয় কিন্তু ভাসা ভাসা বোঝা যায়। একটু কান পেতে শুনে আম্মা চমকে উঠলেন – মানুষগুলি কথা বলছে মেকুকে নিয়ে, কিডন্যাপ করার পর মুক্তিপণটা কীভাবে আদায় করবে সেটাই হচ্ছে আলোচনার বিষয়। আম্মা একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন।
পুলিশ সাথে সাথে কাজ শুরু করে দিল, আলাপ আলোচনা থেকে জানতে পারল এখানে তিন জন মানুষ একজনের নাম বদি একজন মতি এবং আরেকজন জরিনা। ফাইল ঘেটে ঘণ্টাখানেকের মাঝেই তাদের ছবিও বের হয়ে গেল, তিনজনেই ঘাঘু আসামি আগেও কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়েছে। আগামী কাল মুক্তিপণ আদায় করার জন্যে কোথা থেকে তারা গাড়ি ভাড়া করে কোথায় কীভাবে যাবে সেটাও পুলিশ জেনে গেল।
আধা ঘণ্টা পরে মতি যখন আবার টেলিফোন করে মুক্তিপণ কীভাবে দিতে হবে সেটা নিয়ে মেকুর আব্বা আম্মার সাথে আলোচনা করছিল সে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে নি ততক্ষণে তাদের সব খুঁটিনাটি বের হয়ে গেছে। মুক্তিপণের টাকার পরিমাণ নিয়ে মেকুর আব্বা আম্মা যে ডর কষাকষি করলেন সেটাও যে পুলিশের শেখানো সেটাও সে বুঝতে পারল না। মেকুর আব্বা আম্মা যেটুকু টাকা দিতে রাজি হলেন সেটা যে তাদের মতো কারো মতো কারো পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয় সেটা নিয়েও তাদের মনে কোনো সন্দেহ হল না। লোভ বড় ভয়ানক জিনিস, এর কারণে সব কাণ্ডজ্ঞান হঠাৎ করে লোপ পেয়ে যায়।
০৬. কাল রাত – মেকু কাহিনী
খাওয়া শেষ করে বদি শব্দ করে একটা ঢেকুর তুলল। মতি তার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বলল, “ঢেকুর তোলা অভদ্রতা তুমি জান না?”
“অভদ্রতা?” বদি অবাক হয়ে বলল, “ভালো খেলে মানুষ সব সময় ঢেকুর তুলে।”
জরিনা অর্ধভুক্ত খাবারের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই খাবার তোমার কাছে ভালো লেগেছে?”
বদি দ্বিতীয় আরেকটা ঢেকুর তুলে বলল, “খিদে পেলে আমার সব খাবার ভালো লাগে।”
জরিনা এর কিছু বলল না। মতি বলল, “খাবারের ভালোমন্দ নিয়ে আর মাথা ঘামিও না। বাইরে না গিয়ে ঘরে বসেই যে খেতে পেরেছি সেটাই বেশি।”
“তা ঠিক। পায়ের যা অবস্থা ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে নিচে যেতে হলে অবস্থা কেরোসিন হয়ে যেত।”
“এখন ঘুমানোর ব্যবস্থা করতে হবে।”
মতি বলল, “পাশাপাশি দুইটা রুম নিয়েছি। একটাতে আমি আর বদি অন্যটাতে জরিনা আর মেকু।”
জরিনা দেওয়ালে বসে থাকা গোবদা মাকড়শাটার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ব্যাটা মাকড়শাকে দেখে কী ঘেন্না লাগে, ছিঃ!”
বদি আর মতি দুজনেই মাকড়শাটার দিকে তাকাল, তাদের কাছে সেটা এমন কিছু ঘেন্নার জিনিস মনে হল না। বদির বরং দেখতে ভালোই লাগল, কেমন সুন্দর ফুলের মতো পা ছড়িয়ে আছে। জরিনা বলল, “আমি এই রুমে এই মাকড়শার সাথে থাকব না।”
মতি তার জুতো খুলে দেওয়ালে মাকড়শার দিকে ছুঁড়ে মারতেই মাকড়শাটা তার লম্বা পা ফেলে তিরতির করে দৌড়ে ঘুলঘুলির দিকে পালিয়ে গেল। বদি বলল, “ভালোই হয়েছে, লাগে নাই।”
“কেন? লাগলে কি হত?”
