আম্মা মেকুর গাল টিপে দিয়ে বললেন, “তুই শুয়ে থাক বাবা। আমি চট করে গোসল করে আসি।”
মেকুর হঠাৎ করে খুব ইচ্ছে হল উত্তরে আম্মাকে কিছু বলে। “ঠিক আছে আম্মা” কিংবা, “চমৎকার” কিংবা “তোমার গোসল আনন্দময় হউক” কিংবা এইধরনের কোন কথা। কিন্তু মেকু সাহস করল না। এই পর্যন্ত যতজন বড় মানুষ তাকে কথা বলতে শুনেছে ভয়ে তাদের সবার পেটের ভাত চাল হয়ে গেছে। তার আম্মাও যদি ভয় পেয়ে যান? ভয় পেয়ে তাকে যদি আর কোলে না নেন? যদি আর আদর না করেন? মেকু কিছুতেই আর সেই ঝুঁকি নিতে পারে না। কিন্তু যদি সে আম্মার সাথে কথা বলতে পারত তা হলে কী মজাটাই না হত! মেকু শুয়ে শুয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একটু পরেই বাথরুমে পানি ঢালার এবং তার সাথে আম্মার মৃদু গলার গান শুনতে পেল।
শুয়ে শুয়ে মেকুর চোখে একটু তন্দ্রামতো এসেছিল, হঠাৎ করে সে দরজায় একটা শব্দ শুনতে পেল। মনে হল কেউ বাইরের দরজা খোলার চেষ্টা করছে। মেকু কান খাড়া করে শুয়ে থাকে, তাদের বাসায় কেউ এলে বেল বাজায়, নিজে থেকে দরজা খোলার চেষ্টা করে না। আব্বার কাছে চাবি আছে কিন্তু আব্বাও প্রথমে বেল বাজান।
মেকু শুনতে পেল দরজায় ঘটাং করে একটা শব্দ হল তারপর ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। মাকু শুনল ভিতরে কয়েক জন মানুষ এসে ঢুকছে, ব্যাপারটা আর যাই হোক ভালো হতে পারে না। এইভাবে দরজা খুলে ভিতরে বাইরের থেকে মানুষজন কোনো ভালো উদ্দেশ্যে ঢুকে যায় না। মেকুর বুকের ভিতর ধকধক শব্দ করতে থাকে, এই দুষ্টু মানুষগুলো যদি তার আম্মার কোনো ক্ষতি করে?
মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেল তার ঘরে দুজন মানুষ এসে ঢুকেছে, একজন পুরুষ বেশ লম্বা চওড়া, দেখতে খানিকটা ডাকাতের মতন। সাথে আরেক জন মহিলা, দেখতে শুনতে ভালোই। কিন্তু মানুষগুলি ভালো নয়, ভালো মানুষের হাতে রিভলবার থাকে না। পুরুষ মানুষটা নিচু গলায় বলল, “বুয়া কোথায়?”
মহিলা বলল, “বাথরুমে মনে হয়।”
“তা হলে দাবড়ানি দেব কেমন করে?”
“দেওয়ার দরকার কী? আমাদের কাজ শেষ করে আমরা চলে যাই।”
মেকু ঠিক বুঝতে পারল না তার আম্মাকে এই পাজি মানুষ দুই জন বুয়া মনে করছে কেন, আর কী কাজ শেষ করে তারা চলে যেতে চাইছে। মেকু ঘুমের ভান করে চোখের কোনা দিয়ে লম্বা চওড়া ডাকাতের মতো মানুষটি আর সাথের মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষ দুইজন হেঁটে তার বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। মেকু শুনতে পেল পুরুষ মানুষটা বলছে, “বাচ্চা ঘুমাচ্ছে। জেগে থাকলে হয়তো চিৎকার করত।”
মহিলা বলল, “এক মাসের বাচ্চা কিছু বুঝেসুঝে না। ময়দার প্যাকেটের মতো – চিৎকার করার কথা নয়।”
“তা হলে তুলে নাও।”
মাকু চমকে উঠল। তাকে তুলে নেওয়ার কথা বলছে। কেন তাকে তুলে নিতে চাচ্ছে। সে টের পেল একজন তার নিচে হাত দিয়ে তাকে টেনে তুলছে, মেকু কী করবে বুঝতে পারল না, সে কী একটা চিৎকার দেবে? ইচ্ছা করলেই সে এত জোরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে পারে যে বাথরুম থেকে তার আম্মা ছুটে বের হয়ে আসবেন, কিন্তু এই খারাপ মানুষগুলি যদি তার আম্মার কোনো ক্ষতি করে? গুলি করে দেয়?
