টুম্পা আব্বুর কাছে গিয়ে ডাকলো, আব্বু।
আব্বু যেন একটু চমকে উঠে টুম্পার দিকে তাকালেন, টুম্পা!
হ্যাঁ আব্বু।
তুই তুই তাহলে সত্যিই চলে যাচ্ছিস।
হ্যাঁ আব্বু।
এখন মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে—
কী মনে হচ্ছে?
আব্বু মাথা নাড়লেন, বললেন, নাহ্! কিছু না।
বল আব্বু কী বলতে চাচ্ছ।
মনে হচ্ছে তুই না এলেই ভালো ছিল। তাহলে আমি জানতামই না তুই আছিস! আমি যেরকম ছিলাম সেরকম থাকতাম–
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, না আব্বু। তাহলে আমি কোনোদিন তোমাকে দেখতেই পেতাম না।
কিন্তু এখন যে খুব মন খারাপ লাগছে।
আমারও খুব মন খারাপ হচ্ছে কিন্তু আব্বু তোমাকে শক্ত হতে হবে।
আব্বু মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ আমি শক্ত আছি।
আমি আবার আসব আব্বু। প্লেনের ভাড়া জোগাড় হলেই চলে আসব।
ও আচ্ছা! আব্বুর হঠাৎ করে কী যেন মনে পড়ল, পকেট থেকে একটা খাম বের করে টুম্পার হাতে দিলেন। বললেন, নে।
এটা কী?
এক্সিবিশনের ছবিগুলি থেকে যে টাকাটা এসেছে সেইটা ডলারে করে দিয়েছি। তোর আর প্লেনের টাকার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে না।
এই খানে কতো ডলার আছে?
গুণি নাই। পাঁচ ছয় হাজার হবে।
টুম্পা চোখ কপালে তুলে বলল, পাঁচ ছয় হাজার ডলার? সর্বনাশ! এতো টাকা নিয়ে আমাকে যেতে দেবে না।
দেবে দেবে। আব্বু বললেন, এটা কী তুই চুরি করে নিচ্ছিস যে নিতে দেবে না?
সবকিছুর একটা নিয়ম আছে–
আব্বু হাত নেড়ে পুরোটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমি কী নিয়ম ভেঙে তোকে টাকা দিচ্ছি? বাবা মেয়েকে টাকা দিতে পারবে না এটা কোন দেশি নিয়ম?
আব্বু তুমি বুঝতে পারছ না—
আমি ঠিকই বুঝতে পারছি, তুই বুঝতে পারছিস না।
টুম্পা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে আমি এক হাজার ডলার নিয়ে যাই–একটা টিকেটের দাম।
উহুঁ। আব্বু মাথা নাড়লেন, আমি এখানে টাকা দিয়ে কী করব?
তোমার একটা টেলিফোন কিনতে হবে। আমি প্রতিদিন তোমার সাথে কথা বলব।
ঠিক আছে কিনব।
আর একটা কম্পিউটার কিনবে। তার সাথে ইন্টারনেটের কানেকশান।
তাহলে আমি তোমাকে দেখতে পাব, তুমি আমাকে দেখতে পাব। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
সে জন্যে টাকাগুলো রাখ।
আব্বু বললেন, আমার সেজন্যে টাকা আছে।
টুম্পা বলল, কিন্তু আব্বু–
আব্বু একটু আহত গলায় বললেন, টুম্পা তুই এমন করছিস কেন? এই পৃথিবীতে তুই ছাড়া আমার আর কে আছে? তোকে যদি না দিই তাহলে আমি কাকে দিব? তুই না-না করিস না তো। এমনিতেই আমার মন ভালো নেই, তুই আরো মন খারাপ করে দিচ্ছিস।
টুম্পা একটু থতমত খেয়ে বলল, ঠিক আছে আব্বু। টুম্পা প্যাকেটটা ব্যাগে রাখতে রাখতে বলল, থ্যাংকু আব্বু। অনেক থ্যাংকু।
আব্বু কোনো কথা বললেন না। কেমন যেন আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, টুম্পার দিকে তাকিয়ে আছেন কিন্তু দেখে মনে হয় আব্বু যেন ঠিক দেখছেন না। টুম্পা ডাকলো, আব্বু।
হ্যাঁ মা।
আমি প্রতিদিন তোমার সাথে কথা বলব আর প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি লিখব।
ঠিক আছে।
তোমাকে কিন্তু উত্তর দিতে হবে। দিবে তো?
দিব।
আর তোমাকে ছবি আঁকতে হবে। বলেছ না যে বিশাল একটা ওয়েল পেইন্টিং করবে–সেটা শুরু করবে।
শুরু করব।
ওষুধ খেতে ভুলবে না। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
আমি কিন্তু খোঁজ নেব।
ঠিক আছে।
টুম্পা তার আব্বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি এখন যাই?
আব্বু টুম্পাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলেন। টুম্পা বলল, যাই আব্বু?
আব্বু ভাঙা গলায় বললেন, যা। কিন্তু টুম্পাকে যেতে দিলেন না, তাকে ধরে রাখলেন। টুম্পা খুব সাবধানে আব্বুর হাত সরিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো, সে আব্বুর মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না, তার শুধু মনে হচ্ছিল আব্বুর মুখের দিকে তাকালেই সে বুঝি ঝরঝর করে কেঁদে দেবে। টুম্পা আব্বুর হাত ধরে ফিস ফিস করে বলল, আবার দেখা হবে আব্বু।
তারপর আবুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামনে হেঁটে যেতে থাকে। চেকিং কাউন্টারের সামনে মানুষের লম্বা লাইন, টুম্পা সবার পিছনে দাঁড়িয়ে দেখলো আব্বু তখনো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে তার চারপাশে কী হচ্ছে আব্বু কিছুই বুঝতে পারছে না।
মুখ ঘুরিয়ে টুম্পা তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। পিছনে দাঁড়ানো একজন বিদেশি মহিলা সেটা দেখতে পায় নি এরকম ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।
মিনিট দশেক পর টুম্পা ইমিগ্রেশানের লাইনে দাঁড়িয়েছে, বুকের ভেতর কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, মনে হচ্ছে সে যেন একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, স্বপ্নের দৃশ্যগুলো সে দেখছে কিন্তু অনুভব করতে পারছে না। তার ঠিক পিছনে একজন মা তার ছোট ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়েছেন, ছেলেটা একটানা কথা বলে যাচ্ছে, মা ধৈর্য ধরে শুনছে মাঝে মাঝে উত্তর দিচ্ছে। ছোট ছেলের অর্থহীন কথা ভেবে টুম্পা কান দিচ্ছিল না হঠাৎ করে সে তার কথা শুনে চমকে উঠল। ছেলেটি জিজ্ঞেস করছে, আম্মু, কেন কাঁদছে মানুষটা?
তার কেউ একজন চলে যাচ্ছে মনে হয় সে জন্যে কাঁদছে।
তার কে যাচ্ছে?
ছেলে কিংবা মেয়ে। কিংবা ওয়াইফ।
কিন্তু আম্মু যারা ছোট তারা কাঁদে। বড় মানুষ কী কাঁদে?
খুব যখন দুঃখ হয় তখন বড় মানুষেরাও কাঁদে।
মানুষটাকে পুলিশ কেন ধরে রাখছে আম্মু?
মানুষটা যে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছে সে জন্যে।
ছোট বাচ্চাটা মায়ের হাত ধরে বলল, মানুষটা কেন ভেতরে ঢুকতে চাচ্ছে আম্মু?