.
দেখতে দেখতে টুম্পার ফিরে যাওয়ার দিন চলে এল। বিকেল বেলা ফ্লাইট দুপুরে সবাই একসাথে শেষবারের মতো খেতে বসেছে। ছোটখালা বললেন, আজকে দুপুরে তুই তোর বাবার সাথে থাকলেই পারতি!
গত কয়েকদিন তো ছিলামই। আজকের দিনটা আমি তোমাদের সাথে কাটাতে চাইছিলাম।
ছোটখালা বললেন, তুই এসে শুধু কষ্টই করে গেলি! তোকে ভালো মন্দ কিছু খাওয়াতেও পারলাম না।
কী বল ছোট খালা। আমি এসেছিলাম শুকনো পাতলা, ফিরে যাচ্ছি নাদুসনুদুস গোলগাল! পাশপোর্টের ছবির সাথে মিলবে না, ইমিগ্রেশন না আটকে দেয়!
সুমি বলল, তাহলে তো ভালোই হয়। তোমাকে আর কোনোদিন যেতে হবে না। তুমি এখানে থেকে যাবে!
আমারও যেতে ইচ্ছে করছে না।
রুমি বলল, তুমি আবার কবে আসবে?
প্লেনের ভাড়া জোগাড় করলেই চলে আসব।
ছোট খালা মাথা নাড়লেন, বললেন, হ্যাঁ সবাইকে নিয়ে চলে আসবি। অনেকদিন তোর মাকে দেখি না। বাচ্চাটাকে তো দেখিই নাই।
টুম্পা বলল, আমরা আসলে তো তোমাদের আরও কতো ঝামেলা।
সুমি বলল, কে বলেছে ঝামেলা, কতো মজা হয়।
কী মজাটা হয়েছে? সবাই মিলে রাঙ্গামাটি বান্দরবান যাবার কথা ছিল, গিয়েছি? টুম্পা বলল, আমার জন্যে তোদের কোথায় যাওয়া হলো না।
সুমি বলল, কিন্তু তার বদলে আমরা মেজো খালুর ছবি প্রদর্শনী করেছি। কী মজা হয়েছিল মনে আছে?
রুমি বলল, হ্যাঁ। মেজো খালু তার একটা ছবি দিয়ে দিলেন আমাদেরকে। সেইটা বিক্রি হলো দেড় লাখ টাকায়! আমাদের তিনজনের একেকজনের পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবার কথা। আম্মুর জন্যে সেটা পেলাম না–একেকজন পেলাম মাত্র পাঁচশো টাকা!
এই ছোট বাচ্চা এতো টাকা দিয়ে কী করবি?
ছোট খালু বললেন, বুলবুলের তো কোনো প্র্যাকটিক্যাল জ্ঞান নেই! তাকে দেখে শুনে রাখতে হবে–সে দিলেই তোরা নিবি কেন?
রুমি চোখ বড় বড় করে বলল, চিন্তা করতে পার? পঞ্চাশ হাজার টাকা! তার বদলে পেলাম মাত্র পাঁচশ টাকা।
সুমি বলল, ভালো করে ছবি আঁকা শিখে নে, তাহলে তোর ছবিও একদিন লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হবে।
টুম্পা বলল, ভ্যানগগের একটা ছবি বিক্রি হয়েছিল পয়ষট্টি মিলিয়ন ডলারে।
ছোট খালু রুমিকে বললেন, ভ্যানগগ তার কান কেটে বান্ধবীকে উপহার দিয়েছিলেন। তুই পারবি তোর কান কেটে উপহার দিতে? আছে কোনো বান্ধবী?
তার চাইতে আমি মেজো খালুর এসিস্টেন্ট হয়ে যাব। বাটিতে রং গুলে দেব, তুলি গুলো ধুয়ে রাখব। মেজো খালু খুশি হয়ে মাঝে মধ্যে আমাকে একটা ছবি দিবেন, আমি সেইটা বিক্রি করেই বড় লোক হয়ে যাব।
সুমি হি হি করে হেসে বলল, এই আইডিয়াটা খারাপ না!
টুম্পা বলল, রুমি অলরেডি আব্বুর জন্যে অনেক কাজ করেছে। মনে আছে এক্সিবিশনের দিনগুলিতে সে কতো সুন্দর করে সবার কাছে ক্যাটালগ দিয়েছে!
