বাধ্য হয়ে তখন কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয়, কী হয়েছে?
বাবা তখন হাত পা নেড়ে বলেন, একটা লঞ্চ বোঝাই করে মানুষ নিয়ে যাচ্ছে, কথা নাই বার্তা নাই মেঘনার মাঝখানে সেটা মার্বেলের মতো ডুবে গেল। পাঁচশ মানুষ শেষ।
আম্মু তখন বলেন, আহারে! আব্বু বিরক্ত হয়ে বলেন, রাখো তোমার আহারে! ঐ দেশে কোনো নিয়ম কানুন আছে নাকি? কোনো সেফটি রুল আছে নাকি? মানুষ মরবে না তো কী? কারো কোনো মাথ্য ব্যথা আছে?
আম্মু বলেন, তবুও তো। এতোগুলো মানুষ—
নতুন বাবার চোখ তখন উত্তেজনায় চক চক করতে থাকে, যড়যন্ত্রীর মতো বলেন, এতোগুলো মানুষ যে মরেছে সেটা এই দেশের কোনো নিউজে শুনেছ? পত্রিকায় দেখেছ? দেখ নাই।
এটা অবশ্যি সত্যি কথা এই দেশের কোথাও সেই খবর ছাপা হয় না। বাবা সেটা নিয়েও টিটকারি মারেন, বলেন, কেন নাই জান? কারণ বাইরের দুনিয়া বাংলাদেশের মানুষকে মানুষ বলেই গণ্য করে না। কেন করবে? তারা কী মানুষ হবার যোগ্য হয়েছে?
টুম্পার ইচ্ছে হয় সে বলে, বাবা এই সমস্যাটা তো বাংলাদেশের নয়। সমস্যাটা এই দেশের মানুষের। এতো বড় দুদর্শার খবর তারা শুনতে চাইবে না কেন? কিন্তু টুম্পা কিছু বলে না।
আবার কয়েকদিন পর নতুন বাবা মুখে এক গাল হাসি নিয়ে বলেন, টুম্পার বাংলাদেশে কী হয়েছে শুনেছ?
কেউ একজন জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?
চারদিন ধরে টানা হরতাল। সারা দেশের মানুষ ঘরে বসে হিন্দি সিনেমা দেখছে। আর রাস্তায় রাস্তায় মারপিট–
আম্মু জানতে চান, কেন? কী হয়েছে?
বাবা হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, সেই খবর কে জানে! বাংলাদেশের কোনো মাথামুণ্ডু আছে নাকি? তারপর টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলেন, তুই যে সারাক্ষণ বাংলাদেশ বাংলাদেশ করিস তোকে আসলেই একবার বাংলাদেশ পাঠানো উচিৎ। এক সপ্তাহের মাঝে সিধে হয়ে যাবি।
টুম্পা তখন বলে, আমার মনে হয় ভালোই লাগবে। বাংলাদেশের সংসদ ভবন হচ্ছে সারা পৃথিবীর মাঝে বিখ্যাত। লুই কান ডিজাইন করেছেন, দূর দূর দেশ থেকে মানুষ সেটা দেখতে আসে–
আব্বু চোখ পাকিয়ে বলেন, কংক্রিটের একটা দালান এর মাঝে দেখার কী আছে? দেখার মতো জিনিস হচ্ছে তাজমহল, পুরোটা শ্বেতপাথরের তৈরি। কোথায় শ্বেত পাথর আর কোথায় কংক্রিট!
টুম্পা তার নতুন বাবার সাথে তর্ক করে না। বাবা তখন গজ গজ করে বলেন, প্লেনের ভাড়া অনেকগুলো টাকা তা না হলে আমি সত্যিই তোকে বাংলাদেশ পাঠাতাম।
টুম্পা তখন বলে, আমি টাকা জমাচ্ছি। যখন প্লেনের টিকেটের টাকা হবে। তখন আমি নিজেই যাব।
গিয়ে কী করবি শুনি?
