দারওয়ান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, মানুষটি তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কিসের দাওয়াত? বিয়ে না জন্মদিন?
টুম্পা বলল, না। ছবির এক্সিবিশন।
ও! মানুষটার চোখে একটু কৌতূহল ফুটে উঠল। জিজ্ঞেস করল, কার ছবি?
টুম্পা বলল, বুলবুল রায়হানের সলো এক্সিবিশান।
মানুষটা মনে হলো একটা ইলেকট্রিক শক খেয়ে গেল, বলল, কার ছবি?
বুলবুল রায়হান।
বুলবুল রায়হান বেঁচে আছে? শুনেছিলাম সুইসাইড করেছে—
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, না। আমার আব্বু মোটেই সুইসাইড করেন নি। আব্বু বেঁচে আছেন, ছবি আঁকছেন।
মানুষটি চোখ বড় বড় করে বলল, তুমি বুলবুল রায়হানের মেয়ে।
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।
আমি শুনেছিলাম বুলবুল রায়হানের ওয়াইফ তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমেরিকা চলে গেছেন?
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ আমি আমেরিকা থেকে এসেছি।
কিন্তু কিন্তু—
কিন্তু কী?
মানুষটা ইতস্তত করে বলল, আমি যতদূর জানতাম বুলবুল রায়হান পাগল হয়ে গিয়েছিল–
টুম্পা মুখটা শক্ত করে বলল, আব্বুর স্কিঞ্জাফ্রেনিয়ার একটু সমস্যা আছে।
তাহলে?
এবারে সুমি বলল, মেজো খালুর অনেক বড় সমস্যা ছিল, কোনো ডাক্তার ভালো করতে পারে নি। টুম্পা আপু এসে দুই সপ্তাহের মাঝে ভালো করে ফেলেছে–
কীভাবে?
সুমি রহস্যের ভান করে বলল, ম্যাজিক!
মানুষটা একবার সুমির দিকে আরেকবার টুম্পার দিকে তাকালো তারপর বলল, এটা দিয়ে অসম্ভব ভালো একটা স্টোরি হয়।
টুম্পা বুঝতে পারল না, জিজ্ঞেস করল, কী হয়?
খবরের কাগজের একটা নিউজ হয়। মানুষটা টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী খুব ব্যস্ত?
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, না।
তাহলে তুমি একটু ভেতরে আস। তোমার একটা ইন্টারভিউ নেই। তারপর ক্যামেরাম্যান নিয়ে যাব বুলবুল রায়হানের কাছে, তার একটা ইন্টারভিউ নেব চমৎকার একটা স্টোরি হবে। হার্ট টাচিং স্টোরি–
খবরের কাগজের এই স্টোরির জন্যেই কী না কে জানে এক্সিবিশন দেখার জন্যে সত্যি সত্যি অসংখ্য মানুষ চলে এল। পত্রপত্রিকার অনেক সাংবাদিক, তার সাথে সবগুলো টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান। গ্যালারির ভেতরে ছবিগুলো টানানো হয়েছে। একটা লাল ফিতে টানানো হয়েছে, সেটা কেটে সবাই ভেতরে ঢুকবে। আব্বু একটা জিনসের প্যান্টের উপর একটা ফতুয়া পরেছেন। তাকে দেখতে এতো সুন্দর দেখাচ্ছে যে টুম্পা চোখ ফেরাতে পারে না। ছোটখালা সেজেগুঁজে এসেছেন, ব্যস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছিলেন, অতিথিদের দেখে ব্যস্ত হয়ে এসে বললেন, কতো লোক আর সাংবাদিক এসেছে দেখেছিস? দেশি মানুষ থেকে বিদেশিই তো বেশি! আর দেরি করে লাভ নেই, ফিতে কেটে ভেতরে ঢুকে যাওয়া যাক।
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, ফিতে কাটবে কে?
ছোটখালা মাথা চুলকে বললেন, একজন প্রধান অতিথি বানানো উচিৎ ছিল! প্রধান অতিথি সবসময় ফিতে কাটে!
বানাও নাই?
না, ভুলে গেছি।
সুমি বলল, তাহলে কী হবে?
টুম্পা বলল, আমার মাথায় একটু বুদ্ধি এসেছে।
কী বুদ্ধি?
তুমি আমাদের প্রধান অতিথি। তুমি ফিতে কাটবে–
ছোটখালা চোখ কপালে তুলে বললেন, ধূর গাধা! আমি ফিতে কাটব কেমন করে–
কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। টুম্পা সবার সামনে গিয়ে প্রথমে বাংলায় তারপর ইংরেজিতে ঘোষণা করে দিয়েছে যে ছোটখালা ফিতে কেটে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন! ছোটখালার এতো সাংবাদিক এতো টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে লজ্জায় লাল নীল বেগুনি হয়ে ফিতে কাটলেন। সবাই গ্যালারির ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল টেলিভিশনের ক্যামেরা কাঁধে একজন সবাইকে থামালো, বলল, শিল্পী কিছু বলবেন না?
আব্বু বললেন, না! আমি কিছু বলব না।
একজন সাংবাদিক বলল, না, না, শিল্পীকে কিছু বলতে হবে। সবসময় বলে। বলেন কিছু একটা।
আব্বু বললেন, কী বলব?
কেমন করে ছবি আঁকলেন এইসব।
আব্বুকে প্রথমে একটু অসহায় দেখায় কিন্তু বেশ তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলেন। হাত দিয়ে মাথার চুলকে সোজা করতে করতে বললেন, আসলে আজকে এখানে এই সলো এক্সিবিশান হওয়ার কথা ছিল না। আমি আসলে একজন অসুস্থ মানুষ। আপনারা আপনাদের চারপাশে যা কিছু দেখেন আমি সেগুলো দেখি না–আমি অন্য কিছু দেখি। সেগুলো ভয়ের, সেগুলো দুঃখের এবং মাঝে মাঝে সেগুলো আতংকের। সেই ভয় থেকে বাঁচার জন্যে আমি একটা অন্ধকার ঘরে লুকিয়ে থাকতাম। সেই ভয় থেকে আমি মুক্তি পেতাম না কিন্তু আমি ভাবতাম আমার আর কিছু করার নেই!
তখন আমার মেয়ে এসে আমাকে উদ্ধার করেছে। বড় বড় ডাক্তারেরা যেটা পারে নি আমার মেয়ে সেটা করতে পেরেছে। সেই ভয়টাকে মেনে নিয়ে আমাকে বেঁচে থাকতে শিখিয়েছে। আবার নতুন করে ছবি আঁকতে শিখিয়েছে। তাই এই সলো এক্সিবিশানটা আসলে আমার নয়। এটি আমার মেয়ে টুম্পার। এই গ্যালারির দেয়ালে টানানো এগুলো ছবি নয়–এগুলো হচ্ছে আমার মেয়ের জন্যে আমার ভালোবাসা! আর কিছু নয়।
আব্বুর কথা শুনে টুম্পার চোখে পানি এসে গেল, অনেকগুলো টেলিভিশন ক্যামেরা তার দিকে তাক করে ছিল বলে সে তার চোখ মুছতে পারল না।
.
ঘণ্টাখানেক পর ছোটখালা খুব ব্যস্ত হয়ে টুম্পার কাছে এলেন, বললেন, সর্বনাশ হয়েছে!
টুম্পা ভয় পেয়ে বলল, কী হয়েছে?
বিদেশিগুলো ছবি কিনতে চাইছে। আমরা তো দাম বসাই নি। আমাকে দাম জিজ্ঞেস করছে?
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, তুমি কতো বলেছ?