জিওমেট্রির টিচার আনতে গিয়ে ভুল করে জিওগ্রাফির টিচার নিয়ে চলে এসেছে। কথাটা শেষ করে মিসেস হেনরিকসন হি হি করে হাসতে শুরু করলেন। কথাটা এমন কিছু হাসির কথা নয় কিন্তু মিসেস হেনরিকসনের এরকম বাচ্চাদের মতো হাসি দেখে সবাই তার সাথে হাসতে শুরু করে দিল।
মিসেস হেনরিকসন শেষ পর্যন্ত হাসি থামালেন, চোখ মুছে বললেন, এখন বল তো কী করি? আমি তো তোমাদের জ্যামিতি পড়াতে পারব না। যদি চেষ্টা করি তাহলে ইউক্লিড তার কবরে ওলট–পালট খেতে থাকবে।
জেসিকা বলল, আমাদের একটা গান গেয়ে শোনাও।
জেসিকা ফাজিল ধরনের মেয়ে, কথা বলার ঢংটিও ছিল একটু গায়ে জ্বালা ধরানোর মতো কিন্তু মিসেস হেনরিকসন সেটা লক্ষ করলেন বলে মনে হলো না, জেসিকার কথা শেষ হবার সাথে সাথে দুই হাতে চুটকি দিতে দিতে সুরেলা গলায় গেয়ে উঠলেন,
আই এ্যাম লাইক এ বার্ড
আই অ্যাম গোয়িং টু ফ্লাই এ্যাওয়ে আই ডোন্ট নো হোয়র মাই সোল ইজ সোল ইজ আই ডোন্ট নো হোয়র মাই হোম ইজ…।
মিসেস হেনরিকসনের মতো মধ্যবয়সী একজন মহিলা এতো সুন্দর করে গানটি গেয়ে উঠলেন যে সবাই কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। জেসিকা মুগ্ধ হয়ে বলল, মিসেস হেনরিকসন! তুমি কী সুন্দর গান গাইতে পার!
মিসেস হেনরিকসন বললেন, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন ভেবেছিলাম বড় হয়ে গায়িকা হব। আর দেখো বড় হয়ে আমি হয়েছি ভূগোলের টিচার। মিসেস হেনরিকসন আবার ছোট বাচ্চাদের মতো হি হি করে হেসে উঠলেন যেন গায়িকা হতে চেয়ে ভূগোলের টিচার হয়ে যাওয়া খুব মজার ব্যাপার।
কেভিন জিজ্ঞেস করল, তোমার ভূগোল ভালো লাগে না?
লাগবে না কেন? খুব ভালো লাগে। ভূগোল মানে তো শুধু জায়গার কথা। সেই জায়গার মানুষেরও কথা–
মিসেস হেনরিকসন ক্লাশের সবার মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, তোমাদের ক্লাশের দিকে তাকিয়ে দেখো, পৃথিবীর কতো দেশের কতো মানুষ! জিমের গায়ের রং কুচকুচে কালো, তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার পূর্বপুরুষ এসেছিল আফ্রিকা থেকে, জেনীর চোখ ছোট ছোট নাক একটু চাপা, তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার পূর্বপুরুষ এসেছে এশিয়া থেকে। সম্ভবত পূর্ব এশিয়া। কেভিনের খাড়া নাক, নীল চোখ, সোনালি চুল, তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার পূর্বপুরুষ নিশ্চয়ই এসেছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ থেকে! মরিয়মের বড় চোখ, কালো চুল, তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার পূর্বপুরুষ নিশ্চয়ই মধ্যপ্রাচ্যের, তাই না?
