টুম্পা থতমত খেয়ে বলল, দুই টাকা দিয়ে ভাত পাওয়া যায়?
মেয়েটা তখন ফিক করে হেসে ফেলল, এবং টুম্পা বুঝতে পারলো আসলে ভাত খাওয়ার কথাটি বলেছে সমবেদনা পাওয়ার জন্যে। দুই টাকা দিয়ে ভাত হয় না, মেয়েটা তখন বলল, তাহলে লজেন্স খামু।
এটা তবু মোটামুটি একটা যুক্তির কথা। এতো ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে এই বয়সে ভিক্ষে করছে, টুম্পার কেমন জানি অস্বস্তি হয়। সে নরম গলায় বলল, আমার কাছে তো দুই টাকা নেই। তোমার একটা ছবি তুলে দেই?
মেয়েটার করুণ মুখ মুহূর্তে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বড় বড় চোখ করে বলে, দেন।
টুম্পা তার ডিজিটাল ক্যামেরাটা বের করল, বাংলাদেশে এসে এটি হবে তার প্রথম ছবি। মেয়েটি দুই হাত পাশে নিয়ে প্রায় এটেনশান হয়ে থাকার ভঙ্গীতে দাঁড়ালো, টুম্পা বলল, একটু হাসো।
মেয়েটি সাথে সাথে ফিক করে হেসে দেয়। টুম্পা শাটার টিপতেই মেয়েটির হাসি মুখ ছবিতে আটকা পড়ে যায়–চমৎকার একটা ছবি হয়েছে, দেখে টুম্পার মনটা ভালো হয়ে গেল। টুম্পা মেয়েটাকে ডাকলো, এই দেখো তোমার ছবি।
ছবিটা দেখে মেয়েটা চমৎকৃত হয়ে যায়, আমার ছবি। এইখানে দেখা যায়। ছোড়ু টেলিভিশন?
না। এটা টেলিভিশন না, এটা ক্যামেরা।
কী সুন্দর!
হ্যাঁ। অনেক সুন্দর। তোমার নাম কী?
ময়না। ময়না, তোমার ঠোঁট দুটি এরকম লাল করেছ কেমন করে?
ময়না দাঁত বের করে হেসে কোমরে গুঁজে রাখা এক টুকরো পাতলা লাল কাগজ বের করে দেখালো। এটা চিবিয়ে ঠোঁটে ঘষলেই ঠোঁট লাল হয়ে যায়!
ময়নার সাথে কথা বলার সময় কীভাবে কীভাবে জানি তার বয়সী অনেকগুলো বাচ্চা ধীরে ধীরে টুম্পাকে ঘিরে দাঁড়ালো। সবাই মুখটা করুণ করে হাত পেতে বলতে লাগলো, দুইটা টাকা দেবেন? ভাত খামু।
ময়না উত্তেজিত গলায় বলে, এই আফা ফটো তুলে। আমার ফটো তুলছে।
সাথে সাথে সবাই হাত নামিয়ে বলতে লাগলো, আমার ফটো। আমার ফটো।
টুম্পা তখন একজন একজন করে সবার ফটো তুলতে লাগলো। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে হবে এবং না হাসা পর্যন্ত সে ফটো তুলবে না জানার পরেও একজন কিছুতেই হাসতে রাজি হচ্ছিল না, শেষ পর্যন্ত তাকে হাসতে বাধ্য করার পর রহস্যটা বোঝা গেল, তার সামনের দুটো দাঁত নেই।
সুমি দোকান থেকে বের হয়ে দেখে টুম্পা ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং তাকে ঘিরে একটা ছোটখাটো ভীড়! সুমি প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও একটু পরেই বুঝে গেল এখানে বড় কোনো সমস্যা নেই, টুম্পা হতদরিদ্র বাচ্চাগুলোর ছবি তুলছে। ছবি তুলে তাদের দেখাচ্ছে।
টুম্পা আর সুমি যখন বাসায় ফিরে যেতে থাকে তখন দীর্ঘসময় টুম্পা চুপ করে রইল। সুমি বলল, টুম্পা আপু তুমি কী ভাবছ?
