আম্মু বললেন, হাত মুখ ধুয়ে আয়। কিছু খাবি।
টুম্পা লিটনকে ঘাড় থেকে নামিয়ে স্কুল ব্যাগটা তুলে নিজের ঘরে গেল। ছোট এই ঘরটাই হচ্ছে তার পৃথিবী, ভাগ্যিস তার নিজের এই ছোট একটা পৃথিবী আছে যেখানে এসে সে সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারে। টেবিলে তার কম্পিউটার, দেওয়ালে ফ্রেন্ডস এর একটা পোস্টারে রস, জোয়ী, মনিকা, চ্যান্ডলার, র্যাচেল আর ফিবি গলাগলি করে দাঁড়িয়ে আছে। টুম্পার নতুন বাবা তার ঘরে খুব বেশি আসেন না। যখন আসেন তখন এই পোস্টারটা দেখে খুব বিরক্ত হন আর বিড় বিড় করে বলেন, এটা ঘরে টানানোর একটা জিনিষ হলো? ছিঃ! ভাগ্যিস তার নতুন বাবা কোনোদিন টেলিভিশনে ফ্রেন্ডস দেখেন নি, যদি দেখতেন তাহলে নির্ঘাত পোস্টারটা টেনে ছিঁড়ে ফেলতেন। টুম্পা জানালায় পর্দা টেনে দেয়, পিছনে একটা ছোট বনের মতো, সেখানে অনেকগুলো পাইন গাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। এই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে টুম্পার খুব ভালো লাগে। তার কাছে সবচেয়ে সুন্দর লাগে যখন তুষারে সবকিছু ঢেকে যায়, পৃথিবীতে কী এর চাইতে সুন্দর কোনো দৃশ্য আছে?
টুম্পা বাথরুমে গিয়ে হাত–মুখ ধুয়ে নিচে নেমে আসে। আম্মু রান্নাঘরের ছোট টেবিলে এক স্লাইস পিতজা গরম করে রেখেছেন। পিতজার দোকানে গরম গরম পিতজা খেতে খুব মজা কিন্তু ফ্রিজ থেকে বের করে আনা পিতজার মতো জঘন্য আর কী হতে পারে? টুম্পা অবশ্যি কিছু বলল না, ফ্রিজ থেকে। কোকের বোতল বের করে এক গ্লাস কোক নিয়ে পিতজার স্লাইসটা খেতে থাকে। একটা খাবার যত অখাদ্যই হোক কোকের সাথে সেটা খেয়ে ফেলা যায়।
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, স্কুল কেমন হলো?
ভালো। টুম্পার হঠাৎ করে মিসেস হেনরিকসনের কথা মনে পড়ল। বলল, আচ্ছা আম্মু তুমি কী জর্জ হ্যারিসনের কনসার্টের কথা জান? বাংলাদেশের উপর হয়েছিল। উনিশশো একাত্তর সালে?
আম্মুকে একটু বিভ্রান্ত দেখা গেল, ইতস্তত করে বললেন ও আচ্ছা! মনে হয় শুনেছি। অনেক আগের ব্যাপার–
তুমি কী জেসোর রোড কবিতাটা পড়েছ?
কী রোড?
জেসোর। জেসোর রোড।
কে লিখেছে?
এলেন গিনসবার্গ।
আম্মু ভুরু কুঁচকে চিন্তা করতে থাকেন। হঠাৎ করে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বললেন, ও আচ্ছা, যশোর রোড। যশোরকে জেলোর বললে আমি বুঝব কেমন করে?
যশোর রোড কী?
যশোর হচ্ছে বাংলাদেশের একটা শহর। সেই শহর থেকে যে রাস্তাটা গেছে সেটা হচ্ছে যশোর রোড।
টুম্পা পিতজা স্লাইসের শেষ টুকরোটা মুখে জোর করে ঠেসে দিয়ে বলল, তুমি কবিতাটা পড় নি?
নাহ্। আম্মু মাথা নাড়লেন, ইংরেজি কবিতা আর কয়টা পড়েছি। তবে এটার উপর মৌসুমী ভৌমিকের একটা গান আছে সেটা শুনেছি।
বাসায় আছে সেটা আম্মু?
