পরদিন সকাল বেলাতেই দুরানী চেষ্টা করল আটটা বাচ্চাকে আলাদা জায়গায় শুইয়ে রেখে ঘুম পাড়িয়ে দিতে। ছোট বাচ্চারা দিনের বড় একটা সময় ঘুমিয়ে কাটায় কিন্তু দেখা গেল যখন তাদের জোর করে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করানো হয় তখন কেউই ঘুমাতে চায় না। তাদের একজনকে শোয়ানোর চেষ্টা করানো হলে অন্য আরেক জন উঠে পড়ে এবং তারস্বরে চিৎকার শুরু করে। দুরানী খানিকক্ষণ চেষ্টা করে সেদিনের মতো হাল ছেড়ে দিল।
পরদিন দুরানী সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা পরিকল্পনা করে এল। বাচ্চাগুলিকে রেখে যাওয়ার সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সে তার ব্যাগ খুলে একটা ওষুধের শিশি বের করল। ওষুধটি কাশির ওষুধ – খেলে নাকি ঝিমুনির মতো হয়। ছোট বাচ্চাদের এক চামুচ খাইয়ে দিলে তারা নাকি কলাগাছের মতো ঘুমায়। ব্যাপারটা এখনি পরীক্ষা হয়ে যাবে। দুরানী একটা একটা বাচ্চাকে ধরে তার মুখে এক চামুচ করে ওষুধ ঢেলে দিলে এবং বাচ্চাগুলি সেটা কোঁত করে গিলে নিল। কফ সিরাপের ঝাঁজালো স্বাদে মুখ বিকৃত করে একটু আপত্তি করলেও কোনো কান্নাকাটি করল না। কিন্তু মেকুকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়েই দুরানী বিপদে পড়ে গেল। মেকুর যে এ ব্যাপারে আপত্তি থাকতে পারে সে ব্যাপারে দুরানীর সন্দেহ করার কোনো কারণ ছিল না, মুখের কাছে চামুচটা নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সে চুপ করে শুয়ে রইল। শেষ মুহূর্তে সে তার জোড়া পায়ের লাথি দিয়ে ওষুধের চামুচ এবং বোতলটা এক সাথে ফেলে দিল। চটচটে ওষুধে দুরানীর শাড়ি এবং ঘরের কার্পেট মাখামাখি হয়ে যায়।
দুরানী চিৎকার করে বলল, “পাজি ছেলে।”
মেকু তার জিব বের করে, ভ্যাররররররর করে একটা বিদঘুটে শব্দ করল। দুরানী তার শরীর এবং কার্পেট থেকে ওষুধ মোছার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু খুব একটা লাভ হয় না, সবজায়গায় কটকটে একটা লাল রং লেগে যায়। দুরানী এবারে চামুচে কফ সিরাপ নিয়ে দ্বিতীয়বার এগিয়ে এল। আগে থেকে পা এবং হাতকে চাপা দিয়ে রেখে সে মেকুর মুখের কাছে এগিয়ে গেল কিন্তু মেকু কিছুতেই মুখ খুলতে রাজি হল না। মাড়িতে মাড়ি চেপে মুখ বন্ধ করে রাখল, জোর করে খাওয়াতে গিয়ে মেকুর মুখে এবং শরীরে ওষুধে মাখামাখি হয়ে গেল।
দুরানী এবারে কেমন জানি খেপে যায়, যেভাবেই হোক ওষুধ খাইয়ে ছাড়বে। তাকে কোলে তুলে নিয়ে দুই পা বগলে চেপে ধরল, শরীর দিয়ে দুই হাত আটকে রাখল এবং এক হাত দিয়ে গালে চাপ দিয়ে মুখ খুলে অন্য হাত দিয়ে মুখের ভিতরে ওষুধ ঢেলে দিল। দুরানী যখন যুদ্ধ জয় করার ভঙ্গি করে মেকুকে ছেড়ে দিচ্ছিল মেকু তখন খুব নিশানা করে পুরো কফ সিরাপটুকু দুরানীর চোখে কুলি করে দিল। দুরানী মেকুকে কার্পেটে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে ছোটাছুটি করতে থাকে, চোখ ধোয়ার জন্যে দরজা খুলে বাথরুমে ছুটে যায়। চোখ মুছে যখন ফিরে এসেছে ততক্ষণে কফ সিরাপের শিশি উপুড় করে পুরো ওষুধটা ঢেলে দেওয়া হয়েছে – সেই চটচটে কফ সিরাপে একাধিক বাচ্চা গড়াগড়ি খাচ্ছে, সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে মেকু।
