ক্লাশের সবাই একটা বিস্ময়ের মতো শব্দ করল। মিসেস হেনরিকসন টুম্পার দিকে তাকিয়ে বললেন, তাই না?
টুম্পা আবার অনিশ্চিতের মতো মাথা নাড়ল যার উত্তর হ্যাঁ কিংবা না দুটোই হতে পারে। মিসেস হেনরিকসন আবার একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, পশ্চিমা প্রেস সবসময় বাংলাদেশের খারাপ পাবলিসিটি করেছে তার কারণ তারা আসলে এই জাতিটার শক্তিটা ধরতে পারে নি। জিম জানতে চাইল, সত্যিকারের শক্তিটা কী?
বাংলাদেশ হচ্ছে একটা বদ্বীপ। এমন একটা জায়গা যেখানে প্রায় প্রত্যেক বছর একটা বন্যা না হয় একটা ঘূর্ণিঝড় হয়। তারা যেরকম বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে টিকে থাকে আমরা সেটা কল্পনাও করতে পারব না। প্রকৃতি কিছুতেই তাদের হারাতে পারে না। এই জাতি অসম্ভব কষ্টসহিষ্ণু, প্রকৃতি তাদের শুইয়ে দেবার চেষ্টা করে, তারা আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়। ফ্যান্টাস্টিক। আমাদের একটা মাত্র ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল ক্যাটারিনা তখন আমাদের কী অবস্থা হয়েছিল মনে আছে?
সবাই মাথা নাড়ল, তাদের মনে আছে। মিসেস হেনরিকসনের হঠাৎ করে কিছু একটা মনে পড়ল, চোখ বড় বড় করে বললেন, তোমরা সবাই নিশ্চয় এই বছরের নোবেল পুরস্কারের কথা শুনেছ। শান্তির জন্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশের একজন।
টুম্পা এবারে মাথা নাড়ল, সে এই তথ্যটা জানে। দেখা গেল আরো কয়েকজনও সেটা জানে। মাইকেল বলল, প্রফেসর উনুস।
টুম্পা শুদ্ধ করে দিল, বলল, না। উচ্চারণ ইউনূস। প্রফেসর ইউনূস।
মিসেস হেনরিকসন বললেন, দারিদ্র্য কীভাবে দূর করা যায় তার উপর অসাধারণ কাজ করেছেন প্রফেসর ইউনূস। তোমাদের সবারই সেটা জানা দরকার। আমাদের দেশে এতো সম্পদ তারপরেও এখানে অনেক গরিব মানুষ আছে, এটা ঠিক না। জাতি হিসেবে এটা আমাদের ব্যর্থতা। খুব বড় ব্যর্থতা।
মিসেস হেনরিকসন এমনভাবে মাথা নাড়লেন যেন এই পুরো ব্যর্থতাটা তার নিজেরই, তিনি নিজেই যেন এই দোষটা করে ফেলেছেন।
বাংলাদেশের এতো প্রশংসা করার পর নিজের দেশের ব্যর্থতার কথা বলা হচ্ছে দেখে কেভিনের মনে হলো একটু রাগ হলো, সে গম্ভীর গলায় বলল, আমাদের অনেক সাফল্যও আছে মিসেস হেনরিকসন।
মিসেস হেনরিকসন সুন্দর করে হাসলেন, বললেন, অবশ্যই আছে। একশোবার আছে। তোমরা যদি ইউরোপ যাও কিংবা এশিয়া যাও দেখবে তারা আমাদের আমেরিকানদের শুধু সমালোচনা করছে। কিন্তু মজার ব্যাপার কী জান?
কী মিসেস হেনরিকসন?
তারা চোখ বন্ধ করে আমাদের অনুকরণ করে। আমরা যেটা করি সেটাই। হয়ে যায় পৃথিবীর কালচার। ভুল হোক আর শুদ্ধ হোক তাতে কিছু আসে যায় না। মিসেস হেনরিকসন আবার হি হি করে হাসতে থাকলেন, যেন এর থেকে মজার ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না।
ক্লাশের ছেলেমেয়েরাও হাসবে কী না সেটা বুঝতে পারল না, কয়েকজন একটু চেষ্টা করে থেমে গেল কারণ মিসেস হেনরিকসন হঠাৎ হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে গেছেন। গম্ভীর হয়েই বললেন, আচ্ছা বল দেখি, আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি কী?
