রাত্রে খাবার টেবিলে দেখা গেল টুম্পার নতুন বাবার মেজাজ খুব খারাপ। মাঝে মাঝে অফিসে কিছু একটা ঝামেলা হয় আর সেই রাগটা বাসায় এসে লিটন আর টুম্পার উপর ঝাড়েন। আজকেও তাই হলো, লিটন প্লেটের ভাতগুলোকে একটা পাহাড়ের মতো বানিয়ে তার উপরে একটা চামুচ বসিয়ে সেটাকে মেশিনগান বানিয়ে গুলি করছিল আব্বু তখন তাকে ধমক দিলেন, কী হচ্ছে লিটন খাবার নিয়ে খেলা?
লিটন এখনো একটু গাধা রয়ে গেছে কখন চুপ করে থাকতে হয় শেখে নি, বাবাকে পাল্টা প্রশ্ন করে বললো, কী হয় আব্বু খাবার নিয়ে খেললে?
বাবা একটু থতমত খেয়ে গেলেন, গম্ভীর হয়ে বললেন, পৃথিবীতে এতো মানুষ না খেয়ে থাকে সেই খাবার নিয়ে খেলতে হয় না।
কোন মানুষ না খেয়ে আছে আব্বু?
বাংলাদেশেই লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে আছে।
টুম্পা এতোক্ষণ ইন্টারনেটে বসে বসে বাংলাদেশের উপর গবেষণা করে এসেছে কাজেই সে একটু প্রতিবাদ না করে পারল না, বলল, না বাবা, বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
বাবা চোখ পাকিয়ে বললেন, তুই কেমন করে জানিস? ইন্টারনেটে দেখেছি। বাবা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ঐ সব হচ্ছে বাকোয়াজ। বাংলাদেশে কী আছে? না আছে কোনো ইন্ডাস্ট্রি, না আছে কোনো তেল, না আছে কোনো রিসোর্স–আছে শুধু চোর আর বাটপার। যদি চোর আর বাটপার এক্সপোর্ট করা যেতো তাহলে বাংলাদেশ এতোদিনে বড়লোক হয়ে যেতো! কথা শেষ করে আব্বু হা হা করে হেসে উঠলেন যেন খুব মজার কথা বলেছেন।
লিটন জিজ্ঞেস করল, চোর, বাটপার কেমন করে এক্সপোর্ট করে আব্বু? টুম্পা বলল, ধুর গাধা! যেটা বুঝিস না সেটা নিয়ে কথা বলিস না।
আম্মু বললেন, কী যে হবে দেশটার। যখনই খোঁজ নিই শুনি হরতাল আর অবরোধ
টুম্পা আস্তে আস্তে বলল, এই সব গোলমালের মাঝেও বাংলাদেশের গ্রোথ ছয় পার্সেন্ট।
বাবা বললেন, দেশটা টিকে আছে ভিক্ষার উপর। আমেরিকা ইউরোপ যদি ফরেন এইড না দিতো তাহলে এতোদিনে দেখতে কী হতো। সব বঙ্গোপসাগরে ভেসে যেতো।
টুম্পা বলল, না বাবা। বাংলাদেশে ফরেন এইড হাফ বিলিয়ন থেকে কম! গার্মেন্টস–এর এক্সপোর্ট হচ্ছে আট বিলিয়ন। মিডল ইস্টের শ্রমিকেরা পাঠায়
আট বিলিয়ন।
বাবা মুখ শক্ত করে বললেন, তুই কেমন করে জানিস?
ইন্টারেনটে দেখেছি।
বাবা একটু থতমত খেয়ে বললেন, ঐ বিলিয়ন ডলারের হিসাব দিয়ে লাভ নেই। ঐ বিলিয়ন ডলার হচ্ছে খালি কাগজে কলমে। আসলে সব ফক্কা। আমি ঐ দেশটা দেখেছি। আমি জানি দেশটা হচ্ছে চোরের দেশ। সবাই চোর। তুই জানিস আমার জমিটা বিক্রি করার জন্যে কত টাকা ঘুষ দিতে হয়েছিল?