থাকার কথা। খুঁজে দেখ। আম্মু একটু অবাক হয়ে বললেন, তুই কবে থেকে বাংলা গানের জন্যে এত পাগল হয়ে গেলি?
না পাগল হই নাই। আজকে স্কুলে একজন বললেন তো তাই শুনতে চাচ্ছিলাম।
কী বলেছে?
বাংলাদেশের কথা।
আমেরিকান মানুষ?
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। মিসেস হেনরিকসন। আমাদের সাবস্টিটিউট টিচার।
আম্মু মুখ শক্ত করে বললেন, বন্যা সাইক্লোন এইসব নিয়ে কথা বলেছে নিশ্চয়ই।
টুম্পা মাথা নাড়ল। আম্মু বললেন, তাই হবে। কবে যে দেশটা ঠিক হবে–এই দেশ নিয়ে কেউ ভালো একটা কথা বলতে পারে না।
টুম্পা বলল, আসলে মিসেস হেনরিকসন, বাংলাদেশ নিয়ে ভালো ভালো কথাই বলেছেন।
ছাই বলেছে। বন্যা সাইক্লোন নিয়ে কথা বললে ভালো কথা বলা হলো? এগুলো ভালো কথা?
টুম্পা আর তর্ক করল না। সিডির স্তূপ থেকে মৌসুমী ভৌমিকের গানের সিডিটা খুঁজে বের করে সে নিজের রুমে এনে যশোর রোড গানটি শুনল। এতো সুন্দর গানের কথাগুলো, আর মৌসুমী ভৌমিক এতো সুরেলা গলায় এতো দরদ দিয়ে গানটি গেয়েছে যে টুম্পার মনে হলো সে বুঝি পুরো দৃশ্যটি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। সে ভাসা ভাসা ভাবে জানে উনিশশো একাত্তর সালে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, প্রায় এক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছিল, মানুষ মারা গিয়েছিল তিরিশ লক্ষ, কিন্তু সেই দুঃখ কষ্ট আর যন্ত্রণার বিষয়টা সে আগে কখনোই ঠিক করে অনুভব করে নি। এই গানটা শুনতে শুনতে মনে হলো সে প্রথমবারের মতো সেটা অনুভব করল। পৃথিবীর অপর পৃষ্ঠে তার একটা দেশ আছে, সেই দেশের মাটিতে তার জন্ম হয়েছিল, সেটাই তার জন্মভূমি। দেশটা ঠিক তার মতোই দুঃখী! অনেক কষ্ট করে সেই দেশের জন্ম হয়েছিল এখন সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে অনেক কষ্ট করছে। ঠিক কী কারণ জানা নেই, যে দেশটিকে সে দেখেনি শুধু মাত্র সেই দেশের মাটিতে জন্ম নিয়েছিল বলে টুম্পা তার বুকের ভেতর সেই দেশটির জন্যে গভীর এক ধরনের মমতা অনুভব করতে থাকে।
টুম্পার ক্লাশের বন্ধু বান্ধবেরা যখন মলে দুবার চক্কর খেয়ে সিনেমা হলে ঢুকেছে জনি ডেপের শেষ সিনেমাটা দেখার জন্যে তখন টুম্পা তার ছোট ঘরটায় কম্পিউটারের সামনে বসে রইলো। ইন্টারনেটে বাংলাদেশ নিয়ে যত রকম তথ্য পাওয়া যায় সে এক ধরনের ছেলেমানুষী আগ্রহ নিয়ে সেগুলো দেখতে থাকে। টুম্পা অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো এই দেশটিকে টিকিয়ে রেখেছে এই দেশের গরিব মানুষেরা, যারা চাষবাস করে, গার্মেন্টসে কাজ করে কিংবা দেশে বিদেশে গিয়ে ছোটখাটো কাজ করে। আর দেশটাকে লুটেপুটে খায় বড়লোকেরা, মন্ত্রীরা, ব্যবসায়ীরা! এতো কষ্টের দেশকে টিকিয়ে রাখছে গরিব মানুষেরা আর লুটেপুটে খাচ্ছে বড়লোকেরা সেটা পড়েই টুম্পার রক্ত কেন জানি গরম হয়ে উঠতে থাকে!