না, ছোট খালা না–বলার সময়েই টুম্পা আবিষ্কার করলো তার গলায় সেরকম জোর নেই!
ছোট খালা ফ্রিজ খুলে খাবার বের করে রান্নাঘরে নিয়ে চুলো জ্বালিয়ে খাবার গরম করতে লাগলেন। টুম্পা ভদ্রতা করে আরও এক–দুইবার আপত্তি করে শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে ছোট খালাকে সাহায্য করতে লাগলো।
ছোট খালা খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে কাছাকাছি বসলেন। টুম্পার প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন, নে, খা। তোর মতো বয়স থাকলে আমি রাক্ষসের মতো খেতাম!
টুম্পা বলল, আমি রাক্ষসের মতোই খাচ্ছি। তুমি এখন গিয়ে ঘুমাও।
আমার ঘুম নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না।
আমার খুব লজ্জা লাগছে ছোট খালা—
তুই দেখি তোর বাপের মতো শুরু করলি—
টুম্পা মুখ তুলে ছোট খালার দিকে তাকালো, বলল, আব্বুর মতোন? কী করতে আব্বু?
ছোট খালা একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পাগল হয়ে যাবার আগে তোর আব্বু ছিল একেবারে খাঁটি ভদ্রলোক। তোর মায়ের সাথে বিয়ে হবার পর প্রথমবার যখন শ্বশুরবাড়ি এসেছে আমরা নতুন জামাইকে কতো যন্ত্রণা করেছি মানুষটা মুখ বুজে সহ্য করেছে–
ছোট খালা।
কী?
আব্বুর কোনো ছবি আছে?
থাকার তো কথা। দাঁড়া খুঁজে বের করি– ছোট খালা শেলফ থেকে কয়েকটা এ্যালবাম নামিয়ে নিয়ে এসে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ করে একটা ছবি বের করলেন। বললেন, এই যে তোর আব্বু।
টুম্পার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, অসম্ভব সুন্দর একজন মানুষ তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। বড় বড় এলোমেলো কালো চুল, ঝকঝকে দুটি চোখ। তার নিজের আব্বু? টুম্পার চোখে হঠাৎ পানি এসে যায়।
ছোট খালা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোর বাবা তোকে অসম্ভব আদর করতো। যখন পাগল হয়ে গেল তখন মাঝখানে একটা সময় তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হতো। অসম্ভব ভায়োলেন্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তোকে দেখলেই একেবারে শান্ত হয়ে যেতো। তুই তখন ছোট সবাই ভয়। পেতো যদি হঠাৎ করে কিছু একটা করে ফেলে–
আব্বু পাগল হলো কেমন করে?
ছোট খালা মাথা নাড়লেন, বললেন, জানি না। আগে থেকেই মনে হয় একটু সমস্যা ছিল। মাঝে মাঝে গুম হয়ে যেতো কারো সাথে অনেকদিন কথা বলতো না। আমরা ভাবতাম শিল্পী মানুষের মুড! আস্তে আস্তে সমস্যাটা বাড়তে লাগলো রাতে ঘুমাতো না, সারারাত ছাদে হাঁটতো–
চিকিৎসার ব্যবস্থা করে নাই?
করে নাই আবার! অনেক চেষ্টা করেছ। কিছুতেই ডাক্তারের কাছে যাবে না, অনেক ধরে বেঁধে নেয়া হলো, ডাক্তার কঠিন একটা নাম বললো, সিজোফ্রেনিয়া না কী যেন–
টুম্পা বলল, স্কিৎজোফ্রেনিয়া?
হ্যাঁ তাই হবে। ওষুধ পত্র দিলো, সেগুলো খেতে চায় না। খুব বড় একটা এক্সিবিশান হবে, তার জন্যে ছবি আঁকার কথা, রাত জেগে ছবি আঁকে। সেই ছবিগুলো দেখে ভয় লাগে। মজার ব্যাপার জানিস, অনেক দাম দিয়ে সেই ছবি বিক্রি হয়ে গেল, অসাধারণ সব ছবি ছিল।
কোথায় আছে ছবিগুলো?
জানি না। বিদেশিরা কিনে নিয়ে গেছে। পত্রিকায় অনেক ভালো ভালো রিভিউ বের হয়েছিল।
আছে রিভিউগুলো?
থাকলেও খুঁজে পাব না। এই বাসায় কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না।
টুম্পা বলল, আব্বু আর কী কী করতো ছোট খালা?
ছবি আঁকার ব্যাপারে খুব নাম করেছিল। দেশে বিদেশে এক্সিবিশান হয়েছে। মানুষটা পাগল না হয়ে গেলে এখন অনেক নাম ডাক হতো।
আম্মুর সাথে ছাড়াছাড়ি হলো কখন?
ছোট খালা একটা নিঃশ্বাস ফেললেন, বললেন, তোর মায়ের সাথে অনেকদিন থেকে সমস্যা হচ্ছিল, আমাদেরকে কিছু জানায় নি। একদিন অনেক রাতে তোর মা এসে হাজির, শরীরে মারের দাগ, ছেঁড়া জামা কাপড়। এসে হাউমাউ করে কান্না আমরা তো অবাক। প্রথমে কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে তোর আব্বু বাসার সব কিছু ভেঙেচুরে শেষ করে রেখেছে। সব বই ছিঁড়ে কুটি কুটি করে রেখেছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ লাল, এতো বড় একটা চাকু নিয়ে বসে আছে–
টুম্পা বুকের ভেতর থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সর্বনাশ!
হ্যাঁ। আমাদের মনে হলো মানুষটা মরে গেলে বুঝি আমরা কম দুঃখ পেতাম। যাই হোক ধরে বেঁধে চিকিৎসার জন্যে নিয়ে যাওয়া হলো, লাভ হলো না। শুধু চিৎকার করে টুম্পা টুম্পা–তোকে দেখার জন্যে পাগল। কিন্তু এতো ভায়োলেন্ট তাই তোকে কাছে নিতে কেউ সাহস করল না। এর মাঝে তোর মায়ের ডিভি হয়ে গেল। আমরা কেউ জানতাম না, লুকিয়ে এপ্লাই করে রেখেছিল। আমরা সবাই না করলাম, আমাদের কারো কথা শুনল না, একরকম জোর করে তোকে নিয়ে আমেরিকা চলে গেল।
আর আব্বু?
এক ক্লিনিক থেকে আরেক ক্লিনিকে। প্রথম কিছুদিন আমরা জানতাম তারপর আস্তে আস্তে আর খবর পেতাম না। মানুষটার আত্মীয় স্বজনেরা কেউ ছিল না, বন্ধু বান্ধবেরা একটু চেষ্টা করেছিল।
তোমার কী মনে হয় ছোট খালা? আব্বু কী বেঁচে আছে?
কেমন করে বলি! বেঁচে থাকলেই কেমন আছে, কে বলবে? আমাদের দেশে এরকম মানুষজনের বেঁচে থাকা খুব কঠিন।
ছোট খালা।
কী মা?
আমি কী আমার আব্বুকে খুঁজে বের করতে পারব?
হ্যাঁ।
ছোট খালা কিছুক্ষণ টুম্পার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, কেমন করে বলি? এই দেশে ছোট কাজটাই এতো কঠিন, আর কঠিন কাজটা তো অসম্ভব। তাছাড়া–
তা ছাড়া কী?
ধরা যাক তুই তোর বাবাকে খুঁজে পেলি। তারপর?
তারপর কী?
তোর যদি আরও অনেক বেশি মন খারাপ হয়ে যায়?