আসলে কী?
আসলে আমার আব্বু বেঁচে আছেন কী না সেইটাও জানি না।
শিল্পী মানুষটা গম্ভীর মুখ করে বললেন, বেঁচে আছে নিশ্চয়ই। বেঁচে না থাকলে আমরা খবর পেতাম।
আমার আব্বুকে কোথায় খুঁজে পাব আপনি জানেন?
না। আমি তো জানিনা—
আপনি কী কাউকে চিনেন যে জানে?
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর বলল, বুলবুল আমাদের থেকে দুই বছর জুনিয়র ছিল। শামীমের সাথে তার খাতির ছিল। আর জাহেদ। তাদের সাথে যোগাযোগ করলে হয়তো বলতে পারবে।
তাদের কোথায় পাব?
শামীম তো এখানেই আছে। এক্সিবিশনে শামীমের ছবিও আছে। আস আমার সাথে, দেখি খুঁজে পাই কী না।
বাইরে এক জায়গায় চা কফির আয়োজন করা হয়েছে, সেখানে কয়েকজন সিগারেট খেতে খেতে গল্প করছিল। ভদ্রলোক টুম্পাকে নিয়ে সেখানে হাজির হলেন, ছোটখাটো একজন মানুষকে ডেকে বলল, শামীম, এই যে এই মেয়েটি বুলবুলের মেয়ে!
কোন বুলবুল?
মনে নেই? বুলবুল রায়হান।
তাই নাকি? ছোটখাটো মানুষটা এগিয়ে আসে, তুমি বুলবুলের মেয়ে?
হ্যাঁ।
আমি তো জানতাম ওর ওয়াইফ মেয়েটাকে নিয়ে আমেরিকা চলে গেছে।
জি। আমি আমেরিকা থেকে এসেছি।
ও! মানুষটা টুম্পার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল, কী নাম তোমার?
টুম্পা। টুম্পা রায়হান।
হ্যাঁ। তাইতো। বুলবুলের মেয়ের নাম ছিল টুম্পা! তুমি এতো বড় হয়েছ?
টুম্পার নিঃশ্বাস আটকে যায়, আমার আব্বু কোথায় আছে আপনি জানেন?
মোহাম্মদপুরের দিকে থাকতো। বছর দুয়েক আগের কথা। এখন যে কোথায় আছে–
কেউ কী বলতে পারবে? আপনি জানেন?
ছোট মানুষটা সিগারেট টানতে টানতে কী যেন ভাবল, ভেবে বলল, তোমার টেলিফোন নাম্বারটা দাও আমি একটু খোঁজ নিয়ে দেখি। আসলে সমস্যাটা কী জান?
কী?
বুলবুল তো নরমাল না, কারো সাথে দেখা করে না কথা বলে না।
তা হোক– টুম্পা বলল, আমি শুধু দেখতে চাই।
সে তো বটেই। তোমার বাবা, তুমি তো দেখতেই চাইবে। অসাধারণ শিল্পী ছিল বুলবুল। অসম্ভব ক্রিয়েটিভ–আমি বুঝি না বেশি ক্রিয়েটিভ মানুষেরই এই সমস্যা হয় নাকি এই সমস্যা হলেই বেশি ক্রিয়েটিভ হয়।
টুম্পা একটা কাগজ বের করে সেখানে তার নাম লিখলো তারপর ছোট খালার টেলিফোন নম্বর লিখলো লিখে শামীম নামের ছোটখাটো মানুষটার হাতে দিয়ে বলল, আপনার টেলিফোন নম্বরটা দিবেন?
হ্যাঁ দিচ্ছি। দাঁড়াও তোমাকে আমার একটা কার্ড দিই।
কার্ডটা হাতে নিয়ে টুম্পা বলল, আপনি কখন আমাকে খোঁজ দিতে পারবেন বলে মনে হয়? আসলে আমি তো মাত্র অল্প কয়দিনের জন্যে এসেছি।
হ্যাঁ, দেখি। দুই–এক দিন সময় দাও।
আমি ভেবেছিলাম আব্বুর ছবি দিয়ে পেপারে একটা বিজ্ঞাপন দেব। তাহলে আমি আপনার জন্যে দুইদিন অপেক্ষা করি?