রুমি বলল, আমি এতো পরিশ্রম করলাম অথচ আমাকে একবারও টেলিভিশনে দেখালো না। দেখালো আম্মুকে! এই পৃথিবীতে কোনো বিচার নাই।
সুমি বলল, আরে গাধা। সেদিন আম্মু ছিল চিফ গেস্ট। চিফ গেস্টকে দেখাবে না তো কী তোকে দেখাবে?
ছোট খালু বললেন, তোদের আম্মু পরিশ্রম করে নাই কে বলেছে? অনেক পরিশ্রম করেছে।
সুমি আর রুমি এক সাথে প্রতিবাদ করল, কী পরিশ্রম করেছে আম্মু? কতো পরিশ্রম করে সেজেছিল মনে আছে? আমাদের বিয়ের দিনও এরকম সাজ দেয় নাই!
ছোটখালা প্রতিবাদ করে কিছু বলতে চাইছিলেন, টুম্পা তাকে সুযোগ না দিয়ে বলল, ছোট খালাকে টেলিভিশনে কী সুন্দর লাগছিল মনে আছে? একেবারে সিনেমার নায়িকার মতো!
ছোটখালু বললেন, থাক থাক এইভাবে বল না। এমনিতেই বাসায় থাকতে পারি না। এইভাবে বললে আর দেশেই থাকতে পারব না। তোমার সাথে আমাদের আমেরিকা চলে যেতে হবে!
সুমি হঠাৎ করে বলল, ইশ টুম্পা আপু! তুমি সত্যিই চলে যাবে!
টুম্পা কিছুক্ষণ সুমির দিকে তাকিয়ে বলল, দেখ সুমি আমি যখন যাব তখন কিন্তু নো কান্নাকাটি। সবাই হাসবে। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
তোমাদের কেউ যদি একটুও মন খারাপ করো তাহলে আমি কিন্তু একেবারে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকবো–তখন তোমরাই বিপদে পড়ে যাবে! আমি কিন্তু খুব অল্পতেই কেঁদে ফেলি।
ছোট খালাও মুখ কালো করে বললেন, আমিও।
সুমি বলল, আমিও।
ছোট খালু বললেন, মনে হচ্ছে এটা তোমাদের বংশগত সমস্যা।
সুমি বলল, আন্তু এটা সমস্যা না, এটা হচ্ছে গুণ। এর অর্থ আমাদের মন খুব নরম। বুঝেছ?
আব্বু বললেন, বুঝেছি।
ছোটখালা হঠাৎ একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এবং তখন একসাথে সবাই চুপ করে গেল। হঠাৎ করে কেউ বলার মতো আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না। সবাই অপেক্ষা করতে লাগলো যে অন্য কেউ একটা কথা বলবে কিন্তু কেউই কিছু বলল না। সবাই চুপ করে বসে রইল।
.
এয়ারপোর্টে ছোটখালা, ছোটখালু রুমি সুমির কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় কেউ কাঁদল না। সবাই ভান করতে লাগলো পুরো বিষয়টা একটা মজার বিষয় এবং তারা বিনা কারণে হাসতে লাগলো। ছোটখালা টুম্পাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে চুমু খেলেন তারপর ফিস ফিস করে বললেন, আমরা এখন যাই। তুই তোর আব্বুর কাছে যা। মানুষটা একা একা দাঁড়িয়ে আছে।
।টুম্পা বলল, ঠিক আছে ছোটখালা।
সবাই চলে যাওয়া পর্যন্ত টুম্পা অপেক্ষা করল তারপর সে তার আব্বুর কাছে গেল। আব্বু এক কোণায় দাঁড়িয়ে অন্যমনস্কভাবে তার গাল ঘষছিলেন। সকালে মনে হয় শেভ করেন নি, সেজন্যে মুখে ছোট ছোট দাড়িতে একটা নীলচে আভা এসেছে। আব্বুর এমনিতেই চুল আচড়াতে মনে থাকে না, চুলগুলো এলোমেলো, একটা আধময়লা ফতুয়া আর রং ওঠা জিনসের প্যান্ট পরে আছেন, তারপরেও তাকে একজন রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছে। এতো সুন্দর একটা মানুষকে ছেড়ে তার আম্মু কেমন করে চলে গিয়েছিলেন?