সেদিন রাত্রি বেলা টুম্পা তবুও একবার চেষ্টা করল। খাবার টেবিলে বাবা বাংলাদেশের ফতোয়াবাজ একজনের গল্প শেষ করে হা হা করে হাসছেন তখন টুম্পা বলল, আটলান্টিক সিটিতে একটা আর্ট কম্পিটিশন হচ্ছে, আমি কী সেখানে যেতে পারি?
বাবা হাসি থামিয়ে বললেন, কোথায়?
আটলান্টিক সিটিতে।
বাবা পরিষ্কার শুনেছেন তবুও না শোনার ভান করে বললেন, কোথায়?
আটলান্টিক সিটিতে।
বাবা মুখ শক্ত করে বললেন, আটলান্টিক সিটি হচ্ছে জুয়াখেলার জায়গা। তুই আটলান্টিক সিটি যেতে চাচ্ছিস মানে?
সেখানে একটা আর্ট কম্পিটিশন হচ্ছে—
আব্বু বাধা দিয়ে বললেন, এই দেশে ঢেকুর তোলার কম্পিটিশন হয় হচি মারার কম্পিটিশন হয় তার মানে তুই তার সবগুলোতে যেতে থাকবি?
টুম্পার আর কথা বলার ইচ্ছে করল না, সে চুপ করে গেল। বাবা তখন আরেকটু রেগে গেলেন, বললেন, আর্ট–ফার্ট এগুলো মাথা থেকে দূর কর। দুনিয়াটা কঠিন জায়গা আর্ট–ফার্ট দিয়ে এখানে কিছু হয় না। মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর যেন কোনো একটা চাকরি বাকরি পাস। বুঝলি?
টুম্পা মাথা নেড়ে জানালো যে সে বুঝেছে। বাবা এখন গজগজ করতে লাগলেন, বললেন, আমি বুঝতে পারি না তোদের এতো সময় কেমন করে হয় যে যত অ–জায়গা কু–জায়গার খোঁজখবর নেওয়ার সময় হয়।
টুম্পা তখন না বলে পারল না, আমি এর খোঁজ নিই নাই।
তাহলে এর খোঁজ পেলি কেমন করে?
টুম্পা কোনো কথা না বলে তখন তার ঘর থেকে মিসেস হেনরিকসনের চিঠিটা এনে নতুন বাবাকে দিলো। বাবা চিঠিটা পড়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ক্রিস্টিনা হেনরিকসন কে?
আমাদের স্কুলের একজন সাবস্টিটিউট টিচার।
ও।
আম্মু তখন বাবার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়লেন, পড়ে বললেন, কোথাও তো যায় না। নিয়ে যাই না হয় কম্পিটিশনে। আমি ড্রাইভ করে নিয়ে যাব–
বাবা চোখ লাল করে বললেন, এই বাসায় আমি আর্ট ফার্ট ঢুকতে দেব না। বুঝেছ?
আম্মু চুপ করে গেলেন।
বিষয়টা এখানেই শেষ হবার কথা কিন্তু শেষ হলো না। পরদিন স্কুল থেকে বাসায় এসে তালা খুলে ভেতরে ঢুকেছে। বাসায় কেউ নেই, আম্মু মনে হয় লিটনকে নিয়ে গ্রোসারি সেন্টারে গিয়েছেন। টুম্পা ফ্রিজ খুলে একটা হট ডগ বের করে মাইক্রোওয়েভে গরম করছে তখন টেলিফোন বাজলো। ফোন ধরে দেখে অন্যপাশে মিসেস হেনরিকসন। মিসেস হেনরিকসন খুশি খুশি গলায় বললেন, টুম্পা! কী খবর তোমার?
ভালো মিসেস হেনরিকসন। থ্যাংক ইউ।
তুমি আসছ তো আটলান্টিক সিটিতে? এটা খুব প্রেস্টিজিয়াস কম্পিটিশান। তোমার খুব কপাল ভালো এই বছর এটা আটলান্টিক সিটিতে হচ্ছে। দিনে দিনে ঘুরে চলে আসতে পারবে। মায়ামী না হয় লাসভেগাসে হলে
কী করতে?