মরিয়ম মাথা নাড়লো এবং মিসেস হেনরিকসন এমন ভাব করলেন যেন তিনি যুদ্ধ জয় করে ফেলেছেন। তিনি ক্লাশের ছাত্র–ছাত্রীদের মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে টুম্পার দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, আর তুমি নিশ্চয়ই এসেছ ইন্ডিয়া থেকে।
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, না মিসেস হেনরিকসন। আমি এসেছি বাংলাদেশ থেকে।
বলতে গিয়ে টুম্পার গলা একটু কেঁপে গেল কারণ এই দেশের বেশিরভাগ মানুষ বাংলাদেশকে চেনে না। যারা চেনে তারা শুধু বাংলাদেশের খারাপ খারাপ জিনিসগুলোর কথা জানে। দেশটার নমিও ভালো করে বলতে পারে না, বলে, বাংলাডেশ। টুম্পা একটু শংকিত চোখে মিসেস হেনরিকসনের দিকে তাকিয়ে রইল, এখন কী এরকম কিছু ঘটবে? কিন্তু সেরকম কিছু ঘটল না বরং মিসেস হেনরিকসনের চোখ কেমন জানি উজ্জ্বল হয়ে উঠল, মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, বাহ্! কী চমৎকার। আমাদের দেশে বাংলাদেশের একজন মেয়ে আছে।
টুম্পা অবাক হয়ে দেখল মিসেস হেনরিকসন ব্যাংলাডেশ বলেন নাই, একেবারে শুদ্ধ করে বলেছেন বাংলাদেশ। খানিকক্ষণ কী যেন ভাবলেন তারপর বললেন, যতদূর মনে পড়ে সত্তুরের দিকে জর্জ হ্যারিসন, জোন বায়াজ, রবি শংকর সবাই মিলে একটা কনসার্ট করেছিল বাংলাদেশের জন্যে। মিসেস হেনরিকসন টুম্পার দিকে তাকিয়ে বললেন, তাই না?
কিসের কনসার্ট সেটা সম্পর্কে টুম্পা কিছুই জানে না, সে কী বলবে বুঝতে না পেরে অনিশ্চিত ভঙ্গীতে মাথা নাড়ল, যার উত্তর হ্যাঁ, বা না দুটোই হতে পারে। মিসেস হেনরিকসন সেটা খেয়াল করলেন বলে মনে হলো না চোখ বড় বড় করে বললেন, নিইউয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে সেই কনসার্ট হয়েছিল, আমি তখন টিনএজার। সেই কনসার্টে গিয়ে সবার গান শুনে একেবারে সারা জীবনের জন্যে পাল্টে গিয়েছি। তখন বাংলাদেশে যুদ্ধ হচ্ছে। কমবয়সী গেরিলারা যুদ্ধ করছে, দশ মিলিয়ন মানুষ উদ্বাস্তু কী কষ্ট মানুষের। এলেন গিনসবার্গ সেটার উপর একটা কবিতা লিখেছেন, জেসোর রোড, অসাধারণ কবিতা!
টুম্পা কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে মিসেস হেনরিকসনের দিকে তাকিয়ে রইল। এলেন গিনসবার্গটা কে? জেসোর রোড কবিতাটি কী? সে তো এগুলো কিছু জানে না।
মিসেস হেনরিকসন একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বাংলাদেশের মানুষের সংখ্যা একশ চল্লিশ মিলিয়ন–পৃথিবীর মোট মানুষের শতকরা দুই ভাগ। যার অর্থ পৃথিবীর যে কোনো পঞ্চাশজন মানুষকে নিলে তার মাঝে একজন হবে বাংলাদেশের। এতোগুলো মানুষ থাকে কতোটুকু জায়গার মাঝে তোমরা জান?
টুম্পা অস্বস্তি অনুভব করে, তার জানা উচিৎ ছিল, কিন্তু সে জানে না। অনেক ছোট থাকতে সে তার আম্মুর সাথে আমেরিকা চলে এসেছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। মিসেস হেনরিকসন সেটা নিয়ে মাথা ঘামালেন না, বললেন, বাংলাদেশের সাইজ আমাদের উইসকনসিনের মতো!