জেসিকা বলল, কিন্তু মিসেস হেনরিকসন, তুমি তো বলেছ তুমি জ্যামিতি জান না। তুমি কেমন করে জ্যামিতি পড়াবে?
মিসেস হেনরিকসন চোখ মটকে বললেন, দেখতে চাও কেমন করে পড়াব?
একটা মজার গন্ধ পেয়ে সবাই বলল, দেখতে চাই।
চমৎকার। মিসেস হেনরিকসন একটা চক হাতে নিয়ে বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, তাহলে বল, জ্যামিতির জনক কাকে বলা হয়?
ক্লাশের সবাই বলল, ইউক্লিড।
চমৎকার। মিসেস হেনরিকসন বোর্ডে চক দিয়ে লিখলেন ইউক্লিড। তারপর ঘুরে ক্লাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবারে বলে ইউক্লিড কোন দেশের মানুষ?
ক্লাশের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে চিৎকার করে বলল, গ্রিস।
চমৎকার! এবার তাহলে চলো আমরা দেখি গ্রিস দেশটা কোথায়! সেটা জানার জন্যে দরকার একটুখানি ভূগোল!
মিসেস হেনরিকসনের কথা শুনে সবাই হাসতে শুরু করে। মিসেস হেনরিকসন হাসলেন না, মুখ শক্ত করে বললেন, তার আগে দেখা যাক তোমাদের মাঝে গ্রিক কেউ আছে কি না।
পিছন থেকে জর্জিওস তার হাত তুললো। জর্জিওসকে সবাই জর্জিওস হিসেবেই জানতো সে যে আসলে কি সেটা কেউ জানতো না। মিসেস হেনরিকসন চোখ বড় বড় করে বললেন, পৃথিবীর সবচেয়ে চমকপ্রদ জাতি হচ্ছে গ্রিক জাতি। তাদের ঐতিহ্য হচ্ছে মহান ঐতিহ্য! জ্ঞানে বিজ্ঞানে এই জাতি পৃথিবীকে যা দিয়েছে পৃথিবী তার ঋণ কখনো শোধ করতে পারবে না–
টুম্পা আবিষ্কার করল, একটু আগে মিসেস হেনরিকসন বাংলাদেশ সম্পর্কে যে রকম সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন এখন ঠিক সেরকম গ্রিকদের নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলছেন। এমন ভাবে বলছেন যে পুরো গ্রিক দেশটাই যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। টুম্পা অবাক হয়ে দেখলো জর্জিওস নিজেও চোখ বড় বড় করে মিসেস হেনরিকসনের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছে। টুম্পা যেরকম বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু জানে না, জর্জিওসও মনে হয় গ্রিস দেশ সম্পর্কে কিছুই জানে না। মিসেস হেনরিকসন ঠিকই বলেছেন, সবাই মনে হয় নিজের দেশের কথা ভুলে এই দেশে এসে জমা হয়েছে!
টুম্পা অন্যমনস্কভাবে মিসেস হেনরিকসনের কথা শুনতে শুনতে খাতার পৃষ্ঠায় আঁকিবুকি করতে থাকে। নিজের অজান্তেই সে কখন মিসেস হেনরিকসনের ছবি আঁকতে শুরু করেছে সে জানে না। নাকের ডগায় চশমা, কৌতূহলী চোখ ঠোঁটের কোণায় একটা বিচিত্র হাসি, কাঁচাপাকা এলোমেলো চুল, দুই হাত উপরে তুলে কথা বলছেন–
এই মেয়ে, তুমি কী করছ?
মিসেস হেনরিকসনের কথা শুনে টুম্পা চমকে উঠে তার কাগজটা আড়াল করার চেষ্টা করল, কিন্তু মিসেস হেনরিকসন ছবিটা দেখে ফেললেন। এগিয়ে এসে বললেন, দেখি। দেখি।
টুম্পার কোনো উপায় থাকল না, কাগজটা দেখাতে হলো। মিসেস হেনরিকসন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অবাক হয়ে বললেন, ও মা! তুমি কী সুন্দর ছবি এঁকেছ আমার।
পাশে বসে থাকা এলিজাবেথ বলল, আমাদের ঠোম্পা খুব সুন্দর ছবি আঁকে মিসেস হেনরিকসন! ঠোম্পা আমাদের ক্লাশ–আর্টিস্ট!