“মাকড়শা মারলে গুনাহ হয়।”
মতি একটু অবাক হয়ে বদির দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা মানুষের বাচ্চা কিডন্যাপ করতে তোমার আপত্তি নেই, তখন গুনাহ নিয়ে চিন্তা হয় না?”
“ওইটা হচ্ছে বিজনেস। বিজনেসে গুনাহ-সওয়াব নাই।”
“ও।”
বদি মেকুর পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে একটা সিগারেট ধরাল। জরিনা অবাক হয়ে বলল, “তুমিও সিগারেট খাও নাকি?”
“সব সময় খাই না। যখন টেনশান হয় তখন খাই।”
“এখন টেনশান হচ্ছে?”
“হ্যাঁ।”
মতি বলল, “তাড়াতাড়ি সবাই শুয়ে পড়। আগামী কাল অনেক কাজ।”
জরিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার মনে হয় এত সহজে ঘুম আসবে না।”
মতি পকেট হাতড়ে একটা শিশি বের করে বলল, “ এই যে আমার কাছে ঘুমের ওষুধ আছে। ঘুমানোর আগে একটা ট্যাবলেট খেয়ে নিও, দেখ ভালো ঘুম হবে।”
“দেখি কী টেবলেট?”
জরিনা ওষুধের শিশিটা নিয়ে দেখতে থাকে। মতি বলল, “কড়া ওষুধ, একটা খেলেই রাত কাবার হয়ে যায়। গোটা দশেক খেলে হাসপাতালে নিতে হবে।”
মেকু চোখের কোনা দিয়ে ওষুধের শিশিটা দেখার চেষ্টা করল, এই ট্যাবলেট কয়েকটা যোগাড় করতে পারলে মন্দ হয় না। সকাল বেলা কোনো একজনের চায়ের মাঝে দিয়ে দিতে পারলে ঘুমে কাদা হয়ে থাকবে!
মেকু হঠাৎ বাঁশির মতো একটা শব্দ শুনতে পেল। শব্দটা কোথা থেকে আসছে বোঝার জন্যে সে এদিক ওদিক তাকায়, তখন জরিনার হাসি শুনতে পেল। জরিনা বলল, “বদির কাণ্ড দেখেছ? এর মাঝে শুয়ে নাক ডাকতে আরম্ভ করেছে!”
মতিও একটু হাসল, বলল, “হ্যাঁ, বদি খুব সহজে ঘুমিয়ে যেতে পারে। যে কোনো জায়গায় বসে বসে ঘুমিয়ে নেয়।”
মেকু বদির দিকে তাকাল, একটা সিগারেট টানতে টানতে ঘুমিয়ে গেছে, সিগারেটের হাতটা একেবারে মেকুর কাছে। সিগারেটের বাজে একটা গন্ধ আসছে। তার আম্মা কাছাকাছি থাকলে এ জন্যে বদির মুণ্ডুই মনে হয় আলাদা করে ফেলতেন। সিগারেটের গন্ধটা খুব খারাপ লাগছে, মেকু একবার সিগারেটের দিকে তাকাল, ইচ্ছে করলে হাত থেকে টেনে নিয়ে নিচে ছুঁড়ে দিতে পারে। চেষ্টা করে দেখবে নাকি?
মেকু এদিক সেদিক তাকাল, জরিনা আর বদি অন্য দিকে তাকিয়ে আছে, তাকে খেয়াল করছে না। সে সাবধানে সিগারেটটা ধরে বদির হাত থেকে নিয়ে আসে, এখন একটু চেষ্টা করলেই দূরে ছুঁড়ে দিতে পারবে। মেকু ছুঁড়তে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল, ছুঁড়তেই যদি হয় তা হলে বদির উপরে ছুড়লেই তো হয়, তিরিং বিড়িং করে যা একটা লাফ দেবে সেটা নিশ্চয়ই দেখার মতো একটা ব্যাপার হবে। মেকু বদির বুকের উপর নিশানা করে সিগারেটটা ছুঁড়ে মারল। শুয়ে থেকে মেকু ঠিক দেখতে পেল না সিগারেটটা বুকে পড়ে গড়িয়ে তার সার্টের বুক পকেটে ঢুকে গেছে, সেখানে তার ম্যাচটা রয়েছে। মেকু একটা চিৎকার এবং লাফ ঝাপ আশা করছিল কিন্তু তার কিছুই হল না। মেকু যখন প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে গেল সিগারেটটা সে ঠিকমতো বদির উপরে ফেলতে পারে নি ঠিক তখন ব্যাপারটি ঘটল, হঠাৎ করে বদির বুক পকেটের পুরো ম্যাচটাই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। বদি ভয়ংকর একটা চিৎকার করে উঠে বসে, হঠাৎ করে