মেকু তাই কোনো শব্দ করল না। সে বুঝতে পারল মহিলাটি তাকে কোলে তুলে নিয়েছে তারপর নিচু গলায় সঙ্গী মানুষটাকে বলছে, “চল।”
ঠিক তখন মোবাইল ফোনে মৃদু শব্দ হল। মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখল পুরুষ মানুষটি পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে চাপা গলায় বলল, “হ্যালো।”
অন্য পাশে কে কী বলেছে মেকু শুনতে পেল না। সে শুনল পুরুষ মানুষটা বলছে, “ কোনো সমস্যা নাই। আমরা আসছি। রেডি থাক।”
মেকু বুঝতে পারল তার ওপরে মহা বিপদ নেমে আসছে – এখনো তার বয়স দুই মাসও হয় নি, তার মাঝে তার উপর এরকম বিপদ? সে কী করবে বুঝতে পারল না। মাথা ঠাণ্ডা করে কিছু একটা করতে হবে, তবে এই ঘরে সে চিৎকার করে তার আম্মাকে বিপদে ফেলবে না – মরে গেলেও না। মহিলাটি তাকে কোলে নিয়ে যাচ্ছে, তার ডান হাতটি ঝুলে আছে, সে চেষ্টা করল ডান হাত দিয়ে কিছু একটা ধরতে। ড্রেসিং টেবিলের কাছে দিয়ে যাবার সময় সে টেবিলের উপর একটা প্যাকেট দেখে সেটাই ধরে ফেলল, প্যাকেটের ভিতরে কী আছে কে জানে। প্যাকেটটা সে তার শরীরের ভিতরে লুকিয়ে ফেলল। এখনো সে জানে না কিসের প্যাকেট কিন্তু যতদূর মনে হয় এটা তার ফটোর একটা প্যাকেট। তার আব্বা আম্মার এখন প্রধান কাজ হচ্ছে তার ফটো তোলা – এখন পর্যন্ত যত ছবি তোলা হয়েছে সেগুলো দিয়ে মনে হয় একটা মিউজিয়াম ভর্তি করে ফেলা যাবে।
মহিলাটি মেকুকে কোলে নিয়ে সামনে এবং তার পিছু পিছু পুরুষ মানুষটি বের হয়ে এল। এই ফ্ল্যাটটাতে লিফট আছে কিন্তু মানুষ দুজন সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে। সিঁড়িতে কারো সাথে দেখা হল না, এখন একমাত্র ভরসা গেটের দারোয়ান। সিঁড়ি দিয়ে নেমে মহিলাটি এবং তার পিছু পিছু মানুষটা বের হয়ে আসে। দুজনে খুব সহজ স্বাভাবিক থাকার ভান করছে কিন্তু ভিতরে ভিতরে দুজনেই খুব উত্তেজিত। মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখল পুরুষ মানুষটার ডান হাত পকেটের মাঝে, সেটা দিয়ে নিশ্চয় রিভলবারটা ধরে রেখেছে।
মেকু আশা করছিল গেটে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ানটা বুঝি তাদেরকে থামাবে, কিন্তু ঠিক উলটো ব্যাপার হল, দারোয়ান হাত তুলে তাদেরকে একটা লম্বা সালাম দিল। মেকু তখন বুঝল এখন তার একটা কিছু করার সময় হয়েছে, সে আচমকা তার সমস্ত শরীর বাঁকা করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে শুরু করল। সেই চিৎকার এতই ভয়ংকর যে আরেকটু হলে মহিলাটা মেকুকে নিচে ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেত, কিন্তু শেষ মুহূর্ত সে সামলে নিল। পুরুষ মানুষটির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, “দেখেছ খোকার খিদে পেয়েছে?”