টুম্পা অনেক চেষ্টা করেও তার ক্লাশের ছেলেমেয়েদেরকে টুম্পা বলানো শেখাতে পারে নি। সবাই তাকে ডাকে ঠোম্পা।
মিসেস হেনরিকসন ছবিটা তুলে সবাইকে দেখালেন, বললেন, দেখেছ?
জিম বলল, এটা বেশি ভালো হয় নাই, ঠোম্পা আরও অনেক ভালো আঁকতে পারে।
কী বলছ ভালো হয় নাই? মিসেস হেনরিকসন বললেন, তোমরা শুধু ওর স্কেচটা দেখছ আসল জিনিসটা দেখছ না! সে আমার চরিত্রটাকে ধরে ফেলেছে– দেখে তাকিয়ে!
টুম্পা কী বলবে বুঝতে পারল না, আসলে মিসেস হেনরিকসন ঠিকই বলেছেন, ছবিতে মানুষের চেহারা ফুটিয়ে তোলা সহজ। তার চরিত্রটা ছবিতে আনতে পারাটা কঠিন। টুম্পা সবসময় চেষ্টা করে একটা মানুষের আসল চরিত্রটা ছবিটার মাঝে নিয়ে আসতে, অনেকক্ষণ ধরে কাউকে লক্ষ্য করতে পারলে সে বেশ খানিকটা করতে পারে।
মিসেস হেনরিকসন বললেন, তোমার নামটা হচ্ছে–
টুম্পা। টুম্পা রায়হান।
বাহ্। কী সুন্দর নাম। টুম্পা রায়হান।
টুম্পা একটু অবাক হয়ে দেখলো মিসেস হেনরিকসন তার নামটা ঠিক ঠিক উচ্চারণ করেছেন, অন্য কেউ হলে টুম্পা রায়হান না বলে বলতো ঠোম্পা ডাইহান! তবে তার নামটা আসলে সুন্দর না, তার একেবারেই পছন্দ না। কেন জানি তার মনে হয় গুরুত্ব দিয়ে নামটা রাখা হয় নাই।
মিসেস হেনরিকসন একটু এগিয়ে এসে বললেন, টুম্পা, তোমার এই ছবিটা আমাকে দেবে?
কেন দেব না! টুম্পা থতমত খেয়ে বলল, তুমি চাইলে একশোবার দেব। কিন্তু এই ছবিটাতো আসলে বেশি ভালো হয় নাই–আরেকটু সময় পেলে আরো ভালো করে, এঁকে দিতে পারতাম!
এটাই যথেষ্ট ভালো হয়েছে। তাড়াহুড়া করে তুমি যেটা এঁকেছু সেটাই আমি চাই। মিসেস হেনরিকসন ছবিটা টুম্পার ডেস্কের উপর রেখে বললেন, তুমি ছবির নিচে আজকের তারিখ দিয়ে একটা সিগনেচার করে দাও!
টুম্পা অবাক হয়ে বলল, সিগনেচার?
হ্যাঁ, সিগনেচার। তুমি যখন অনেক বিখ্যাত হয়ে যাবে তখন আমি এটা সবাইকে দেখাব।
টুম্পা একটু হেসে ছবির নিচে তার নামটা লিখে দিল। মিসেস হেনরিকসন তখন সেটা হাতে নিয়ে বললেন, থ্যাংক ইউ টুম্পা। থ্যাংক ইউ ভেরিমাচ। তারপর এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
০২. নতুন বাবা
স্কুল বাসে টুম্পার পাশে বসেছে জেসিকা। একটা বড় চকলেটের বার চিবাতে চিবাতে বলল, শুক্রবার সন্ধ্যেবেলা কী করছ?