তার বুকের মাঝে কেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে বুঝতে পারে না, সে মিছাই বুকে থাবা দিয়ে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পাগলের মতো লাফাতে থাকে, বিছানায় পা বেঁধে সে দড়াম করে আছাড় খেয়ে পড়ে, সেখান থেকে মচকে যাওয়া পা নিয়ে সে আবার তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে তারপর ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে সারা ঘরে ছোটাছুটি করতে থাকে।
জরিনা এবং মতিও বদির পিছনে পিছনে দৌড়াতে থাকে – পলিস্টারের সার্ট আগুন ধরে গেলে নেভানো কঠিন, টান দিয়ে বোতাম ছিঁড়ে সার্টটা খুলতে হল এবং পা দিয়ে তার উপর লাফিয়ে সেই আগুন নেভাতে হল। বদির বুকের কাছে খানিকটা জায়গা পুড়ে গেছে, বুকের লোম পুড়ে সারা ঘরে একটা বোটকা গন্ধ। সব মিলিয়ে একটা ভয়ংকর অবস্থা। চেচামেচি এবং হই চই নিশ্চয়ই বেশি হয়ে গিয়েছিল কারণ হোটেলের লোকজন এসে দরজা ধাক্কাধাক্কি করে জানতে চাইল কী হয়েছে। জরিনা দরজা ফাঁক করে মধুর হাসি হেসে বলল, “কিছু হয় নাই। তেলাপোকা উড়ছিল দেখে ভয় পেয়েছে।”
“তেলাপোকা দেখে এত ভয়?”
“কেউ তেলাপোকা দেখে ভয় পায়। কেউ মাকড়শা ভয় পায়। কেউ ইঁদুর ভয় পায়। যার যেটাতে ভয়।”
“কিন্তু পোড়া গন্ধ কিসের?”
“ভয় পেয়ে সিগারেট ছুঁড়ে দিয়েছে, চুলে এসে পড়েছে। চুল পোড়া গন্ধ।”
ব্যাখ্যাটুকু মানুষগুলির কতটুকু বিশ্বাস হয়েছে ঠিক বোঝা গেল না, কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে তারা চলে গেল। মতি আর জরিনা তখন বদির দিকে নজর দিল। জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“বু-বুকে আগুন লেগে গেছে!”
“সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।” জরিনা রেগে মেগে বলল, “শুধু বাংলা সিনেমায় শুনেছি বুকে আগুন লেগে যায়। তোমার বুকে কেমন করে আগুন লাগল?”
বদি নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে মুখে বলল, “মনে হয় ঘুমের মাঝে সিগারেটটা শরীরে পড়ে গেছে!”
মতি হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, “ শুধু মাত্র পুরোপুরি গবেট হলে মানুষ সিগারেট খেতে খেতে ঘুমিয়ে যায়।”
বদি মিন মিন করে বলল, “ইচ্ছে করে তো আর ঘুমাই নাই। হঠাৎ কেমন যেন ঘুম এসে গেল। টেনশান হলেই আমার বেশি ঘুম পায়।”
জরিনা মাথা নেড়ে বলল, “আমি জন্মেও এরকম কথা শুনি নি, টেনশান হলে বেশি ঘুম পায়!”
মতি বলল, “যার যেরকম নিয়ম।”
বদি মেঝে থেকে তার সার্টটা তুলে দেখে পকেট পুরোটা জ্বলে গিয়ে বুকের মাঝে পোড়া একটা গর্ত। স্থানে স্থানে পুড়ে পুরো সার্টটা কুঁকড়ে গেছে। বদি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কোনো কাপড় জামা আনি নাই কাল এই সার্ট পড়ে বের হব কেমন করে?”
মতি একটা নিশ্বাস ফেলেল বলল, “সেটা কাল দেখা যাবে, এখন ঘুমানোর ব্যবস্থা করা যাক।”
বদি মুখ বিকৃত করে বলল, “বুকের ভিতর যা জ্বালা করছে!”
জরিনা মুখ ভেংচে বলল, “ একেবারে বাংলা নাটকের ডায়ালগ!”
“সত্যি বলছি! মনে হয় ফোসকা পড়ে যাবে।”
“এখন কিছু করার নেই।” মতি বলল, “রাতটা কোনোভাবে কাটিয়ে দাও, কাল ভোরে দেখা যাবে।”