দুরানীর রাগ এবার দুশ্চিন্তায় রূপ নিল। তার পরিকল্পনায় ছিল সবাইকে এক চামুচ কফ সিরাপ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া – তিনজনকে সে খাইয়েও দিয়েছিল, তারা বেশ শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তারপরেই মেকুকে খাওয়াতে গিয়ে বিপত্তি, খাওয়ানো তো যায়ই নি উলটো সেই কফ সিরাপ মাখামাখি করে একটা বিতিকিচ্ছি অবস্থা করে ফেলেছে। বাচ্চাদের মায়েরা যখন আসবে তখন ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়বে। দুরানী কী করবে বুঝতে পারল না, ইচ্ছে করছিল দুই হাতে মেকুর গলা চেপে ধরে দেওয়ালে তার মাথা আচ্ছা মতন ঠুকে দেয়। অন্য কোনো বাচ্চা হলে অন্তত কান ধরে একটা ঝাঁকুনি দিত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মেকুর চোখের দিকে তাকিয়ে দুরানী সেরকম সাহস পেল না। এই বাচ্চাটি যে একটা মিচকে শয়তান সে ব্যাপারে এখন তার আর কোনো সন্দেহ নেই।
দুরানী বুঝতে পারল বাচ্চাদের মায়েরা আসার আগেই তাদের পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। চটচটে কফ সিরাপে তারা কেন মাখামাখি হয়ে আছে সেটা ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন হয়ে যাবে। সে এক টুকরা কাপড় ভিজিয়ে তাদের পরিষ্কার করার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু কাজটা খুব সহজ হল না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার বিরুদ্ধে তাদের একটা গভীর ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে হয়, কিছুতেই সে ব্যাপারে সহযোগিতা করতে চায় না। তাদের শরীরে হাত দেওয়া মাত্রই তারা তারস্বরে চিৎকার করতে শুরু করে। এ ব্যাপারে মেকু মনে হয় একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করছে, শুধু তার গায়ে হাত দিলে যে সে চিৎকার করছে তা নয়, অন্য কোনো বাচ্চার গায়ে হাত দিলেও সে বিকট চিৎকার শুরু করে দিচ্ছে। এর মাঝেই দুরানী যেটুকু পারল বাচ্চাগুলিকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করল, খুব একটা লাভ অবশ্যি হল না। কাপড়ে ক্যাটক্যাটে লাল রং এবং শরীরে কফ সিরাপের ঝাঁঝালো গন্ধ।
ব্যাপারটা আরো গুরুতর হয়ে গেল যখন আম্মা দুপুর বেলা দেখতে এসে আবিষ্কার করলেন মেকু উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আম্মা অবাক হয়ে বললেন, “মেকু ঘুমিয়ে আছে? এরকম সময় তো সে কখনোই ঘুমায় না।”
দুরানী অত্যন্ত অবাক হয়ে বলল, “এতক্ষণ তো জেগে ছিল। আপনাকে দেখেই মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।”
কথাটি সত্যি। মেকু চোখের কোণা দিয়ে তার আম্মাকে দেখে বোঝার চেষ্টা করল আম্মা তার ঘুমের ভানটি ধরতে পেরেছেন কি না।
আম্মা অবশ্যি ঘুমটি খাঁটি না ভেজাল সেটা নিয়ে মাথা ঘামালেন না, নাক কুঁচকে একটু ঘ্রাণ নিয়ে বললেন, “এখানে ওষুধের গন্ধ পাচ্ছি? কী ওষুধ?”
