টুম্পা স্যুটকেস খুলে পরিষ্কার কাপড় বের করে বাথরুমে গেল গোসল করতে। বাথরুম ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রেখেছে কিন্তু তার পরেও কেমন জানি একধরনের বিবর্ণ ভাব রয়েছে। তাদের বাথরুমে গোসল করার আলাদা জায়গা থাকে, গোসল করার সময় শুধু সেই জায়গাটা ভিজে বাকিটুকু সবসময় শুকনো থাকে। এখানে সেটা নেই গোসল করলেই পুরো বাথরুম ভিজে থই থই করতে থাকে!
টুম্পা অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গোসল করল, এক ধরনের ভ্যাপসা গরম, শাওয়ারের ঠাণ্ডাপানিতে শরীর জুড়িয়ে গেল। কিন্তু বাথরুম থেকে বের হবার পর আবার ভ্যাপসা গরম। কী আশ্চর্য!
টুম্পা তার ঘর থেকে বের হয়ে দেখে ডাইনিং টেবিলের উপর দশ রকম খাবার। টুম্পা চোখ বড় বড় করে বলল, সর্বনাশ! এতো খাবার কে খাবে?
ছোট খালা বললেন, তুই খাবি। বাংলাদেশে এসেছিস বাংলাদেশের খাবার খাবি না?
ছোটখালা আমি কিন্তু আমেরিকাতেও বাংলাদেশের খাবার খাই। আম্মু রান্না করে।
তোর আম্মুর রান্না! তাহলেই হয়েছে। সে আবার রান্না করতে পারে নাকি?
রুমি বলল, টুম্পা আপু, আমাদের আম্মু দুইটা জিনিস খুব ভালো পারে। একটা হচ্ছে রান্না। আরেকটা–
আরেকটা কী?
সেটা সকালে দেখ নাই? কথা বলা—
ছোট খালা হাত তুলে বললেন, চুপ কর বেয়াদপ ছেলে।
যতক্ষণ প্লেনে ছিল সারাক্ষণই কিছু না কিছু খেয়েছে কিন্তু বেশ অবাক ব্যাপার টুম্পার বেশ খিদে পেয়ে গেছে। সে সবার সাথে বসে খুব সখ করে খেলো। পরটা, কাবাব, সবজি, ডাল, মিষ্টি, পায়েশ, আম দই, কী নেই টেবিলে। ছোট খালা সারাক্ষণই প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন–কাজেই যেটুকু খাওয়ার কথা টুম্পা খেলো তার থেকে অনেক বেশি।
খেতে খেতে ছোট খালু বললেন, তোমাকে প্রথমেই খাওয়া সংক্রান্ত তিনটি গ্রাউন্ড–রুল শিখিয়ে দিই তাহলে কখনোই বিপদে পড়বে না। রুল নাম্বার ওয়ান : কখনোই বাইরে কিছু খাবে না
সুমি চোখ বড় বড় করে বলল, তার মানে নো চটপটি?
নো চটপটি। নো ঝালমুড়ি।
সুমি যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল যেটা শুনে মনে হতে পারে রাস্তায় চটপটি আর ঝালমুড়ি খাওয়া বাংলাদেশ ভ্রমণের সবচেয়ে বড় অংশ!
ছোটখালু বললেন, রুল নাম্বার টু : রান্না করা জিনিস ছাড়া আর কিছু খাবে। তার মানে নো কাঁচা শাকসবজি। নো সালাদ।
সুমি এবার আনন্দের মতো একটা শব্দ করল। ছোটখালু না শোনার ভান করে বললেন, রুল নাম্বার থ্রি : সিদ্ধ করা পানি ছাড়া আর কোনো পানি খাবে না। এই তিনটা নিয়ম মেনে চললে মোটামুটি ভাবে তুমি বাংলাদেশে টিকে যাবে।
রুমি বলল, ছিনতাই নিয়ে একটা বক্তৃতা দেবে না? হরতাল নিয়ে? সন্ত্রাস নিয়ে?
ছোট খালা বললেন, আহা! মেয়েটা মাত্র এসে পৌঁছেছে এর মাঝে যত খারাপ খারাপ কথা সব বলতে শুরু করেছিস! তোরা একটু থামবি?
রুমি বলল, ঠিক আছে থামছি। কিন্তু এর পরে টুম্পা আপু যদি বাইরে গিয়ে ছিনতাই হয়ে যায় আমাকে দোষ দিও না!
