মেয়েটা বলল, আমাদের কথা সব ভুলে গেছে। এখন খালি তোমার কথা বলে আর কিছু বলে না!
ছেলেটা বলল, ও! আচ্ছা, আপু তুমি বাংলা বুঝো তো?
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, বুঝি।
গুড। ছেলেটা বলল, আমার নাম রুমি। আমি তোমার কাজিন। খালাতো ভাই।
মেয়েটা বলল, আমি সুমি। তোমার খালাতো বোন।
ছেলেটা বলল, আর এই যে মহিলাটা তোমাকে চেপে ধরে চুমু খাচ্ছে সেটা হচ্ছে আমাদের আম্মু। তোমার খালা।
টুম্পা বলল, আমি সেটা আন্দাজ করেছি।
টুম্পার ছোট খালা আবার টুম্পাকে চেপে ধরে চুমু খেতে লাগলেন। রুমি আর সুমি অনেক কষ্ট করে তার মাকে টেনে আলাদা করল। ঠিক কী কারণ জানা নেই টুম্পার মনে হলো বাংলাদেশের মাটিতে ঠিক এভাবেই কোনো একজনের এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরার কথা ছিল, ঠিক এইভাবে তার ঘাড়ে আর মাথায় চুমু খাবার কথা ছিল।
শেষ পর্যন্ত গাড়িতে উঠে তারা যখন রওনা দিয়েছে তখন ছোট খালা একটানা কথা বলে যেতে লাগলেন, ঐ দেখ এয়ারপোর্টে আরবিতে নাম লিখে রেখেছে, আরবিতে কেন নাম লিখতে হবে? যারা আরব দেশে থাকে এটা কী তোদের দেশের এয়ারপোর্ট? তারা কী তাদের দেশের এয়ারপোর্টের নাম বাংলাতে নাম লিখাবে? তাহলে আমরা কেন আরবিতে লিখব? সবুজ বেবিট্যাক্সিগুলি দেখেছিস? এগুলির নাম সি.এন.জি.। খবরদার একা কখনো সি.এন.জি.–তে উঠবি না। উঠলেই তোকে ছিনতাই করে ফেলবে। ছিনতাই করে চোখে গুল লাগিয়ে দেবে। গুল কী জানিস? এক রকম মলম। চোখে লাগালে চোখ জ্বলতে থাকবে, চোখ খুলতে পারবি না। আর এই যে সি.এন.জি. দেখেছিস এক মন্ত্রী প্রতি সি.এন.জি.–তে এক লাখ টাকা করে ঘুষ খেয়েছে। এই মোটা এক মন্ত্রী। তোদের আমেরিকাতে কি সি.এন.জি. আছে? নাই! আমি জানতাম থাকবে না। যত ভেজাল জিনিষ সব আমাদের দেশে। দ্যাখ টুম্পা তাকিয়ে দেখ রাস্তার পাশে খেজুর গাছ লাগিয়েছে। কেন লাগিয়েছে জানিস? মিডল ইস্ট বানানোর জন্যে। বাংলাদেশ কী মিডল ইস্ট? এখানে রাস্তার পাশে খেজুর গাছ লাগাবে কেন? বুঝলি টুম্পা দেশটাকে জঙ্গীরা দখল করার প্ল্যান করছে। কথা নাই বার্তা নাই খালি বোমা। তোদের আমেরিকাতেও জঙ্গী আছে? আছে না? টেলিভিশনে দেখালো এতো বড় বড় দুইটা দালান গুড়া করে দিল। জঙ্গীদের উৎপাত আর ভালো লাগে না। টুম্পা, তোরা কী খাস ওখানে? ভাত খাস তো? আমি ভাত রেধে রেখেছি তার সাথে মুরগি। দেশি মুরগি। ফার্মের মুরগি আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। তোদের ওখানে তো সব ফার্মের মুরগি। তাই না? দেশি মুরগি খেয়ে দেখিস। স্বাদ একেবারে জিবে লেগে থাকবে। তবে যা দাম–খালি মুরগি না সব কিছুর দাম। তুই বিশ্বাস করবি না একবার শুনি কাঁচা মরিচের কেজি চুরাশি টাকা। চুরাশি বুঝিস তো? এইটি ফোর। তুই বিশ্বাস করবি? আমি নিজের চোখে দেখেছি…
রুমি আর সুমি অনেক কষ্ট করে তার মাকে থামালো থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, প্লেনে কোনো অসুবিধে হয় নি তো?