হ্যাঁ। দুইদিন অপেক্ষা কর—
টুম্পা বিদায় নিয়ে চলে যাবার জন্যে মাত্র ঘুরেছে ঠিক তখন সুমি আর রুমি উদ্বিগ্ন মুখে ছুটে এল। সুমি বলল, আপু তুমি এখানে? আমরা তোমাকে সব জায়গায় খুঁজেছি।
না আমি একটু কথা বলছিলাম।
রুমি হাসি হাসি মুখ করে বলল, আপু! তুমি কোনো পেইন্টিং কিনবে নাকি?
টুম্পা হাসল, বলল, পেইন্টিং তো না, খালি ক্যানভাস কেনার টাকা আছে আমার!
সুমি হি হি করে হেসে বলল, খারাপ না আইডিয়াটা একটা ক্যানভাস কিনে নিচে লিখে রাখবে–এইখানে বিখ্যাত একটা পেইন্টিং আঁকা হবে!
সুমির উত্তরে রুমি জানি কী একটা বলল, তার উত্তরে আবার সুমি। টুম্পা তাদের কথা কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না, তার বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। সত্যিই কী সে তার আব্বুকে খুঁজে পাবে? তার আব্বু সত্যিই আছেন? কেমন আছেন? তার সাথে কথা বলবেন? প্রথম যখন দেখা হবে কী বলবে সে তার আধুকে?
খাবার টেবিলে ছোট খালু টুম্পাকে জিজ্ঞেস করলেন, টুম্পা, তোমার অবস্থা কী রকম?
কেন ছোট খালু?
তোমাকে নিয়ে ঢাকা শহর থেকে বের হই। কক্সবাজার রাঙ্গামাটি ঘুরে আসি।
রুমি মনে করিয়ে দিল, আর সুন্দরবন।
উহুঁ। সুন্দরবন মনে হয় এখন হবে না। সুন্দরবন যেতে হয় শীতকালে। এখন সমুদ্র খুব আনপ্রেডিক্টেবল।
সেটাই তো ভালো। ঝড়ের মাঝে সমুদ্র একেবারে ফাটাফাটি।
সুমি বলল, হয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই ভয়ে বাথরুমে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়, আর সে ঝড়ের মাঝে যাবে সমুদ্রে!
কোনোদিন আমি বাথরুমে গেছি?
হয়েছে! ছোট খালু দুইজনকে থামালেন, আগে দিনগুলি ঠিক করি। টুম্পা আছে মাত্র চার সপ্তাহ, দেখবি দেখতে দেখতে সময়টা কেটে যাবে।
পরশুদিন বৃহস্পতিবার, আমরা রাত্রে রওনা দিতে পারি। টুম্পা একটু ইতস্তত করে বলল, ছোট খালু–
কী হলো? আমরা আর কয়েকটা দিন পরে যাই? পরে? হ্যাঁ।
ছোট খালু কয়েক মুহূর্ত টুম্পার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ঠিক আছে! এখন তাহলে আমরা ঢাকা শহর আর তার আশেপাশে যাই।
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।
.
গভীর রাতে ছোট খালার ঘুম ভেঙে গেল। বাইরের ঘরে আলো জ্বলছে। ছোট খালা আস্তে আস্তে বাইরে এলেন, টুম্পা সোফায় পা তুলে বসে আছে, তার কোলে এ্যালবামটা, তার আব্বুর ছবিটা বের করে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ছোট খালা নরম গলায় ডাকলেন, টুম্পা।
টুম্পা মুখ তুলে তাকালো, ছোট খালা!
ঘুম আসছে না?
টুম্পা হাসার চেষ্টা করে বলল, ঘুম এসেছিল, ভেঙে গেছে। জেট লেগ, আমেরিকাতে এখন দুপুর।
ও! ছোট খালা পাশে এসে বসলেন, খিদে পেয়েছে? কিছু খাবি?