এক দুই বছরের একটা হাসি খুশি বাচ্চার ছবি। বাচ্চাটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির এক ধরনের হাসি, ঠিক কী কারণ জানা নেই কিন্তু ছবিটাকে তার খুব পরিচিত মনে হয়। আগে যেন কোথায় দেখেছে। কলম আর তুলি দিয়ে আঁকা, ছবিটা যে এঁকেছে সে নিশ্চয়ই অসাধারণ একজন শিল্পী, ঠিক যে কয়টা কলমের আঁচড় আর যে কয়টা তুলির স্পর্শ দেয়া দরকার, ঠিক সেই কয়টা দিয়েছে, তার থেকে একটি বেশিও নেই একটি কমও নেই। ছবিটাতে অপ্রয়োজনীয় একটা দাগ নেই, একজন মানুষ কেমন করে এতো পরিচ্ছন্ন ছবি আঁকতে পারে? সবচেয়ে বড় কথা এতো অল্প আঁচড়ে যে ছবিটা এঁকেছে সেটা একটা অসাধারণ ছবি, শিশুটির চোখে এক ধরনের বিস্ময় যেটা শুধুমাত্র এই বয়সের শিশুর চোখে দেখা যায়, ঠোঁটের কোণার হাসিটুকু মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়বে! কী সাধারণ একটা ছবি কিন্তু কী অসাধারণ টুম্পা মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
ঠিক তখন সাবধানে দরজা খুলে ছোট খালা ঘরে উঁকি দিলেন, টুম্পাকে দেখে খুশি খুশি গলায় বললেন, ও! তুই উঠে গেছিস?
হ্যাঁ। ছোট খালা উঠেছি। যেভাবে ঘুমাচ্ছিলি আমার মনে হচ্ছিল আজ বুঝি আর উঠবি না।
হা ছোট খালা। একেবারে মড়ার মতো ঘুমিয়েছি। এটাকেই নিশ্চয়ই বলে জেট লেগের ঘুম।
হাত মুখ ধুয়ে আয়, কিছু একটা খাবি—
টুম্পা বলল, ছোট খালা।
কী?
এই ছবিটা কে এঁকেছে?
ছোটখালা ছবিটার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বললেন, ও মা! বুঝতে পারিস নি?
না তো–
এটা তোর ছবি। তোর বাবার আঁকা—
আমার বাবা? টুম্পা চমকে উঠলেন, আ-আমার-বাবা?
হ্যাঁ। তোর বাবা যদি পাগল হয়ে না যেতো তাহলে অনেক বড় আর্টিস্ট হতো।
আমার বাবা ছবি আঁকতো?
ও মা! তুই জানিস না বুঝি?
না।
তোর বাবা তো আর্টিস্ট ছিল, খুব সুন্দর ছবি আঁকতো। তুই যে এতো সুন্দর ছবি আঁকিস সেটা কী এমনি এমনি?
টুম্পা এখন ছবিটার আরেকটু কাছে এগিয়ে যায়, ছবির এক কোণে টানা হাতে সিগনেচার, বুলবুল রায়হান। তার বাবার নাম বুলবুল রায়হান, টুম্পা রায়হানের বাবা বুলবুল রায়হান। টুম্পা তার বাবার নামটুকু ছাড়া আর কিছু জানেনা। এখন বাবার হাতে আঁকা একটা ছবি দেখছে, তার নিজের ছবি। তার বাবা নিশ্চয়ই গভীর ভালোবাসায় এই ছবিটি এঁকেছিলেন, হঠাৎ করে টুম্পার চোখে পানি এসে যায়।
তোর মা তোক কোনোদিন কিছু বলে নাই?
টুম্পা আবার মাথা নাড়লো। ছোট খালার মুখটা কেমন জানি গম্ভীর হয়ে যায়, মানুষটা অসম্ভব হাসিখুশি মানুষ গম্ভীর হতে জানেই না, কষ্ট করে গম্ভীর হলে তাকে অপরিচিত মানুষের মতো দেখাতে থাকে। ছোট খালা অপরিচিত মানুষের মতো মুখ করে বললেন, তোর বাবার কারণে তোর মা অনেক কষ্ট পেয়েছে তো–
টুম্পা খপ করে ছোট খালার হাত ধরে বলল, আমাকে বলবে ছোট খালা?