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যাংগ্রোভ ফরেস্ট হচ্ছে বাংলাদেশে। সুন্দরবন। সেখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার থাকে। সেই বাঘ দেখব।
লিটন তখন বলে, আমিও যাব। আমিও বাঘ দেখব।
টুম্পা বলে, আমি যখন বড় হবো অনেক টাকা হবে, তখন তোকে নিয়ে। যাব। এখন পারব না।
কেন পারবে না, কেন নেবে না বলে লিটন এখন টুম্পার সাথে ঝগড়া শুরু করে দেয়। বাবা ভুরু কুঁচকে টুম্পার দিকে তাকিয়ে থাকেন, বিড় বিড় করে বলেন, পাগলামি রোগ বংশগত। জিনেটিক। আমি আগেই বলেছি না?
.
আমেরিকার ইতিহাস ক্লাশ শেষে পি.এ, সিস্টেমে অফিস থেকে টুম্পাকে ডেকে পাঠালো তার একটা চিঠি নিয়ে নেবার জন্যে। স্কুলের চিঠিপত্র সাধারণত লাইব্রেরির বই ফেরত দেওয়া, গার্জিয়ানদের মিটিং এই সব নিয়ে হয়, গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় কিন্তু তবুও টুম্পা তখন তখনই চিঠিটা নিয়ে এল। খামের উপর তার নামটি হাতে লেখা, খামটি খুলে দেখে একটা খবরের কাগজের ক্লিপিং সাথে এক টুকরো সাদা কাগজে একটা চিঠি। চিঠিটা লিখেছেন মিসেস হেনরিকসন। চিঠিতে লেখা :
প্রিয় টুম্পা
সামনের উইক এন্ডে আটলান্টিক সিটিতে একটা ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা হবে। তোমার সাথে কথা না বলেই আমি তোমাকে সেখানে রেজিস্ট্রেশন করে দিয়েছি। তোমার রেজিস্ট্রেশন নম্বর বি ৫২৫৩, তুমি অবশ্যিই সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাবে।
তুমি হয়তো জান না, কিন্তু তুমি আসলে একজন অসাধারণ শিল্পী।
ক্রিস্টিনা হেনরিকসন
টুম্পা একটু অবাক হয়ে চিঠিটা আরেকবার পড়লো, তারপর খবরের কাগজের ক্লিপিংটা দেখলো। প্রতিযোগিতা তিন ক্যাটাগরিতে যাদের বয়স পাঁচ থেকে দশ তারা ক্যাটাগরি এ, যাদের বয়স দশ থেকে পনেরো তারা ক্যাটাগরি বি এবং যাদের বয়স পনেরো থেকে বিশ তারা ক্যাটাগরি সি। টুম্পার বয়স চৌদ্দ তাই সে ক্যাটাগরি বি। রেজিস্ট্রেশন ফী বিশ ডলার, মিসেস হেনরিকসন সেটা দিয়ে দিয়েছেন!
চিঠিটা হাতে নিয়ে ক্লাশে ফিরে আসতেই জেসিকা জিজ্ঞেস করলো, কিসের চিঠি? প্রিন্সিপালের? দাঁত বের করে হেসে বলল, মাতাল অবস্থায় স্কুলে আসার অপরাধে স্কুল থেকে বহিষ্কার?
টুম্পা হাসল, বলল, অনেকটা সেরকম!
তবু শুনি।
টুম্পা বলতে চাইছিল না, কারণ সে জানে তাকে বাসা থেকে কিছুতেই আটলান্টিক সিটি নিয়ে যাবে না। সে যে ছবি আঁকে বাসায় সেটাও ভালো চোখে দেখা হয় না। কিন্তু জেসিকা খুব কৌতূহলী মেয়ে সবারই সবকিছু তার জানা চাই। তাই টুম্পাকে চিঠিটা দেখাতে হলো! চিঠি পড়ে সে ক্লাশে হৈ চৈ শুরু করে দিল, এবং তখনই ডজন খানেক ছেলেমেয়ে টুম্পার সাথে আটলান্টিক সিটি যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল। টুম্পা যখন ছবি আঁকবে তখন তারা পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে নেচে কুদে তাকে উৎসাহ দেবে। টুম্পা এক ধরনের অস্বস্তি নিয়ে বসে থাকে, আসলে সে যেতে পারবে না এবং সেই কথাটি কীভাবে ক্লাশের সবাইকে বলবে সে জানে না।