শুক্রবার সন্ধ্যেবেলা টুম্পা সে কিছুই করছে না কিন্তু কথাটা সে বলতে পারল না, কারণ তাকে বাসা থেকে এই আমেরিকান বন্ধুদের সাথে কোথাও যেতে দেবে না। টুম্পা সরল মুখ রেখে বলল, শুক্রবার বাসায় একটা পার্টি আছে–বাসায় থাকতে হবে।
ও! আমরা সিনেমা দেখতে যাব। জনি ডেপের নতুন মুভিটা রিলিজ হয়েছে।
আমি মিস করব। টুম্পা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, জনি ডেপ তার খুব প্রিয় অভিনেতা।
সামনের উইক এন্ডে আমরা শহরে যাব, তখন চলো আমাদের সাথে।
হ্যা! টুম্পা উজ্জ্বল মুখে বলল, তখন যাব তোমাদের সাথে। অনেক মজা হবে। টুম্পা খুব ভালো করে জানে সামনের উইক এন্ডে যখন যাবার সময় হবে তখন তাকে যেতে না পারার জন্যে আরেকটা কৈফিয়ত খুঁজে বের করতে হবে। অনেক সোজা হতো সে যদি সবাইকে সত্যি কথাটা বলে দিতে পারতো তাহলে তাকে এই যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হতো না। কিন্তু টুম্পা কাউকে বলতে পারে না, তার বাবা–মা তাকে বিশ্বাস করে কোথাও যেতে দেয় না বলতে তার খুব লজ্জা হয়।
বাস থেকে জেসিকা নেমে যাবার পর টুম্পা বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। শহর ঘুরে ঘুরে একেবারে শহরের শেষ মাথায় তাদের বাসা। প্রত্যেকদিনই তাকে অনেকক্ষণ বাসে সময় কাটাতে হয়, তার ভালোই লাগে। তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে কী করবে? টুম্পার মনে হয় সে যতক্ষণ বাইরে থাকে ততক্ষণই বুঝি সে স্বাধীনভাবে আছে। যখন বাসায় পৌঁছাবে তখনই তার ওপর একশরকম নিয়ম কানুন চেপে বসবে। তার বয়স এখন তেরো, এই বয়সের ছেলে মেয়েদের জন্যে এখানে কতো কী করার আছে, তার কিছুই সে করতে পারে না। ভাগ্যিস তার ছবি আঁকার সখটা ছিল তাই যখন খুব মন খারাপ হয় সে বসে বসে ছবি আঁকে। সবকিছু ভুলে যেতে পারে তখন। তা না হলে যে কী হতো–মনে হয় সে পাগলই হয়ে যেতো।
পাগল! বাসায় তাকে কথায় কথায় এই কথাটা শুনতে হয়, তার শরীরে পাগলের রক্ত আছে সে জন্যে তার সবকিছু নাকি উল্টাপাল্টা। কথাটা বলেন তার বাবা, আসল বাবা নয় তার সৎ বাবা। টুম্পার আসল বাবা নাকি পাগল ছিল, তার আম্মুকে এতো অত্যাচার করতো যে আম্মু আর না পেরে টুম্পাকে নিয়ে পালিয়ে আমেরিকা চলে এসেছেন। আসল বাবার পুরো জীবন নাকি কেটেছে পাগলা গারদে। শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। এতোদিনে নিশ্চয়ই মরে টরে গেছেন। টুম্পার নতুন বাবা বলেন যে বাংলাদেশে ভালো মানুষই বেঁচে থাকতে পারে না, পাগল বেঁচে থাকবে কেমন করে? বাংলাদেশকে নিয়ে সবসময় তার নতুন বাবাও নাক শিটকান। আজকে মিসেস হেনরিকসনের কথা শোনার আগে টুম্পা কোনোদিন বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা ভালো কথা শোনে নি। টুম্পার নতুন বাবাও তো বাংলাদেশের, একটা মানুষের তার নিজের দেশের জন্যে মায়া থাকে না কেন টুম্পা কখনো ঠিক করে বুঝতে পারে না।
স্কুল বাসটা তার বাসা থেকে এক ব্লক দূরে থেমে গেল। স্কুল ব্যাগটা নিয়ে বাস থেকে নামার সময় টুম্পা হাত নেড়ে বাস ড্রাইভার মিসেস রজার্সকে বিদায় জানালো। পাহাড়ের মতো বড় মিসেস রজার্স বললেন, সাবধানে থেকো সোনা। কাল আবার দেখা হবে!