পুরুষ মানুষটি মহিলার মতো এত চালু নয়, সে আমতা আমতা করে বলল, “এ্যাঁ, ইয়ে-খোকা? মানে – ইয়ে – খিদে?”
“হ্যাঁ।” মহিলাটি মেকুর গলার স্বর ছাপিয়ে যায় চিৎকার করে বলল, “খোকার দুধের বোতলটা কোথায়?”
পুরুষ মানুষটা আবার হতচকিত হয়ে যায়, আমতা আমতা করে বলে, “দুধ? মানে দুধের বোতল? মানে- ইয়ে –কিন্তু তা হলে দুধ-মানে, যে সাদা রংয়ের –”
মেকু শুনল, মহিলাটি বলছে, “নিশ্চয়ই গাড়িতে রেখে এসেছি। চল তাড়াতাড়ি চল –”
দারোয়ান ব্যস্ত হয়ে বলল, “কোথায় স্যার, গাড়ি কোথায়? ড্রাইভার সাহেব কোথায়? তারপর গলা উচিয়ে চিৎকার করতে লাগল, “ড্রাইভার সাহেব। ড্রাইভার সাহেব।”
মেকু বুঝতে পারল তার চিৎকার করে আর লাভ হবে না, মায়ের কোলে ছোট বাচ্চার চিৎকার খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তা হলে কী সে এখন কথা বলে চেষ্টা করবে? তাতে কী লাভ হবে? কিছু একটা সে বলেই ফেলত কিন্তু তার আগেই তাদের পাশে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল, এবং কিছু বোঝার আগে দরজা খুলে এক পাশ দিয়ে মেকুকে নিয়ে মহিলা অন্যপাশ দিয়ে পুরুষ মানুষটি উঠে বসল। সাথে সাথে গাড়িটা ছেড়ে দিল। গাড়ি চালাতে চালাতে ড্রাইভার বলল, “কংগ্রাচুলেশান্স জরিনা। কংগ্রাচুলেশান্স বদি। চমৎকার ভাবে বাচ্চাটাকে কিডন্যাপ করেছ। নিখুঁত কাজ। স্টেট অফ দি আর্ট।”
বদি বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে বলল, “আরেকটু হলেই তো বিপদ হয়ে যেত! শেষ মুহূর্তে বাচ্চাটা হঠাৎ করে যা চিৎকার শুরু করল!” বদি মেকুর দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “এক থাবড়া দিয়ে সব দাঁত ফেলে দেব, বদমাইশ ছেলে।”
মতি গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, “সাবধান বদি। এই ছেলের গায়ে হাত দেবে না। এই ছেলের এখনো দাঁত উঠে নি কাজেই থাবড়া দিয়ে দাঁত ফেলতে পারবে না। তুমি তোমার নিজের বাচ্চাকে যত যত্ন করে রাখ এই বাচ্চাকে তার থেকে বেশি যত্ন করে রাখতে হবে। কারণ তোমার নিজের বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে তুমি দশ টাকাও পাবে না, কিন্তু এই বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে আমরা কমপক্ষে দশ লাখ টাকা পাব!”
মেকু একটু চমকে উঠল। তার আব্বা আম্মা তো বড়লোক নয়, দশ লাখ টাকা কেমন করে দেবে?