টুম্পা মাথা নাড়লো, না। হয় নি।
সুমিই জিজ্ঞেস করলো, বাংলাদেশ কেমন লাগছে?
ভালো। খুব ভালো। শুধু গরম একটু বেশি। আর—
আর কী? মানুষ অনেক বেশি।
রুমি হি হি করে হেসে বলল, এখানে মানুষ কোথায়। এটা তো ফাঁকা, তোমাকে একদিন নিয়ে যাব বঙ্গবাজারে দেখবে কতো মানুষ!
সুমি জিজ্ঞেস করলো, তুমি কয়দিন থাকবে?
ছোট খালা ধমক দিয়ে বললেন, মেয়েটা এখনো পৌঁছায় নাই, এখনই যাবার কথা বলছিস কেন?
টুম্পা বলল, না, না, ঠিক আছে।
চার সপ্তাহ থাকব।
মাত্র চার সপ্তাহ?
চার সপ্তাহ মোটেই মাত্র না। আঠাইশ দিন।
সুমি বলল, অনেক মজা হবে আমাদের। অনেক মজা।
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ অনেক মজা।
.
বাসায় পৌঁছানোর পর ড্রাইভার স্যুটকেস দুটি টেনে টেনে উপরে নিয়ে গেল। রুমি সুমির বাবা, টুম্পার ছোট খালু বের হয়ে এলেন, শুকনো পাতলা মানুষ, নাকের নিচে বড় বড় গোঁফ, মাথার চুল সামনের দিকে পাতলা হয়ে এসেছে। টুম্পাকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, এসো মা, এসো। ওয়েলকাম টু বাংলাদেশ!
টুম্পা বলল, থ্যাংক ইউ।
আমি শুনে খুবই অবাক হয়েছি, তুমি নাকি বাংলাদেশে আসার জন্যে একেবারে টুথ এন্ড নেইল ফাঁইট করেছ!।
টুম্পা কিছু বলল না, একটু হাসার মতো ভঙ্গি করল। ছোট খালু বললেন, সবসময়ে তো উল্টোটা দেখি! মানুষ আমেরিকা যাবার জন্যে টুথ এন্ড নেইল ফাঁইট করে।
টুম্পা আবার একটু হাসির মতো ভঙ্গী করল। ছোট খালু বললেন, তুমি এতো সখ করে বাংলাদেশে এসেছ, তোমাকে এখন আমরা কোথায় নিয়ে যাই? এই দেশে তো সেরকম কিছুই নেই। ইন্ডিয়ায় কতো কী দেখার আছে– তাজমহল আছে, অজন্তা ইলোরা আছে, শান্তি নিকেতন আছে–
টুম্পা বলল, আমি কিছু দেখতে আসি নি ছোট খালু। আমি শুধু বাংলাদেশে আসতে চেয়েছি।
সেটা অবশ্যি এসে গেছ, তোমার মিশন কমপ্লিট।
টুম্পা হাসল, বলল, মিশন কমপ্লিট।
রুমি বলল, না আপু, তুমি মিশন কমপ্লিট বল না। আব্বু আম্মু আমাদের কোথাও নিয়ে যায় না–এখন তোমাকে নিয়ে যেতে হবে তোমার সাথে সাথে আমরা যাব। কক্সবাজার যাব, রাঙ্গামাটি যাব, সুন্দরবন যাব–
ছোট খালু বললেন, টুম্পাকে নিয়ে যাবার কথা, তোদের নিতে হবে কে বলেছে?
সুমি বলল, আমাদের না নিয়ে কোথাও যাবার খালি চেষ্টা করে দেখো একবার!
ছোট খালা বললেন, ব্যাস অনেক হয়েছে। টুম্পা মা যা, গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আয়। তুই সুমির ঘরে থাকবি, তোর সুটকেস নিয়ে গেছে তোর ঘরে।