টুম্পার খুব ইচ্ছে করল বলতে, তুমি যদি ঘুষ দাও তাহলে তো তুমিও চোর কিন্তু সে বলল বললে তার ধড়ে আর মাথা থাকবে না।
জমি বিক্রি করার জন্যে বাবার কতো টাকা ঘুষ দিতে হয়েছিল সেটা জানার জন্যে টুম্পা কোনো প্রশ্ন করলো না দেখে বাবা মনে হয় আরেকটু রেগে গেলেন, বললেন, আমার কোনো কথা তোর বিশ্বাস হয় না বিশ্বাস হয় তোর ইন্টারনেট?
টুম্পা বুঝলো এখন কোনো কথা বললে আরো বিপদ হয়ে যাবে তাই সে চুপ করে রইলো। বাবা বললেন, এতোই যদি বাংলাদেশের উপর বিশ্বাস তাহলে এই দেশে পড়ে আছিস কেন? চলে যা বাংলাদেশে! গার্মেন্টসে কাজ কর গিয়ে।
টুম্পা এবারেও কোনো কথা বলল না। বাবা তখন আরো রেগে গেলেন, বললেন, শেষবার যখন গিয়েছি তখন দেখেছি, দেশটা যে শুধু চোর বাটপারের দেশ তা না, দেশটা হচ্ছে ময়লা আবর্জনার দেশ। মশা মাছি আর পোকা মাকড়ের দেশ। ফকির আর ফকিরনীর দেশ–
টুম্পার ঠিক কী হলো কে জানে, সে ফিস ফিস করে বলল, আমার খুব বাংলাদেশে যেতে ইচ্ছা করে।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, কী বললি?
টুম্পা মুখ তুলে একবার তার বাবা আরেকবার তার আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার খুব বাংলাদেশে যেতে ইচ্ছে করে।
কিছু না বুঝে লিটনও বললো, আমারও যেতে ইচ্ছা করে।
আব্বু চোখ পাকিয়ে লিটনের দিকে তাকালেন, লিটন সাথে সাথে বলল, ডিজনিল্যান্ডেও যেতে ইচ্ছা করে।
বাবা খাওয়া থামিয়ে টুম্পাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর কেন বাংলাদেশে যেতে ইচ্ছে করে?
দেখতে।
কী দেখতে?
সব কিছু। একটু থেমে বলল, বাংলাদেশে নাকি খুব সুন্দর বৃষ্টি হয়। পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে সুন্দর।
বাবা জোর করে একটু হাসার মতো শব্দ করলেন, তারপর আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার মেয়ের কথা শোনো! সে নাকি বৃষ্টি দেখতে যাবে বাংলাদেশ! মাথা খারাপ আর কাকে বলে!
আম্মু বললেন, নিজের দেশ দেখার সখ তো থাকতেই পারে! বাবা বললেন, না! নিজের দেশটা যদি হয় বাংলাদেশ তাহলে সেই সখ থাকে শুধু পাগলের বাবা হঠাৎ করে থেমে গেলেন তারপর কিছু একটা মনে পড়েছে সেরকম ভান করে বললেন, হয়তো সেটাই ঘটেছে! হাজার হলেও বাপের রক্ত আছে শরীরে। পাগলামির বীজ তো আসতে হবে কোথা থেকে! খুব বড় ধরনের রসিকতা হয়েছে এরকম ভান করে আব্বু হা হা করে হাসতে লাগলেন। নির্মম আনন্দহীন হাসি। টুম্পা মাথা নিচু করে খাওয়ার ভান করতে থাকে। লিটন টুম্পার হাত ধরে বলল, পাগলামির বীজ মানে কী আপু?
০৩. আর্ট কম্পিটিশন
টুম্পা যখন তার নতুন বাবাকে বলেছিল যে তার খুব বাংলাদেশে যেতে ইচ্ছে। করে সে কিন্তু সেটা খুব ভেবেচিন্তে বলে নি–কিন্তু সেই কথাটি বলার কারণে বাসায় তার অবস্থাটা আগের থেকে খারাপ হয়ে গেল। বাবা এখন সময়ে অসময়ে সেটা দিয়ে তাকে খোটা দেন। যেমন সবাই মিলে খেতে বসেছে, তখন বাবা বলবেন, আমাদের টুম্পার বাংলাদেশে কী হয়েছে তোমরা শুনেছ?