দুরানী আমতা আমতা করে বলল, “না মানে ইয়ে কোথায় ওষুধ? আমি তো মানে –”
মেকু এতক্ষণ উপুড় হয়েছিল ঠিক তখন সে গড়িয়ে চিৎ হয়ে গেল এবং আম্মা অবাক হয়ে দেখলেন সে দুই হাতে কফ সিরাপের শিশিটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। আম্মা আঁতকে উঠে বললেন, “সর্বনাশ! মেকু এই শিশি কোথায় পেল?”
আম্মা যেটুকু আঁতকে উঠেছেন দুরানী তার থেকেও বেশি আঁতকে উঠল, ওষুধের শিশিটা যে এখানে রয়ে গেছে সেটা তার মনে ছিল না, মেকু যে সেটা এভাবে ধরে পুরো ব্যাপারটা ফাঁস করে দিতে পারে সে আশঙ্কাটাও তার মাথায় খেলা করে নি। আম্মা ‘ঘুমন্ত’ মেকুর হাত থেকে কফ সিরাপের বোতলটা নিয়ে সেটা এক নজর দেখে মেকুর উপর ঝুঁকে পড়লেন, তার শরীরে ওষুধ লাগানো, কফ সিরাপের ঝাঁঝালো গন্ধে কাছে যাওয়া যায় না। আম্মা ঘুমিয়ে থাকা আরো তিন জন বাচ্চার কাছে গেলেন, তাদের দেখে আবার মেকুর কাছে ফিরে এলেন। মেঘস্বরে বললেন, “মেকু কী এই ওষুধ খেয়েছে?”
দুরানী দুর্বল গলায় বলল, “জি না খায় নাই।”
“নিশ্চয়ই খেয়েছে তা না হলে এই অসময়ে এভাবে ঘুমাচ্ছে কেন?”
দুরানী জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “জি না খায় নাই।”
“তা হলে মুখে গলায় কাপড়ে ওষুধ লাগানো কেন?”
“লাথি মেরে সবকিছু ফেলে দিল তাই শরীরে লেগেছে।”
“লাথি মেরে ফেলে দেওয়ার জন্যে ওষুধ পেল কোথায়?”
“এই চামুচে করে যখন একটু নিচ্ছিলাম — ”
“চামুচে করে ওষুধ নিচ্ছিলেন? কেন?”
“না মানে ইয়ে এই তো — ” দুরানী কথা বন্ধ করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
আম্মা কঠিন গলায় বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই কফ সিরাপ খাইয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চাইছিলেন। তাই না?”
দুরানী দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল।
“কাজটি খুব অন্যায় করেছেন। ছোট বাচ্চাদের এভাবে ওষুধ খাওয়ানো শুধু অন্যায় নয়। খুব বিপজ্জনক।”
মেকু চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। আম্মা তার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, “তুই মাথা নাড়ছিস কেন?”
মেকু সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে আবার গভীর ঘুমের ভান করতে লাগল। আম্মা দুরানীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “মনে হচ্ছে ছোট বাচ্চাদের দেখে শুনে রাখার কাজটা ঠিক পছন্দ করছেন না।”
দুরানী মাথা নাড়ল, বলল, “জি । কাজটা খুব কঠিন।”
আম্মা একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “ ছোট বাচ্চদের পছন্দ করলে কাজটা খুব সহজ না, কাজটা আনন্দের। কিন্তু আপনি যেহেতু ছোট বাচ্চদের পছন্দ করে না কাজটা আপনার জন্যে কঠিন এবং কষ্টের। আপনাকে এতগুলি বাচ্চার দায়িত্ব দেওয়া ঠিক না। এখানে রেনুকেই আবার নিয়ে আসতে হবে।”
মেকু তার মাড়ি বের করে আনন্দে হেসে ফেলল। আম্মা তার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, “তুই হাসছিস কেন?”