জিম বলল, এটম বোমা।
উহুঁ। মিসেস হেনরিকসন মাথা নাড়লেন, বোমা কখনো কোনো জাতির শক্তি হতে পারে না।
জেসিকা বলল, গণতন্ত্র।
সেটা একটা শক্তি, কিন্তু পৃথিবীর আরো অনেক দেশে গণতন্ত্র আছে। সত্যি কথা বলতে কী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র হচ্ছে ভারতবর্ষে–এক বিলিয়ন থেকেও বেশি মানুষের গণতন্ত্র।
জেনি বলল, কম্পিউটার–
মিসেস হেনরিকসন মাথা নাড়লেন, বললেন, উহুঁ। এই সায়েন্স, টেকনোলজি কালচার এগুলোই শক্তি কিন্তু সেটা নির্ভর করে মানুষগুলোর উপর। আমাদের শক্তি হচ্ছে এই দেশের মানুষ। কেন জান?
জেসিকা জিজ্ঞেস করল, কেন?
কারণ এই দেশের মানুষের একটা খুব বড় বৈশিষ্ট্য আছে। পৃথিবীর সব দেশ আসলে শুধু একটা দেশ। সেই দেশে শুধু সেই দেশের মানুষ থাকে। জার্মানিতে থাকে জার্মানরা, ফ্রান্সে থাকে ফ্রেঞ্চরা, ইন্ডিয়াতে থাকে ইন্ডিয়ানরা, চায়নাতে থাকে চীনারা–শুধু আমেরিকাতে থাকে সব দেশের মানুষ। এখানে জার্মানরা থাকে। ফ্রেঞ্চরা থাকে। ইন্ডিয়ানরা থাকে। চাইনিজরা থাকে। বাংলাদেশিরা থাকে। ইরাকিরা থাকে। ইরানিরা থাকে। আমেরিকা আসলে একটা দেশ না, এটা আসলে ছোট একটা পৃথিবী। সব দেশের মানুষ এখানে পাশাপাশি থাকে, সবাই নিজের কালচারকে বাঁচিয়ে রাখে, আবার এখানকার কালচার গ্রহণ করে। এটা হচ্ছে সারা পৃথিবীর মানুষের একটা মিলন মেলা…
মিসেস হেনরিকসনের চোখগুলো কেমন যেন ঢুলু ঢুলু হয়ে গেল, কথা বলার সময় মনে হলো ঠিক যেন কথা বলছেন না, যেন একটা কবিতা আবৃত্তি করছেন, কিংবা নিচু গলায় গান গাইছেন! টুম্পা এর আগে এরকম মানুষ দেখেছে বলে মনে করতে পারে না। আমেরিকা দেশটা কতো মহান সেটা নিয়ে সবাই অনেক বড় বড় কথা বলে কিন্তু এরকমভাবে সে কখনো কাউকে কথা বলতে দেখে নি! টুম্পা অবাক হয়ে আবিষ্কার করল এর আগে সে যাদের আমেরিকা নিয়ে কথা বলতে শুনেছে তারা সবাই বলেছে অহংকার নিয়ে। কিন্তু মিসেস হেনরিকসন বলছেন কৃতজ্ঞতা নিয়ে। তিনি যেন কতো কৃতজ্ঞ যে পৃথিবীর সব দেশের মানুষ দয়া করে এই দেশে এসেছে! পুরো বিষয়টা যে এভাবে দেখা যায় টুম্পা আগে কখনো চিন্তা করে নি।
মিসেস হেনরিকসন হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ও মা! দেখো কত সময় বকবক করে কাটিয়ে দিলাম। মানুষ বয়স হলে এমনিতেই বেশি কথা বলে, আর তার উপরে আমি টিচার, আমি একবার মুখ খুললে আর মুখ বন্ধ করতে পারি না। অন্য কথা থাকুক, এবার তাহলে পড়ালেখার কথা বলি।