টুম্পা ইতস্তত করে বলল, তা ঠিক।
ঠিক আছে, তাহলে দেখা হবে– মিসেস হেনরিকসন টেলিফোন রেখে দিচ্ছিলেন, টুম্পা তাকে থামাল, বলল, মিসেস হেনরিকসন, মিসেস হেনরিকসন–
কী হলো?
আসলে, আসলে—
আসলে কী?
আসলে আমার যাওয়া হবে না।
ও! মিসেস হেনরিকসন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, অন্য কোনো প্রোগ্রাম আছে?
না, সেরকম কিছু না। টুম্পা ইতস্তত করে ঠিক কী বলবে বুঝতে পারে
না।
তাহলে?
আসলে আমার বাসা থেকে যেতে দেবে না।
কথাটা বুঝতেই মিসেস হেনরিকসনের একটু সময় লেগে গেল। বোঝার পর জিজ্ঞেস করলেন, কেন যেতে দেবে না?
টুম্পার মনে হলো ধানাই পানাই না করে সত্যি কথাটাই বলে দেয়া ভালো, বলল, আসলে আমার বাবা–মা আমাকে কোথাও যেতে দেয় না।
কোথাও যেতে দেয় না?
না। স্কুল আর বাসা ছাড়া আমি কোথাও যেতে পারি না।
কেন?
টুম্পা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, বলল, আমি জানি না। তারা অন্য কালচারের মানুষ, এই কালচারকে ভয় পায়। আমার বাবা আর আম্মুর ধারণা আমি, আমি–
বুঝেছি। মিসেস হেনরিকসন বললেন, আমি দেখেছি এরকম আগেও।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মিসেস হেনরিকসন, কিন্তু বুঝতেই পরিছ। আমার কিছু করার নেই।
মিসেস হেনরিকসন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, টুম্পা।
হ্যাঁ, মিসেস হেনরিকসন।
আমি কী তোমার বাবার সাথে কথা বলে দেখব?
কোনো লাভ হবে না। উল্টো—
উল্টো কী?
টুম্পা বলল, উল্টো হয়তো তোমাকে কিছু একটা বলে দেবেন। আমার খুব লজ্জা লাগবে তখন।
মিসেস হেনরিকসন শব্দ করে হাসলেন, বললেন, তুমি সেটা নিয়ে চিন্তা করো না। আমাকে কেউ কিছু বললে আমি কিছু মনে করি না। তোমার বাবার টেলিফোন নাম্বারটা দাও।
টেলিফোন নাম্বারটা দিয়ে টুম্পা ইতস্তত করে বলেই ফেলল, মিসেস হেনরিকসন, আমার বাবা আমার সম্পর্কে অনেক কিছু বলে ফেলতে পারেন, তুমি তার সবকিছু বিশ্বাস করো না।
কী বলবে?
আমার এই বাবা আসলে আমার মায়ের দ্বিতীয় হাজব্যান্ড। আমার আসল বাবা ছিলেন প্রথম হাজব্যান্ড। সেই বাবার কথা আমার কিছু মনে নেই, কিন্তু শুনেছি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন তাই আমার নতুন বাবা সবসময় আমাকে বলেন আমার শরীরে পাগলের রক্ত আছে–
মিসেস হেনরিকসন থামিয়ে দিয়ে বললেন, ননসেন্স! যত্তোসব বাজে কথা। তুমি এই সব কথা বিশ্বাস করো না তো?
আমি বিশ্বাস করতে চাই না।
গুড়। শোনো–তুমি আমার টেলিফোন নাম্বারটা লিখে রাখো, যদি কখনো দরকার হয় আমাকে ফোন করবে। যে কোনো দরকার–
থ্যাংক ইউ মিসেস হেনরিকসন। মিসেস হেনরিকসন তার ফোন নম্বরটা দিয়ে টেলিফোনটা রেখে দিলেন।