খাওয়ার পর টুম্পা তার স্যুটকেস খুলে উপহারগুলো বের করলো। ছোট খালুর জন্যে ইলেকট্রিক রেজর, ছোটখালার জন্যে সোয়েটার আর চামুচের সেট, সুমির জন্যে কানের দুল, রুমির জন্যে একটা বাইনোকুলার! এছাড়া সবার জন্যে চকলেটের প্যাকেট, কফির টিন, শ্যাম্পু, বডি লোশান, বলপয়েন্ট কলম, স্টেপলার খুঁটিনাটি একশো রকম জিনিস! টুম্পা কিছু একটা বের করা মাত্র রুমি সুমি তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে টানাটানি শুরু করে দেয়। সবাই মিলে যখন হৈ চৈ হচ্ছে তখন আমেরিকা থেকে ফোন এল, টুম্পা ঠিকমতো পৌঁছেছে কী না জানার জন্যে আম্মু ফোন করছেন! ছোটখালা টুম্পাকে ফোনটা ধরিয়ে দিলেন, টুম্পাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু বলতে হলো!
কথা শেষ হবার পর ছোট খালা জিজ্ঞেস করলেন, এখন আমেরিকাতে কয়টা বাজে?
রাত বারোটা!
সর্বনাশ, তোর নিশ্চয়ই খুব ঘুম পেয়েছে! তুই শুয়ে একটু বিশ্রাম নে।
না, ছোট খালা, আমি প্লেনে অনেক ঘুমিয়েছি।
প্লেনে আবার মানুষ ঘুমায় কেমন করে? বিছানায় শুয়ে ঘুমা।
ছোট খালা রীতিমতো জোর করে টুম্পাকে তার ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তখন হঠাৎ করে টুম্পা বুঝতে পারলো আসলেই তার খুব ঘুম পেয়েছে। বিছানায় শুতেই তার চোখ বন্ধ হয়ে এল, তার এখনও বিশ্বাস হয় না, পৃথিবীর একেবারে উল্টো দিকে সে চলে এসেছে। এখানে অত্যন্ত বিচিত্র এক ধরনের ভ্যাপসা গরম, মাথার উপরে সিলিং ফ্যান নামে একটা বিচিত্র জিনিষ পাই পাঁই করে ঘুরে তাকে বাতাস দেবার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। এই গরমকে দূর করা যায় না, এই গরমে অভ্যস্ত হয়ে যেতে হয়।
টুম্পা চোখ বন্ধ করার আগে ঘরটির চারপাশে তাকালো, একটা আলমিরা, পড়ার ডেস্ক, দেওয়ালে কয়েকটা ছবি। একটা ছবিতে তার চোখ আঁটকে গেল। ছোট একটা বাচ্চার ছবি। ছবিটাকে তার পরিচিত মনে হচ্ছে, কোথায় দেখেছে সে এই ছবি? প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করতে করতে গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল টুম্পা।
দেয়ালে ঝোলানো ছবি
টুম্পার ঘুম ভাঙার পরও সে কিছুক্ষণ মনে করতে পারল না সে কোথায়। কিছু একটা সে খুঁজছে কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না এরকম কিছু তার মনে হতে থাকে। চারপাশে এক ধরনের কোলাহল, অপরিচিত শব্দ, শা শা করে কিছু একটা ঘুরছে, বাতাস বইছে সেখান থেকে কিন্তু তার মাঝে অদ্ভুত ভ্যাপসা এক ধরণের গরম। টুম্পা চোখ খুললো এবং হঠাৎ করে তার মনে পড়লো সে বাংলাদেশে এসেছে। সে এখানে চার সপ্তাই থাকবে, আজ তার প্রথম দিন। ছোট খালার বাসায় সুমির বিছানায় সে শুয়ে আছে, শাঁ শাঁ শব্দটা আসছে মাথার উপরের সিলিং ফ্যান থেকে। বাইরে এক ধরনের কোলাহল, গাড়ির হর্ন, বাস ট্রাকের গর্জন, রিক্সার বেল মানুষের গলার আওয়াজ, তার মাঝে একটা কাক কা কা করে ডেকে উড়ে গেল। ঠিক কী কারণ জানা নেই টুম্পার ভেতরে এক ধরনের দুঃখ দুঃখ ভাব এসে ভর করেছে। কোনো কারণ নেই তবু তার মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়ে যায়, কীভাবে এটা হয় কে জানে? টুম্পা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে শুয়ে রইলো, চোখ ঘুরে ঘুরে দেওয়ালে টানানো ছবিটার দিকে গেল এবং সে তখন বিছানা থেকে নেমে এল।