মেকু আবার মুখ বন্ধ করে ঘভির ঘুমের ভান করতে লাগল। কাজেই পরদিন থেকে আবার রেনুকে বাচ্চাদের দেখে শুনে রাখার কাজে বহাল করা হল।
০৪. কিডন্যাপ – মেকু কাহিনী
ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে বলে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে টেবিলে রাখা হয়েছে। মোমবাতির আলোতে টেবিল ঘিরে বসে থাকা তিন জনকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে, আলো নিচ থেকে এলে সবসময়েই চেহারা একটু অন্য রকম দেখায়, চেনা মানুষকেও তখন অচেনা মনে হয়। আজ অবশ্য অন্য ব্যাপার, যে তিনজন এখানে একত্র হয়েছে তারা একে অন্যকে খুব ভালো করে চেনে, একজনের কাছে অন্যজনকে অচেনা মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। মাঝামাঝি বসে থাকা মানুষটির নাম মতি, সে টেবিলে ঝুঁকে পড়ে বলল, “আমরা তা হলে কাজ শুরু করি।”
মতির ডান দিকে বসেছে বদি, সে খুব বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবে পরিচিত নয়। তবে মানুষটি খুব বিশ্বস্ত এবং বুদ্ধি বেশি নয় বলে বিপজ্জনক কাজগুলিতে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। বদি নাক দিয়ে একটা শব্দ করল, যেটাকে সম্মতি বলে ধরে নেওয়া যায়।
মতির বাম দিকে বসেছে জরিনা – যদিও মতির ধারণা এটা তার আসল নাম নয়। জরিনাকে দেখে তার বয়স বোঝা যায় না, এটা চব্বিশ থেকে চুয়াল্লিশের ভিতর যে কোনো একটা কিছু হতে পারে। মতিকে দেখে বলা যেতে পারে তার চেহারা ভালো, বদিকে দেখে সেরকম বলা যেতে পারে তার চেহারাটা বিশেষ সুবিধেয় নয় কিন্তু জরিনাকে দেখে বলার উপায় নেই চেহারাটা ভালো না খারাপ! মনে হয় এক সময় তার চেহারাটা ভালোই ছিল কিন্তু নানা অপকর্মের সাথে জড়িত থাকায় চেহারার মাঝে একটা খারাপ ছাপ পড়েছে সে কারণে চেহারাটা আর ভালো লাগে না। জরিনা টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা টেনে নিজের কাছে এনে একটা সিগারেট বের করে ঠোটে লাগিয়ে ফস করে একটা ম্যাচ জ্বালিয়ে সিগারেট ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, “শুরু কর।”
বদি বিরস মুখে জরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “মেয়ে মানুষের সিগারেট খাওয়া ঠিক না।”
জরিনা ঠোটের ডগা থেকে সিগারেটটা না সরিয়েই বলল, “আর একবার মেয়েদের সম্পর্কে এরকম একটা কথা বললে এই সিগারেট দিয়ে এরকম একটা ছ্যাকা দিব – ।”
বদি বলল, “আমি খারাপ কী বলেছি? মেয়েরা সিগারেট খেলে দেখতে ভালো লাগে?”
জরিনা ভুরু কুঁচকে বলল, “তোমার ধারণা মেয়েদের একমাত্র কাজ দেখতে ভালো লাগা?”
মতি বিরক্ত হয়ে বলল, “আহ! কী শুরু করেছ তোমরা? কাজের মাঝে গোলমাল।”
বদি আবার নাক দিয়ে একটা শব্দ করল, জরিনা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “নাও শুরু কর।”
মতি কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “মানুষটার নাম ইলিয়াস আলী, তার মশলার বিজনেস। থাকে নিউ ইয়র্ক। বড় মালদার পার্টি। দেশে দুই সপ্তাহের জন্যে আসে। এই দুই সপ্তাহ থাকার জন্যে মগবাজারে একটা ফ্ল্যাট কিনে রেখেছে। সারা বছর এই ফ্ল্যাট তালা দেওয়া থাকে, ইলিয়াস আলী যখন ঢাকা আসে তখন এখানে দুই সপ্তাহ থাকে।”
বদি জিজ্ঞেস করল, “মশলার বিজনেস করে মানুষ কীভাবে মালদার পার্টি হয় বুঝতে পারি না।”
মতি বদির দিকে তাকিয়ে বলল, “সেইটা তুমি বুঝতে পারছ না কারণ তোমার মাথায় কোনো ঘিলু নাই। পৃথিবীতে যে দুইটা জিনিষ সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট তার একটা হচ্ছে খাওয়া। আর খাওয়ার জন্যে দরকার রান্না। রান্নার জন্যে দরকার মশলা। যে মশলার বিজনেস করে তার মার্কেট কোঁত বড় জান?”