একেবারেই সাধারণ গৎবাধা স্নেহের কথা কিন্তু শুনে টুম্পার বুকের ভেতর টন টন করে ওঠে, তার বাসায় কেউ তাকে এই নরম কথাগুলো বলে না। সত্যিকারের বাবার কথা তার একটুও মনে নেই, নতুন বাবার সাথে বিয়ে হওয়ার আগে তার আম্মু তাকে খুব আদর করতেন, বিয়ে হয়ে যাবার পর সব কেমন যেন ওলট পালট হয়ে গেল। টুম্পার বয়স তখন মাত্র ছয় কিছুতেই সে বুঝতে পারছিল না কেন তার আম্মুকে অচেনা একটা মানুষকে বিয়ে করতে হবে। বিয়ের দিন কী কান্নাটাই না কেঁদেছিল এখনো মনে আছে। তার নতুন বাবাকে সে ভয় পেতো, ছোট বাচ্চারা সব কিছু নিজেদের মতো করে বুঝতে পারে সেও বুঝেছিল এই মানুষটা তাকে পছন্দ করে না। হাসি হাসি মুখ করে তাকে আদর করার ভান করতেন কিন্তু তার মাঝে কোনো ভালোবাসা ছিল না।
তার ছোট ভাই লিটনের জন্ম হল এক বছর পর, তার নতুন বাবা আর আম্মু লিটনকে নিয়ে এতো ব্যস্ত হয়ে গেলেন যে টুম্পা বলে যে কেউ আছে সেটা যেন কারো মনেই থাকলো না। সে যখন আরো ছোট ছিল তখন তার খুব হিংসে হতো, এখন একটু বড় হয়েছে এখন আর হিংসে হয় না, মাঝে মাঝে একটু অভিমান হয়। তবে লিটনকে সে খুব আদর করে। মনে হয় তার নতুন বাবা আর আম্মু থেকে সেই লিটনকে বেশি আদর করে।
টুম্পার কাছে বাসার একটা চাবি আছে, দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখে লিটন একটা খেলনা বন্দুক নিয়ে ছোটাচ্চুটি করছে, টুম্পাকে দেখে গুলি করতে করতে তার দিকে ছুটে এল। টুম্পাও তার দুই হাতকে দুটো পিস্তল বানিয়ে লিটনকে গুলি করার ভান করে। তারপর ব্যাগটা নিচে রেখে সে লিটনের পিছু ধাওয়া করে তাকে ধরে ঘাড়ে তুলে নিয়ে কাতুকুতু দেয়, লিটন হাত পা ছুঁড়ে হাসতে হাসতে আনন্দে চিৎকার করতে থাকে।
আম্মু রান্নাঘর থেকে বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন, টুম্পা, মা এসেছিস?
টুম্পার কী মনে হলো কে জানে, বাংলায় উত্তর দিলো, বলল, হ্যাঁ, আম্মু এসেছি।
বাসায় তার নতুন বাবা আর আম্মু সবসময় বাংলায় কথা বলেন, টুম্পা যখন ছোট ছিল সেও খুব সুন্দর বাংলা বলতে পারতো। যতোই বড় হচ্ছে বাংলাতে দখল কমে আসছে। লিটন এখন পরিষ্কার বাংলায় কথা বলে, স্কুলে যেতে শুরু করা মাত্রই আস্তে আস্তে বাংলা ভুলে যেতে শুরু করবে।