না কিছু না। টুম্পা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, না আমি আসলে কিছু ভাবছি না।
.
ভোর রাতে টুম্পার ঘুম ভেঙে গেল, আর কিছুতেই চোখে ঘুম এল না। এটাকে নিশ্চয়ই জেট লেগ বলে, বাংলাদেশে এখন ভোর রাত তিনটা হতে পারে কিন্তু আমেরিকার সময় অনুযায়ী এখন দুপুর দুইটা। একজন মানুষ দুপুর দুইটার সময় কেমন করে ঘুমায়? টুম্পা খানিকক্ষণ বিছানায় ওলট–পালট করে উঠে পড়লো। মশারির ভেতর বসে থেকে সে চারিদিক দেখছে, কী অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সবকিছু। বাংলাদেশে মশারির ভেতর ঘুমাতে হয় সেটা আগেই জানতো, তার ধারণা ছিল মশারির ভেতর শুতে গিয়ে তার দম বন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু মোটেও তা হলো না। বরং তার মনে হতে লাগলো ছোট একটা পুতুলের ঘরের মাঝে শুয়ে আছে!
টুম্পা মশারি তুলে সাবধানে বের হয়ে এল। বাসার সবাই ঘুমাচ্ছে, তাই সে কোনো শব্দ না করে পা টিপে টিপে ডাইনিং টেবিলে রাখা পানির বোতল থেকে ঢেলে এক গ্লাস পানি খেলো তারপর পা টিপে টিপে বাইরের ঘরে এল। সুইচটা খুঁজে বের করতে একটু সময় নিলো, সুইচ টিপতেই ঘরে আলো জ্বলে ওঠে ঠিক তখন কিলবিল করে কী একটা যেন দেওয়ালের ওপর দিয়ে দৌড়ে গেল, আতংকে টুম্পা প্রায় চিৎকার করে উঠছিল, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করলো। আজ সন্ধ্যেবেলা সে এই প্রাণীটাকে দেখেছে, এটা এক ধরনের সরীসৃপ, সবাই এটাকে ডাকে টিকটিকি। বাসার ভেতরে এই ছোট ছোট সরীসৃপগুলো ঘুরে বেড়ায় কেউ কিছু মনে করে না! টুম্পা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে টিকটিকিটার দিকে তাকিয়ে রইলো।
বুকের ধুকপুকুনিটা একটু কমার পর সে সোফার মাঝে বসে, টেবিলে কয়েকটা খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন। টুম্পা তার একটা নিয়ে বসে বসে ছবিগুলো দেখতে থাকে। বাংলাদেশের মেয়েরা অসম্ভব সুন্দরী, কী সুন্দর কুচকুচে কালো চুল আর চোখগুলো কী সুন্দর।
খুট করে ঘরের ভেতর একটা শব্দ হলো, টুম্পা তাকিয়ে দেখে ছোট খালা দরজার সামনে ঘুম ঘুম চোখে দাঁড়িয়ে আছেন। অবাক হয়ে বললেন, টুম্পা! এতো রাতে বসে বসে কী করছিস?
জেট লেগ? টুম্পা হাসার চেষ্টা করে বললো, আর ঘুম আসছে না, তাই বসে বসে ম্যাগাজিন দেখছি!
ছোট খালা এগিয়ে এসে বললেন, কিছু খাবি?
টুম্পা আবিষ্কার করলো শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু সত্যি তার বেশ খিদে লেগেছে। সে অবশ্যি স্বীকার করলো না, জোরে জোরে মাথা নাড়লো, বলল, না ছোট খালা কিছু খাব না।
মুখটা ছোট হয়ে আছে। নিশ্চয়ই তোর খিদে পেয়েছে। কী খাবি?
না ছোট খালা, না।
আমার সাথে ভদ্রতা করবি না। পরটা ভেজে দিই? গরুর গোশত আছে, গরম করে দিই?