মতি ইতস্তত করে বলল, অন্য ইম্পরট্যান্ট জিনিসটা কী?”
“বাথরুমে গিয়ে তুমি যে কাজটা কর সেইটা।”
“বাথরুমে গিয়ে আমি কী করি?”
মতি ধমক দিয়ে বলল, “সেটা আমার বলে দিতে হবে?”
জরিনা বলল, “এসব ছেড়ে কাজের কোথায় আস।”
“হ্যাঁ। যেটা বলছিলাম। এই ইলিয়াস আলী এক সপ্তাহ আগে ঢাকা এসেছে। এবারে তার সাথে আছে তার নূতন বউ এবং নূতন বাচ্চা। বিয়ে হয়েছে এক বছর। বাচ্চা হয়েছে এক মাস।”
জরিনা জিজ্ঞেস করল, “এটা কী তার দ্বিতীয় বউ?”
“না। এটা চতুর্থ। ইলিয়াস আলীর হবি এন্টিক গাড়ি সংগ্রহ করা আর বিয়ে করা।”
জরিনা নারী জাতির পক্ষ থেকে ইলিয়াস আলীকে এবং সমগ্র পুরুষ জাতিকে একটা গালি দিল। মতি সেটা না শোনায় ভালো করে বলল, আমরা ইলিয়াস আলীর এই বাচ্চাটাকে কিডন্যাপ করব। বেশি বয়সের বাচ্চা – আমার ধারণা এই বাচ্চার জন্যে এই লোক কম করে হলেও দশ লাখ টাকা দেবে। এই টাকার মাঝে ভাগ বসানোর কেউ নেই, পুলিশকে দিতে হবে না, লোকাল মাস্তানকে দিতে হবে না, ইনকাম ট্যাক্সও দিতে হবে না।” মতি হা হা করে হাসল – তার ধারণা ইনকাম ট্যাক্সের কথা বলাটা খুবই উঁচু ধরনের রসিকতা হয়েছে।
জরিনা বলল, “টাকা রোজগার করা যদি এত সোজা হত তা হলে সবাই করত।”
মতি বলল, “যদি তোমার বুদ্ধি আর সাহস থাকে, ভালোমন্দ নিয়ে যদি মাথা না ঘামাও আর যদি কপাল খুব বেশি খারাপ না হয় তা হলে টাকা রোজগার করা খুব সোজা।”
বদি আধা দার্শনিক ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাল না, সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এল, “বাচ্চাটারে কিডন্যাপ করবে কীভাবে?”
“আমি সব খোঁজ নিয়েছি। দুপুর দুইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত এই একঘণ্টা সময় বাচ্চাটাকে ফ্ল্যাটে একজন মহিলার কাছে রেখে ইলিয়াস আলী আর তার বউ বাইরে বের হয়। এই সময় আমরা যাব, মহিলাকে একটা দাবড়ানি নিয়ে বাচ্চাটাকে নিয়ে বের হয়ে আসব।”
বদি জানতে চাইল, “দাবড়ানি মানে কী? মেরে ফেলব?”
মতি জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, “বদি, পারতপক্ষে মানুষ মারবে না। মানুষ মারলেই এক শ ঝামেলা। রিভলভারটা মাথায় ধরে ভয় দেখিয়ে বাথরুমে আটকে রাখবে।”
“ও।”
“কাজ পানির মতো সহজ। জরিনাকে সাথে নিতে হবে, বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হেঁটে নেমে আসবে। মায়ের কোলে শিশুর মতো নির্দোষ দৃশ্য পৃথিবীতে আর কিছু নাই। কেউ কিছু সন্দেহ করবে না।”
“নিয়ে আসার পর পালাবে কেমন করে?”