জরিনা বলল, “আমরা শুধু বাচ্চাটাকে তুলে এনেছি। বাচ্চাটার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কয়দিন রাখতে হবে জানি না, জামা কাপড় লাগবে। ন্যাপি লাগবে।”
মতি বলল, “ঠিক বলেছ। এলিফ্যান্ট রোডে বাচ্চাদের জিনিসপত্রের একটা দোকান আছে। সেখানে থামছি।”
গাড়ি থামার পর মতি আর জরিনা নেমে গেল। বদি থাক্ল পাহারায়। মেকুকে গাড়ির পিছনে শুইয়ে বদি গাড়ি থেকে নামল সিগারেট খেতে। মেকু একা একা শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। কোনোভাবে সে কী কাউকে কিছু বলতে পারে না? আশে পাশে কেউ এসে থামলে সে চেষ্টা করে দেখত, কিন্তু থামল না।
বেশ খানিকক্ষণ পর কেনাকাটা শেষ করে জরিনাকে নিয়ে মতি ফিরে আসে। তিন জন গাড়িতে বসে আবার রওনা দিয়ে দেয়, জরিনা গজ গজ করতে করতে বলল, “ইস কতগুলি টাকা বের হয়ে গেল। বাচ্চার জামা কাপড়ের এত দাম কে জানত।”
মতি বলল, “ছোটখাটো জিনিস নিয়ে মাথা ঘামিও না, এই টাকা সুদে-আসলে উঠে আসবে।”
বদি বলল, “তাড়াতাড়ি বাসায় চল। এই বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে থাকা ঠিক না। হঠাৎ করে যদি বিকট গলায় চিৎকার করে দেয় তখন কী হবে? আমি কিন্তু তা হলে সোজাসুজি বাচ্চার গলা টিপে ধরব।”
মতি কঠিন গলায় বলল, “খবরদার বদি, তুমি এই বাচ্চার গায়ে হাত দেবে না। এই বাচ্চা এখন সোনার খনি।”
গাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মেকু তার জামার নিচে লুকিয়ে রাখা প্যাকেটটা নিচে ফেলে দিল। মেকুর কপাল ভালো কেউ সেটা লক্ষ করল না। কেউ একজন এখন এটা পেয়ে ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করলেই হয়।
দরজার তালা খুলে প্রথমে মতি, তারপর মেকুকে কোলে নিয়ে জরিনা এবং সবশেষে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে বদি এসে ঢুকল। মেকুকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে জরিনা বলল, “মিশন কমপ্লিট।”
মতি শুদ্ধ করিয়ে দিয়ে বলল, “প্রথম অংশটা কমপ্লিট।”
জরিনা বলল, “প্রথম অংশটাই আসল।”
মতি বলল, “তা ঠিক। কিন্তু আমার সবচেয়ে প্রিয় অংশ হচ্ছে পরের অংশ। যখন আমি টেলিফোন করে ইলিয়াস আলীকে বলব তার বাচ্চা আমার কাছে তখন সে কী কাউ মাউ করে কাঁদবে! আমি হব তার হর্তা কর্তা বিধাতা। আমার উপরে নির্ভর করবে তার সবকিছু। আমি ইচ্ছা করলে হাসব, ইচ্ছা করলে ধমক দেব, ইচ্ছা করলে ব্যাটাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখব – ” মতি আনন্দে হা হা করে হাসতে লাগল।
বদি তার পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোন বের করে মতিকে দিয়ে বলল, “নাও। টেলিফোন কর।”
মতি টেলিফোনটা হাতে নিয়ে বলল, “আস্তে বদি আস্তে! একটু সময় দিতে হবে। এই সব কাজে তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই।”
জরিনা একটা সিগারেট ধরিয়ে বল্ল,”হ্যা। আগে কিছু খেয়ে নিই। খুব খিদে লেগেছে।”
“ঠিকই বলেছ।” বদি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এত খিদে লেগেছে যে মনে হচ্ছে একটা আস্ত ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারব।”
জরিনা বিরক্ত মুখে বলল, “বাজে কথা বল না। মানুষের খিদে লাগলে কখনো ঘোড়া খায় না। বুঝেছ?”