ছোট খালা টুম্পাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, বলব না কেন। নিশ্চয়ই বলব।
তাহলে বল।
এখনই শুনতে হবে কেন। কোনো একদিন সময় করে বলব।
টুম্পার গলাটা ভেঙে আসে, কোনোমতে বলল, ছোটখালা।
কী মা?
শুধু একটা জিনিস বল।
কী জিনিস?
আমার আব্বু কী এখনো বেঁচে আছেন?
ছোট খালা টুম্পাকে শক্ত করে ধরে বললেন, কে বলবে মা? তোর মা এখানে থাকতেই একবার সুইসাইড করার চেষ্টা করল। এখন কী করেছে কে জানে? বেঁচে থাকলেও কোথায় আছে কেমন আছে কে বলবে? তোর আব্বু কপালে শুধু দুঃখ নিয়ে এসেছিল। তোর মতো এতো মায়াভরা একটা মেয়ে সে দেখতে পেলো না–ছোট খালা টুম্পাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
কান্নার শব্দ শুনেই হোক বা এমনিতেই তোক ঠিক তখন সুমি ঘরে এসে ঢুকলো, এক নজর তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আম্মু! ভালো হচ্ছে না আম্মু! তুমি এইভাবে টুম্পা আপুকে টর্চার করতে পারবে না।
ছোট খালা টুম্পাকে ছেড়ে দিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন। বললেন, ঠিক আছে যা। টর্চার করব না।
.
বিকেলবেলা সুমি টুম্পাকে নিয়ে বের হয়েছে। ছোট খাটো কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে সেগুলো কিনে টুম্পাকে নিয়ে দোকানপাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এলাকাটা বড়লোকদের, দোকানগুলো ঝকঝকে তকতকে, ভেতরে সাজানো গোছানো, কিন্তু দোকান থেকে বের হলেই দেখা যায় গরিব মানুষ। টুম্পা এই গরিব মানুষগুলো থেকে চোখ সরাতে পারে না, তার মনে হতে থাকে সে বুঝি ন্যাশনাল জিওগ্রাফির একটা চ্যানেলের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। চারপাশে এতো মানুষ, মানুষগুলোর মাঝে এক ধরনের বিবর্ণ ভাব। পথে ঘাটে ভিক্ষুক। বিকলাঙ্গ মানুষ শুয়ে শুয়ে গান করে ভিক্ষা করছে। কী আশ্চর্য লাগে দেখলে।
টুম্পাকে নিয়ে সুমি একটা হ্যাঁন্ডিক্র্যাফটের দোকানে ঢুকেছে কী একটা কিনে দাম দেয়ার জন্যে কাউন্টারে অপেক্ষা করছে, তখন টুম্পা বাইরে বের হয়ে ফুটপাথে অপেক্ষা করতে লাগলো।
সামনে রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে গাড়ি বাস টেম্পু যাচ্ছে। টুম্পা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। এতো ছোট একটা রাস্তা দিয়ে এতোগুলো গাড়ি এতো গায়ে গায়ে লেগে কেমন করে যেতে পারে টুম্পার সেটা বিশ্বাস হয় না।
আপা দুইটা টাকা দিবেন। রিনরিনে একধরনের গলার আওয়াজ শুনে টুম্পা চমকে উঠলো–ছোট একটি বাচ্চা মেয়ে মুখটাকে যতোটুকু সম্ভব করুণ করে তার সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়েছে। টুম্পার জীবনে কখনো এরকম একটা কিছু ঘটে নি। সে অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো, মেয়েটার খালি গা, নাকে একটা নাকফুল ঠোঁট দুটো টকটকে লাল, কী দিয়ে ঠোঁটকে লাল করেছে। কে জানে। বড় বড় কালো চোখ মাথা ভরা লালচে চুল। মুখটাকে আরো করুণ করে বলল, দিবেন দুইটা টাকা? ভাত খামু।