“আমি গাড়ি নিয়ে থাকব। বদি হবে বাচ্চার বাবা, জরিনা হবে বাচ্চার মা আর আমি হব গাড়ির ড্রাইভার।”
বদি ইতস্তত করে বলল, “তোমার চেহারা ছুরত ভালো, তুমি হও বাচ্চার বাবা, আমাই ড্রাইভার হিসেবে গাড়ি নিয়ে থাকি।”
“উঁহু।” মতি মাথা নাড়ল, “পালানোর গাড়িটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেটা ঠিকমতো করতে না পারলে পুরো পরিকল্পনাটা মাঠে মারা যাবে। সেই দায়িত্ব আর কাউকে দেওয়া যাবে না। আমাকে নিতে হবে।”
বদি গজগজ করে বলল, “আসলে আমাদের কোনো ঝামেলা হলে তুমি যেন পালাতে পার সেইজন্যে –”
মতি মৃদুস্বরে বলল, “বদি। পার্টনারকে যদি বিশ্বাস না কর তা হলে এই লাইনে আসবে না। এই লাইন হচ্ছে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং বিশ্বাসের লাইন। এই লাইন হচ্ছে –”
জরিনা খেঁকিয়ে ওঠে বলল, “এই সব ঢং বাদ দিয়ে ঠিক করে প্ল্যানটা করবে? ভিতরে যাব আমি আর বদি?”
“হ্যাঁ।”
“গাড়ি নিয়ে থাকবে তুমি?”
“হ্যাঁ।”
“বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে আমরা এইখানে ফেরত আসব?”
“হ্যাঁ।”
“কোনো কিডন্যাপ নোট দেব না?”
“না।”
“এখান থেকে ফোন করে টাকা চাইব?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে এখন তা হলে ডিটলসে যাওয়া যাক।” জরিনা মুখ শক্ত করে বলল, “ একশানে যাওয়ার সময় অস্ত্র হার্ডওয়ার পোশাক কী হবে?”
“দুইজনের কাছে দুইটা ছোট রিভলবার। একটা মোবাইল ফোন। ভদ্র পোশাক।”
বদি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেশ করল, “ভদ্র পোশাক মানে কি স্যুট?”
মতি হাত নেড়ে বলল, “আরে না। স্যুট হচ্ছে বকাদের পোশাক। মফস্বলের বিজনেসম্যান ছাড়া আর কেউ স্যুট পরে না। ভদ্র মানে ক্যাজুয়েল। জিন্স আর হাওয়াই সার্ট। জরিনার জন্যে সুতি শাড়ি।”
“সুতি শাড়ি? যদি দৌড়াতে হয়?”
“দৌড়াতে হলে দৌড়াবে।”
জরিনা চোখ পাকিয়ে বলল, “তুমি কখনো কাউকে শাড়ি পরে দৌড়াতে দেখেছ?”
“দেখি নাই। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। প্রকাশ্য দিনের বেলা একটা বাচ্চাকে কিডন্যাপ করতে হলে সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে। সেখানে পোশাক ইম্পরট্যান্ট। এটা মাস্তানি না। এটা ছিনতাই না। একটা উঁচুদরের কাজ। এইটা আর্ট।”
বদি নাক দিয়ে এক ধরনের শব্দ করে বলল, “আর্ট?”
মতি টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “হ্যাঁ। মানুষ নাটক সিনেমা করার আগে যেরকম রিহার্সেল দিয়ে রেডি হয় আমাদেরও সেই রকম রিহার্সেল দিতে হবে। খুঁটিনাটি দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে এর মাঝে ফাঁকি দেওয়ার জায়গা নেই। এটা হবে নিখুঁত একটা শিল্প কর্ম। এটা হবে –”
জরিনা তার সিগারেটটা নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলে বিরক্ত হয়ে বলল, “তুমি বড় বেশি কথা বল, মতি।”
মতি একটু থতমত খেয়ে থেমে গেল।